আমি অর্ক। একটা বেসরকারী ফার্মে ছোটখাট চাকরী করি। থাকি মেসে। বন্ধুবান্ধব নাই। মানে করা সম্ভব না। মেসের অন্য বাসিন্দাদের সাথে আমার কিছুই মেলে না। ওদের মত রেগে গিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না, অশ্লীল জোক বলা সম্ভব না। ছুটির দিনে পয়সা দিয়ে তাস খেলাও সম্ভব না।
আমার দাদা ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার। শিক্ষিত রুচিশীল। বিয়ে করেছিলেন তিনবার। প্রথম দুই বৌ, মেয়ে জন্ম দেবার পরপর মারা যায়। তৃতীয়বারে বিয়ে করে আনেন আমার দিদা’কে। এবারে এলেন আমার বাবা। সে আমলে বউকে প্রকাশ্যে ভালোবাসা দেখানো যেমন ছিল গর্হিত অপরাধ, নিজের সন্তানকে ভালোবাসা দেখানোও আদিখ্যেতা বলে গণ্য করা হত। তারপরেও আমার দাদা তার ছেলেকে প্রচুর প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। ফলাফল স্বরূপ বাবা পড়াশুনা তেমন করলেন না। মানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা। তবে বই পড়তেন প্রচুর। বয়স বাড়ল, জমিদারীর দায়িত্ব নেবার কোনো আগ্রহ দেখালেন না। মাছ ধরা, শিকার করা, বই পড়া, আর নিত্য নতুন হুজুগ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কোনো বাজে অভ্যাস অবশ্য ছিল না। সিগারেটটুকু পর্যন্ত খেতেন না।
ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, অতএব যথাসময়ে বিয়ে দিলেন আমার দাদা। এক বছরের মাথায় আমি ধরাধামে পদার্পণ করলাম। এর পরপর আমার দাদা মারা গেলেন। উনি মারা যাবার পর বাবাকে বাধ্য হয়ে জমিদারীর হাল ধরতে হল। কিন্তু একাজে তিনি একেবারেই আনাড়ি। বাবা ছিলেন স্বপ্ন দেখা মানুষ। পৃথিবীর সাথে তার যোগ থাকত খুব কম, নিজের জগতেই থাকতেন বেশি। সেইসাথে জাগতিক জীবনের প্রতি ছিল একধরণের নিঃস্পৃহতা। গৃহী হয়েও যেন সন্যাসী। ফলে খুব দ্রুত আমাদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
বাবা মারা যেতে যেতে আমাদের অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে গেছিল। আমাকে বাধ্য হয়ে চাকরির খোঁজ করতে হল। কিন্তু বাবার মতো আমিও এক স্বপ্ন দেখা, দুনিয়া সম্পর্কে চরম উদাসীন মানুষ। কোনোরকমে এই চাকরীটা জোগাড় করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ততোদিনে মা’ও চলে গেছেন। কাজের সময়টুকু আমি ঘাড় গুঁজে কাজ করি। কাজের বাইরে কারো সাথে তেমন মিশি না। ওয়ার্কিং আওয়ার্স শেষ হলে যেন মুক্তির আনন্দ পাই। ঘরে ফিরে নিজের জগতে ডুবে যাই।
আমার মাঝেও বাবার নিঃস্পৃহতা পুরাদমে বিদ্যমান। ছোটবেলায় দাদাবাড়ির শান শওকত আমার বর্তমান জীবনে কানাকড়িও আর নাই। কিন্তু আমার তাতে কিছু এসে যায় না। নিকট আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের অভাবও আমাকে পীড়া দেয় না।
বংশগতভাবে আমরা সবাই সুন্দর, কথাবার্তায় রুচির ছাপ। সেজন্য সহজেই অন্যের চোখে পড়ে যাই। বিশেষ করে মেয়েদের। কিন্তু এসবে আমি সম্পূর্ণ উদাসীন।
অফিসে আমার পাশের ডেস্কে বসত অদিতি। কারণে অকারণে আমার ডেস্কে এসে ঘুরঘুর করত, আলাপ জমাতে চাইত। আমি পাত্তা দেবার বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করি না। আসলে কোনোকিছু আমাকে টানে না। আমি যেন শুণ্যে দোলুল্যমান এক মানুষ। কাটাঘুড়ির মত। পৃথিবীর সাথে আমার যোগ খুব সামান্য।
আজ অদিতি তার বিয়ের কার্ড অফিসের সবাইকে বিলালো। সবশেষে এল আমার কাছে।
দুচোখে আগুন নিয়ে বলল— তোমাকে আমি অভিশাপ দিলাম। একদিন তুমিও কাউকে চাইবে। কিন্তু সে তোমার অধরা রয়ে যাবে।
কথাটা না শোনার ভান করে কার্ডের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললাম— অনেক অভিনন্দন। নিশ্চয় তুমি সুখী হবে।
অদিতি আমার হাত থেকে কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর অফিসে এল না।
দিন চলতে থাকে দিনের মত। কয়েক বছর পার হয়ে গেল। আমার অবস্থার তেমন কোনো উনিশ বিশ হয়নি। এ নিয়ে আমার মনে সামান্যতম খেদ নাই।
এক ছুটির দিনে গোসল সেরে আয়নার সামনে চুল আঁচড়াচ্ছি, খেয়াল করলাম আয়নার ঠিক মাঝবরাবর চিড় ধরেছে। গা করলাম না। কিন্তু চিড়টা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। মনে পড়ল ফাটা আয়নায় মুখ দেখলে নাকি অকল্যাণ হয়। হাসি পেল। আমার আবার কল্যাণ আর অকল্যাণ!
এর পরপর এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত শব্দ। অনেকটা ঝি ঝি পোকার ডাক যেন। উঠে বসলাম। আয়নার ফাটল থেকে নীলাভ রূপালি আলো বের হচ্ছে। শব্দটাও মনে হয় সেখান থেকে আসছে। একটু আশ্চর্য হয়েই খাট থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উকি দিলাম। ভয় পাবার কথা আমার মনেও আসেনি।
শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল।সেইসাথে কেমন একটা ঝিনঝিন অনুভূতি আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। যেন শরীরে খুব লো ভোল্টেজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। পরমুহূর্তে প্রচন্ড এক শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে গেল আয়নার ভিতরে।
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারিদিক তাকালাম। সামনে আমার অফিস বিল্ডিং। হঠাত এখানে এসে পড়লাম কেন ভাবছি, আমার সামনে এক আলিশান গাড়ি এসে থামতে যে লোকটি গাড়ি থেকে নেমে আমার মুখামুখি দাঁড়ালো, তাকে দেখে চমকে গেলাম। নিজের মুখামুখি হলে অন্যদের কেমন লাগতে পারে আমার জানা নাই তবে আমি সত্যি খানিকটা ভড়কে গেলাম। এটা কেমন করে সম্ভব? এর মানেই বা কী?
অন্য আমিটা কিন্তু আমাকে দেখে কোনো রিয়েক্ট করল না। বলল—
— আজকের এজেন্ডায় কী আছে?
থতমত খেয়ে আমি মুখ খুলবার আগেই শুনতে পেলাম
— আজকে সকালে সানরাইজের সাথে ওভারসিজ কনফারেন্স কল। তার পরপর দুইটা মিটিং। লাঞ্চের পরে ফ্রি রাখতে বলেছিলেন, স্যার।
— গুড। লেটস স্টার্ট দা ডে।
অন্য আমিটা দৃপ্ত পায়ে অফিসে গিয়ে ঢুকে পড়ল, পেছনে পেছনে তার সেক্রেটারি।
আমি অবাক হবারও সময় পেলাম না। অন্য আমিটার পিছনে ছুটতে ছুটতে অফিসে ঢুকে পড়লাম। অন্য আমিটা আমাকে দেখতে পেল না কেন?
অফিসের সব কর্মচারীদের মধ্যে অন্য আমিকে দেখে যেন একটা সাড়া পড়ে গেল। সবাই কাজে একটু যেন বেশি মনোযোগ দিল ওকে দেখে, সাথে চারদিক থেকে “গুড মর্নিং, স্যার” ছুটে আসতে থাকল। অন্য আমি মাথা ঝাঁকিয়ে একবার গুড মর্নিং বলেই লিফটে উঠে পড়ল। সাথে আমিও।
বাকি দিনটা আমি অন্য আমি’র সাথে সাথে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম শুধু যে অন্য আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না তা নয়, আর কেউও আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। যেন আমার কোনো অস্তিত্ব নাই।
লাঞ্চ ব্রেকের আগে বজ্রপাতের মত কারণটা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। আমি অন্য পৃথিবীতে এসে পড়েছি। এ এক অন্য ডাইমেনশান যেখানে আরেকটা আমি রয়েছে। তফাৎ শুধু যে এই আমিটা একজন অত্যন্ত সফল ব্যক্তি। বিশাল কম্পানির সে মালিক। প্রচণ্ড দক্ষ, কথাবার্তায় চৌকশ। সোজা কথায় আমি যা নই, সে তাই।
অন্য আমিকে দেখে আমার বেশ ভালোই লাগছে এখন। দেখছি সে কিভাবে দক্ষহাতে সব সামলাচ্ছে। আমার পক্ষে যা জীবনেও সম্ভব হত না। কারণ এত কথা এত গুছিয়ে বলা আমার বাবারও অসাধ্য। লিটেরালি। যাক, কোথাও না কোথাও আমার একটা কপি তো রয়েছে যে আমার হুবহু বিপরীত।
অন্য আমি লাঞ্চ সারল এক বিলাসবহুল রেস্তোরায়, ক্লায়েন্টদের সাথে। আমি ওর পাশে গাড়িতে বসলাম, টেবিলে ওর পাশের চেয়ারে বসলাম।
লাঞ্চ শেষ হয়ে গেল। অন্য আমি খুব ভালো একটা প্রোজেক্ট হাতে পেয়ে গেল।
রেস্তোরা ছেড়ে বেরিয়ে এসে অন্য আমি ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দিল। নিজেই ড্রাইভ করতে আরম্ভ করল। আমি ওর পাশে বসে আমার চিরপরিচিত ঢাকা শহর দেখতে থাকলাম। অন্য এক পৃথিবীর।
আলিশান বাড়ির সামনে গাড়ি থেমে পড়তে দারোয়ান শশব্যস্তে গেট খুলে দিল। গাড়িবারান্দায় পার্ক করে অন্য আমি নেমে পড়ল। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে উঠল
— কই তুমি? আমি সব কাজ বাদ দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়লাম আর তোমার পাত্তা নাই।
বুঝলাম অন্য আমি’র একটা পারিবারিক জীবনও রয়েছে। কথা শুনে মনে হচ্ছে সুখী পারিবারিক জীবন। ভালোই লাগল জেনে। ওর সবকিছু যখন আমার বিপরীত, একটা বউ না থাকলে ঠিক মানায় না।
— এই তো আমি। সেই কখন থেকে তৈরী হয়ে অপেক্ষা করছি। ভেতরের ঘর থেকে কেউ বলে উঠল।
গলাটা খুব পরিচিত। এই গলা আমি আগে শুনেছি।
ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াল অদিতি! সুসজ্জিত।
অন্য আমি হাসতে হাসতে তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে বসিয়ে দিল এক দীর্ঘ চুমু।
অদিতি ধাক্কা দিয়ে ওকে সরালো।— এসেই দুষ্টামি? আগে তোমার জন্য এক সারপ্রাইজ আছে। চল দেখবে। অদিতি অন্য আমিকে হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যেতে থাকে।
এরপরের ঘটনা আমার জানা হল না কারণ আগের সেই তীব্র শক্তি আমাকে ঝটকা মেরে নিয়ে এল আমার নিজের পৃথিবীতে। আমি অজ্ঞানের মত বাকি রাত পড়ে রইলাম।
এ অভিজ্ঞতার পর নিজের পৃথিবীর প্রতি আমার সামান্যতম টানও আর রইল না। মন পড়ে রইত অন্য পৃথিবীতে। বারবার রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চলে যেতে চাইতাম ওখানে। কখনো সফল হতাম, কখনো সফল হতাম না। যে দিনগুলিতে ব্যর্থ হতাম, সে দিনগুলি নিজের কাছে অসহ্য লাগত। কী এক অস্থিরতায় আমাকে পেয়ে বসত। আমি যেন ওখানে কিছু ফেলে এসেছি। এখানে বৃথা সময় নষ্ট করছি। ঐ গানটার মত
“তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মোর মন রে আমার।“
আরো কিছুদিন যেতে আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল আমি কেন অস্থির হয়ে যাই ওখানে যেতে না পারলে। অন্য আমিকে আমি হিংসা করছি। এজন্য না যে সে একজন সফল, জীবন নিয়ে পরিতৃপ্ত মানুষ। কিন্তু এজন্য কারণ ওর কাছে অদিতি রয়েছে।। অদিতিকে যতো দেখছি, ওর আকর্ষণ আমার কাছে ততো বেড়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মত আমি কোনোকিছু এভাবে চাইতে শুরু করি। হ্যাঁ, অদিতিকে আমার চাই। অন্য অদিতিকে। ওকে দেখতেই আমি ওখানে যাই। ওর কথা, ওর হাসি, ওর ভালোবাসার ক্ষমতা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। অথচ অদিতি জানেও না আমার অস্তিত্বের কথা। দিব্যি অন্য আমিকে নিয়ে বিভোর হয়ে আছে। জীবনে প্রথম আমি কাউকে হিংসা করলাম। আর সে হিংসার পাত্র আমি নিজেই।
কী প্রচন্ড হাসির কথা। যত ভাবি ততো হাসি পায়।
জীবনের থেকে বড় কৌতুক আর নাই।
আমি এখন কী করব?
Views: 149