সতের বছরের মেয়ে আফিয়ার নিস্তেজ শরীর, তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মাটির মেঝে। পরীবানু কী করবে বুঝতে পারছে না। গতকাল বিকেলে সে এলাকার নাম করা কবিরাজ বিমলা বালার কাছ থেকে এক হাজার টাকায় নিয়ে এসেছে অচেনা গাছের শিকড়। বিমলা কবিরাজ গর্ভপাতের কাজ নিজের হাতে করে না, কেবল গাছের শিকড় আর ব্যবহারের কৌশল শিখিয়ে দেয়। শতভাগ অব্যর্থ এই কাজে বিমলা, তবে তিন মাস পার হলে সে কোন রিস্ক নেয় না। পরীবানুর মেয়ে আফিয়া ঠিক মত হিসাব না রাখায় বিমলা কাজটা করতে চায়নি। পরীবানু তার দুটো পা চেপে ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় জননীর মত কেঁদে বলেছে,
-দিদি গো, আমার মাইয়াডার জীবন বাঁচান! তারে এখনো বিবাহ দিতে পারি নাই। সমাজ আমারে ভিটা ছাড়া করবে। আমার সন্তানরে সর্বনাশের হাত থাইকা রক্ষা করেন!
-অবিবাহিত মাইয়ার জন্য রেট বেশী। কত আনছো?
-এক হাজার ট্যাকা ধার কইরা আনছি, দিদি।
-হাসাইলা, পরী! বিমলা তো পানিতে পড়ে নাই। দুই হাজারের কমে না। কত মাস?
-মাইয়া সঠিক বলতে পারে না। আন্দাজ চার মাস।
-আন্দাজের কাম আমি করি না। সঠিক হিসাব দেও। তিন মাসের উপরের কেস আমি নিই না। বহুত রিস্ক!
-হায়াৎ, মউত আল্লাহর হাতে। আপনে শুধু দয়া করেন গো দিদি! দরকার হইলে সামনের মাসে বাকী ট্যাকা দিয়া দিমু নে।
পরীবানু গাছের শিকড় শাড়ীর আঁচলের তলে নিয়ে ঘরে ফেরে। মেয়েকে কাছে বসিয়ে শেখায় কিভাবে গাছের শিকড় জরায়ুর মুখের কাছে নিয়ে আঘাত করতে হবে। ছিড়ে ফেলতে হবে অনাকাংখিত পাপের জমাট রক্তকে!
মেয়ে আফিয়া পারে না। কেঁদে ওঠে কাতর স্বরে।
-মা গো, ভয় করে!
পরীবানুর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। শংকিত বুকে কাঁপন ধরে। কলিজার ধন আমার! তোমার কঁচি শরীরে হায়েনার ছোবল! আমি আর কীইবা করতে পারি! মাগরিবের নামাজ শেষে চোখ মুছে পরীবানু ঘরের দরজাটা বন্ধ করে। তের বছরের ছেলে মুরাদকে বলে, উঠানে মাদুর পেতে কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসতে। কেউ আসলে যেন বলে, মা বাড়ীতে নেই।
পরীবানু কাজে হাত দেয়। মেয়ে গোঙানীর সাথে চিৎকার করে ওঠে,
-মা গো, কি করলা? আমি যে মরে গেলাম রে মা!!
তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে যায় সতের বছরের অপুষ্ট শরীর। মাথার কাছে মা কেবল পাথরের মত বসে থাকে। তারপর শুরু হয় তাজা রক্তের স্রোত! মায়ের বুকে ভর করে আতংক! চোখের পানি শুকিয়ে যায়। রক্তের ধারায় বাঁধ দিতে ছিড়ে ফেলে বাঁশের আড়াই রাখা পরনের শাড়ী।
রাতভর চলে অবিরাম ক্ষরন। মেয়ের মুখে কেবল গোঙানীর শব্দ। ছোট চামচে করে সন্তানের মুখে পানি দেয় মা। বুঝে যায় সব শেষ হতে যাচ্ছে! উঠোনের মাদুরে কুপির আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে যায় অভুক্ত কিশোর। সে জানে না ঘরের ভিতরে মৃত্যুদূত্যের অপেক্ষায় পাথর হয়ে যাওয়া এক বিধবা মা বসে আছে নাড়ী ছেড়া ধনের মাথার কাছে।কষ্টের রাত এতো দীর্ঘ কেন হয়!
ফজরের আযান পড়লে পরীবানু ভাবে, অন্ধকার থাকতে থাকতে কফিলের ভ্যানে মেয়েকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাবে। জানুক সবাই তার মেয়ের গর্ভপাতের কথা। সন্তানের জীবনের চেয়ে মূল্যবান তো আর কিছু না।
এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে আফিয়ার শরীরটা কেঁপে ওঠে। পরীবানু মেয়ের বুকের কাছে কান পাতে।
-আম্মা, কথা কও! কথা কও, ময়না পাখি আমার! আমারে মাফ করছো তুমি? আমারে মাফ করো, আম্মা!
ভোরের আকাশে তখনও সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েনি, আকাশ বাতাস ভেদ করে ছড়িয়ে পড়েছে সদ্য সন্তান হারা মায়ের আহাজারী। দলে দলে মানুষ আসে দেখতে। তাদের ফিসফিস আলাপনে রহস্য তৈরী হয় এক কিশোর ভাইয়ের মনে।
মেম্বার সিরাজুল হক পানের পিক ফেলে চেয়ারম্যান সাহেব আর মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে আলাপ করে।
-এই লাশ নাযায়েজ! আমাদের গ্রামের মাটিতে লাশ দাফন করা হইলে আমরা সক্কলে জাহান্নামী হবো। আপনে কি বলেন, ইমাম সাহেব।
ইমাম সাহেব দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-কথা সত্য। তার চাইতে বড় সত্য হইলো, এই পরিবার যতদিন আমাদের গ্রামে বসত করবে, ততদিন রহমতের বাতাস আমাদের গ্রামের উপর বইবে না। পোলা-মাইয়ারা অবৈধ কামে জড়ায়ে যাবে, ঘরে ঘরে অভাব, অনটন, অশান্তি লাইগা থাকবে।
মেয়ের লাশ সামনে নিয়ে পরীবানু বসে আছে। বেলা পড়ে আসছে, লাশ এখনো গোসল করানো হয়নি। গ্রামবাসী একজোট হয়ে গেছে। এ লাশ যদি কেউ ধরে সেও হবে জাহান্নামী।
মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে পরীবানুর বড়ভাই চলে আসেন। চোখের পানি মুছে, রিক্সাভ্যানে লাশ উঠান তিনি, যে ভ্যান নিজেই চালিয়ে এসেছেন। কিশোর মুরাদ বোনের পায়ের দিকে বসে। বাঁশের খুঁটিতে মাথা হেলান দেয়া পরীবানুর আর কান্নার শক্তি নেই। বড় ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
-ভাইজান, আমার সন্তানরে হাল্কা গরম পানিতে সাবান দিয়া গোসল করাইয়া, আদর কইরা মাটিতে শুয়াইবা। বর্ষাকালে একখান বকুলের চারা লাগাইয়া দিও মাথার কাছে। মা আমার বকুল ফুল পছন্দ করতো খুব।
মুরাদকে পারলে আর কয় ক্লাশ পড়াইয়ো, তারপর ঢাকায় গিয়া কাজ খুঁইজা নেবে।
-মা গো, তুমিও আমাদের সাথে চলো। গ্রামের মানুষ তো আমাদের এইখানে থাকতে দেবে না!
-না রে, বাপ। আমারে গুছাইতে হবে। তুমি মামার সাথে যাও। আমি কাল সকাল হবার আগে রওনা দেবো। আর যদি কোনদিন মায়ের দেখা না পাও, কাইন্দো না মানিক আমার! মা তো কারো চিরকাল থাকে না!
এলাকার নাম করা কসাই রুস্তমের স্ত্রী পরীবানু। হঠাৎ করেই রুস্তম মারা গেল, চার বছর চলছে। তারপর জীবনের সাথে সংগ্রাম দুটো সন্তান নিয়ে। নিজে একটা চালের আড়তে কাজ করে। অভুক্ত, অপুষ্ট মেয়েটাকে দিয়েছিল মেম্বারের বউয়ের হাতের কাজ করার জন্য। মেয়েটা ঐ বাড়িতে কাজে যেতে চায়তো না, পরীবানু বলতো, কাজ না করলে পেটের ভাত আসবে ক্যামনে? ছেলেটাকে এস.এস.সি পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছে ছিল। গতমাসে পরীবানু লক্ষ্য করে মেয়ের শরীর। অনেক কথার পর জানতে পারে, মেম্বার স্বয়ং কন্যাতুল্য আফিয়ার কত বড় সর্বনাশ করে ফেলেছে! পরীবানু ছুটে যায়, মেম্বারের স্ত্রীর কাছে। এক হাজার টাকা পরীর হাতে তুলে দিয়ে বিমলা কবিরাজের সন্ধান জানিয়ে দায়মুক্তো হয় মেম্বার পত্নী। গরীবের কান্না কেউ শুনবে না, তাই পরীবানুও চুপচাপ ফয়সলা করতে চেয়েছিল।
ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে আসছে। রুস্তম কসাইয়ের মাংস কাটা সবচেয়ে বড় চাকুটা শান দেয় পরীবানু। অভুক্ত তার শরীরে এখন পশুর শক্তি! ভাঙ্গা ঘরের কপাট তুলে বেরিয়ে পড়ে সে। চাকুটা আঁচলের তলে। মেম্বার বাড়ির পেছনের প্রাচীরটা বেশ নীচু।পরী সেই প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়ে। টিউবয়েলের কাছে যে গোসলখানা, সেখানে ঢুকে অপেক্ষা করে। এই টিউবয়েলের কাছেই উঁচু সিমেন্টের পাটাতনে বসে ওযু করে মেম্বার সিরাজুল হক।
শুধু একটা কোপ! মেম্বারের মাথা কাত হয়ে পড়ে বাম দিকে। তারপর বিশাল দেহটা এলিয়ে যায় কলতলায়। গোঙানীর শব্দটা ক্ষীন হওয়ায় ঘর পর্যন্ত পৌছায় না।
পরী যে পথে এসেছিল, সে পথেই বেরিয়ে যায়। হাতের চাকুটা পাশের ডোবায় ফেলে দেয়। আঁচলে বাঁধা তিনশো পঞ্চাশ টাকা সম্বল তার। যে মাটিতে তার সন্তান ঘুমাতে পারেনি, সে মাটিতে দাড়াতে তার ঘেন্না হয়! পরী দ্রুত পা চালায়। গন্তব্য অজানা। জীবন কোথায় যেয়ে ঠেকবে তাও অজানা!
——————
Views: 216