কত মানুষের কত কিছু নিয়ে দুঃখ আর আমার দুঃখ আমার নাম নিয়ে। মাগরিব ওয়াক্ত শেষে এশার ওয়াক্তে আমার জন্ম হয় তাই মা আমার নাম রাখেন এশা। স্কুলে বন্ধুরা আমাকে ডাকত মশা নামে। স্কুল থেকে ফিরে মাকে কত বকা দিতাম কেন এমন নাম রেখেছে । মা বলত নামে কি যায় আসে ? নাম যেমনি হোক একে সুন্দর করতে হয় কাম দিয়ে। আমি এতো কিছু বুঝতাম না শুধু রাগ করতাম। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা কে আর ও বেশি অপছন্দ করা শুরু করলাম। কারন তার সব কাজের মধ্যে আমাকে প্রচ্ছন্ন অবহেলা র উপস্থিতি টের পেতাম।
দাদা বেঁচে থাকা অবধি আমরা দাদা বাড়িতে সবার সাথে থাকতাম। আমার বেড়ে উঠার সংগী ছিল চাচাতো ভাই শামীম। ও আমার চেয়ে আটমাসের বড়। চাচী শামীম ভাই কে এমন ভাবে আদর করত যে মা ছাড়া সকলে খুব তৃপ্তির দৃষ্টি তে দেখতো চাচীকে। আমি ছোট হলেও বুঝতাম আমি আর শামীম একি বয়সের হলেও আমাকে মা অবহেলা না করলেও শামীমের মত যত্ন নেয়না। আমি মাঝেমাঝেই আমাদের ঘরের বারান্দা থেকে ক্ষুদার্ত চোখে শামীম ভাইকে দেখতাম। আর আমার কেন এমন মা হলো এজন্য আল্লাহকে কত বিচার দিয়েছি। দাদী বলতো তোর মা ছেলে বাচ্চা বেশি পছন্দ । তুই মেয়ে তাই তোর মা তোকে ভালোবাসেনা।
জ্যৈষ্ঠর কড়ারোদে স্কুল ছুটি হলে চাচী ছাতা হাতে পানির বোতল নিয়ে শামীম ভাইর জন্য স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতো। কি যত্ন করে রোদ বাঁচিয়ে চাচী শামীমের ব্যাগ টা কাধ থেকে নিয়ে গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরতো। চাচী বলতো, কিরে এশা তোর মা এসময় ঘুমায় কেন ? তোকে নিতে এলেই তো পারে? তাইতো মা কেন আসেনা? একগলা অভিমান নিয়ে বাড়িতে যেয়ে মা কে বলতাম তুমি চাচীর মত আমার জন্য ছাতা নিয়ে স্কুলে যাওনা কেন? মা বলত ” আমার এতো আহলাদ নাই। রোদে পোড়ার এই তো সময় । পুইড়া খাঁটি হ। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তাই ননীর পুতুল হবি নাকি?
সে বয়সে আমার মধ্যে ভেজালের কি ছিল যে রোদে পুড়ে খাঁটি হতে হবে ? আমি জানিনা তবে মায়ের আদর আর একটু বেশি যত্ন পাবার জন্য খুব অপেক্ষায় থাকতাম। শামীমকে আমার খুব হিংসা হতো। ওর মা ওকে কত আদর করে। স্কুল থেকে ফিরলে মা ভাত বেড়ে দিত কিন্তু বারান্দা থেকে দেখতাম চাচী কি সুন্দর করে শামীম কে কাঁটা বেছে খাইয়ে দিত। পানিটা পর্যন্ত হাঁদারাম শামীম নিজে ঢেলে খেতনা।
মাকে সেই সময় বিরক্ত লাগলেও বেশ কিছু কাজে খুব ভালোলাগতো। কারন আমার পছন্দের কাজগুলো মা অনায়াসে করার অনুমতি দিত। যেমন ভর দুপুরে সবাই ঘুমালেও মা বসে বই পড়ত আমি বাইরে যেতে চাইলে কোথায় যাবো জানতে চাইতো কিন্তু কখনো মা মানা করতোনা। ইচ্ছে মত বাড়ীর পাশে পুকুরে গা এলিয়ে গোসল করতাম যতক্ষন মন চায়। অথচ শামীমের তখনো পুকুরঘাটে আশেপাশে আসা বারণ ছিল। শামীমের প্রতি এমন যত্নে র কারনে সবাই চাচীর বেশ প্রশংসা করত। খুব যত্নবান মা হিসেবে তার একটা নাম ছিল পাড়াপ্রতিবেশির কাছে। আর আমার প্রতি মায়ের উদাসীনতার কারনে সবাই কথা শুনাতো মাকে। সবাই আমার ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তিত । সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল চাচী।
তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। একদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে খুব মজা করে খেলছিলাম। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নেমেছে টের পাইনি। বাড়ি ফিরে দেখি উঠোনে মা অপরাধির মত দাড়িয়ে আছে আর বাবা, দাদা চাচা বকা দিচ্ছে মাকে । কেন মা চাচীর মত নয়,কেন একটা মেয়ের যত্ন নিতে পারেনা। শামীমকে যেমন চাচী যত্ন করে আঁচলের তলায় রেখে মানুষ করছে আমার মা কেন তেমন নয়? মা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থেকে সেদিন জবাব দিয়েছে , এতোটুকু মেয়ের আবার ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু কি ? আর কিছুদিন পর তো মেয়েটা খেলতে যেতে ও পারবেনা । এখন যতটুকু ইচ্ছা খেলুক। সবাই সেদিন মাকে ছিছি করেছে তার বোকামীর জন্য। আমার জীবন নষ্ট করবে আমার মা এই ভবিষ্যত বানী সেদিন দাদা করে দিয়েছিল। নিজের কাছে নিজেকে সেদিন ভীষন অপরাধী লাগছিল আমার জন্য মাকে বকা খেতে হলো। রাতে শুয়ে হঠাৎ পিঠে মায়ের হাতের র্স্পশ ,চমকে তাকাই মায়ের চোখে যেন জ্বলছে চোখ দুটো । মা খুব আস্তে করে বললো, তোর দাদু র কথায় ভয় পেয়েছিস? ভয় পাবিনা। তুই আমার কাছে মেয়ে না তুই মানুষ । তোকে আমি মেয়ে মানুষের মত করে মানুষ করিনী । তোকে তোর ইচ্ছার মত করে মানুষ করেছি। অনেকদুর যেতে হবে তোকে । সেদিন মেয়ে বলে থেমে যেন না যাস তাই আমি কখনো তোকে থামাইনি।
আমার সে রাতের সব গুলো কথা মনে নেই । সে রাতে আমি সব কথার মানে বুঝিনী। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম আমাকে অনেকদুর যেতে হবে । মায়ের চোখ দুটো সেদিন অন্যকথা বলছিল।
সবাই ভাবতো আমার মা খুব আরাম প্রিয় , অলস, কারো সাথে মিশেনা । তাই তো কাজ শেষে ঘরে পরে পরে ঘুমায় । কিন্তু আমি জানি মা ঘরে বসে আছে মহাশ্বেতা দেবীর বই নিয়ে । কখনো বা ফালুদা র রহস্য বই অথবা কখনো দেখতাম সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমন গল্প পড়তে পড়তে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুকিছু বই আমি মায়ের অনুরোধে স্কুল লাইব্রেরী থেকে এনে দিতাম। মাঝেমাঝে রাতে সেগুলো গল্প করত আমাকে ,তুই যখন এ দেশে ঘুরতে যাবি আমাকে ওখানে নিয়ে যাস । আমরা মা মেয়ে ওই নদীর পারে ঘুরব। এমন ভাবে বলতো যেন মা জানে আমি সত্যি সত্যি বইয়ে পড়া ও দেশ গুলো ঘুরতে যাব।
মায়ের দুনার্মের সাথে বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমিও কিছু দুনার্মের ভাগি হলাম। যেমন আমি স্কুলে খেলার সাথি হিসেবে মেয়ের চেয়ে ছেলে বন্ধু কে বেশি পছন্দ করি। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগীতায় জয়ী হয়ে পুরষ্কার আনলে একমাত্র বাবা মার চোখ চকচক করত। ভীষন খুশি হতো মা। আর সবাই বলতো মায়ের কারনে আমি ছেলেদের চারিত্রিক গুন পাচ্ছি। আমার তেমন কোন খারাপ লাগতোনা।
আমি ক্লাস নাইনে উঠার পর বাড়ী থেকে বেশ দুরে এক স্কুলে ভর্তি হলাম । আমার সাথে শামীম ও ভর্তি হয় । কিন্তু প্রতিদিন এতো দুরে হেটে স্কুল করা ,একব্যাগ বই কাধে ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া শামীমের জন্য অসম্ভব। চাচী তাই শামীমের স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দিলেন। বাড়ীর আর সবাই আমাকেও নিয়মিত স্কুলে যেতে নিষেধ করল। মা ব্যাপারটাকে কোনভাবে মেনে নিতে পারছিল না। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়ীর বারান্দায় একটা সাইকেল। আমার জন্য মা কিনে আনিয়েছে। তার জমানো টাকা থেকে সাইকেল কিনেছে। এ জন্য মাকে অনেকের কাছে ই খুব প্রত্যাশিত কটু কথা শুনতে হয়। কোন কথার প্রতিবাদ না করে আমাকে আম্তে করে বলেছে কারো কথায় কান দিসনা । উত্তর না দিয়েও অনেক উত্তর দেয়া যায়। কয়েকদিনে আমি সাইকেল চালানো শিখে গেলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন । আমি যখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম রাম্তার সব মানুষ আমাকে দেখত। কারন আমার সাইকেলের পিছনে শামীম বসে যেত স্কুলে । চাচী ই বলে দিয়েছিল শামীম সাইকেল চালাতে পারেনা। আর ব্যস্ত রাস্তায় ছেলেকে সাইকেল দিয়ে পাঠাতে চাচীর সাহসে কুলায়না।
মায়ের প্রতি একটু একটু করে আমার ধারনা পাল্টাতে শুরু করল। কেন আমার মা অলস ,কেন শামীমের মত যত্ন নেয়না তখন আমি প্রতিদিন একটু একটু করে বুঝতে পারতাম। আর প্রতিদিন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতো। এইকাজ গুলো দিয়ে আমি আমার মাকে নতুন করে চিনতে পারি । তাকে বুঝবার মত যোগ্যতা আমার এতোদিন ছিলনা। আমি বুঝতে পারি সবাই মা হতে পারেনা। মা তার কাজের মধ্যে দিয়ে যেভাবে আমার জগৎকে মজবুত একরুপ দিয়েছে, আমাকে প্রতিদিন সে তৈরী করেছে বাস্তবতার সাথে লড়তে। আমিও লড়ে গেছি । বাধা এসেছে। কিন্তু আমরা মা মেয়ে থেমে থাকিনী।
সন্ধায় পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে বাধা না দিয়ে মা আমাকে শিখিয়েছে অন্ধকার খারাপ না যদি সেখানে কোন খারাপ চিন্তা না থাকে। ঘরে বন্দি না থেকে স্কুলে গেছি সাইকেল চালিয়ে সেদিনই আমার রক্ত জেনে গেছে রাস্তা যেমনি হোক পথে নামতে হবে। একা।
আমার সে ভাই শামীম গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে শহরে যেতে সাহস করেনি। চাচী শামীমের আত্নবিশ্বাস তৈরী হবার আগেই নষ্ট করে দিয়েছে। শামীম কখনো নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শিখেনি। মা মানেই সন্তানের সমস্ত জগতের মালিক সে নয় এ সত্য খুব কম মা সময় থাকতে বুঝে। আজ ও সবাই ভাবে আমার মা আমাকে এতো টা খারাপ বানিয়েছে ,তার যত্নে র অভাবে আমি বেয়াঁরা হয়ে গেছি। দেশে বেড়াতে গেলে কোন না কোন ফাঁকে চাচী একবার বলবেই তোর মা বলেই পারে মেয়েকে বিদেশে ফেলে রেখে শান্তি তে থাকতে।
আজ আমি দেশে র চেয়ে বিদেশে থাকি বেশি। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চাকরী করি । মা ও আমার সাথে থাকে। মাঝেমাঝে দেশে যায় বেড়াতে। সুযোগ পেলেই মা মেয়ে ঘুরে বেড়াই। সেদিন লন্ডনের টেমস নদীর সামনে বসে মাকে বলেছিলাম মা তোমাকে আমি ছোটবেলায় খুব অপছন্দ করতাম। তুমি আমাকে স্কুলে ছাতা হাতে আনতে যেতেনা বলে । আমরা মা মেয়ে অনেক হেসেছি । মা জানতে চাইছিল এখন পছন্দ করিস?
আমি সত্য কথা বলতে পারিনি। আমি বলতে পারিনি একটা সাইকেল কিনে দিয়ে তুমি আমার স্কুলে যাবার পথ শুধু সহজ করনি মা তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে কখনো থেমে যেতে নেই। কোন না কোন ভাবে মেয়েদের চলতে হবেই । সে পথ নিজেকে তৈরী করে নিতে হয়।
Views: 375