আমি তখন রাজশাহী কলেজে পড়ি। রাজশাহী কলেজে অধিকাংশ বিল্ডিং ব্রিটিশ আমলে বিশেষ ধাঁচে তৈরি। ঐ প্যাটার্নের বিল্ডিং দেখলেই মনে হয় রাজ প্রাসাদ। কলেজের প্রিন্সিপালের জন্য তৈরি ভবনটাও রাজ প্রাসাদের মতই।
আমার ডিপার্টমেন্টের স্যার প্রিন্সিপাল হয়ে আসায় এবং তার সাথে একটা ভালো গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক থাকায়, মাঝে মাঝেই সে ভবনে যেতাম। ড্রইং রুমের বিশালতার মাঝে যেটা আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভূত লাগতো তা হলো, দেয়াল কেটে ছোট্ট একটি ঘরের মত তৈরি করা জায়গা।
আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। স্যার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, শীতের দিনে ঐ জায়গাটায় আগুন জ্বালিয়ে ঘরকে গরম রাখার জন্য এই ব্যবস্থা। হাল আমলে রুম হিটারের কল্যাণে এই ডিজাইনটি লোপ পেয়েছে। এই যে পুরু ছাদ, মোটা মোটা দেয়াল দিয়ে তৈরি হওয়া এ বাড়িগুলোকে “গথিক বাড়ি” বলে বোধ হয়।
যাহোক, ঐতিহ্যবাহী সেই ভবনের ভেতরে স্যার একটা অবাক কান্ড করে ফেললেন। দেয়াল ঘেরা ভবনের পাশে একটা গোয়ালঘর বানিয়ে নিলেন। সেখানে গোটা চারেক গরু পোষা শুরু করলে, আমরা সেটা নিয়ে আড়ালে আবডালে কম হাস্যরস করিনি।
স্যার আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ। আহমদ ছফার “গাভী বিত্তান্ত” পড়তে গিয়ে সারাক্ষণই স্যারের কথা মনে হয়েছে। রসায়নের অধ্যাপক আবু জুনায়েদও একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে যান। বন্ধু এবং শত্রুহীন এই অধ্যাপকের উপাচার্য হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হলো, অন্য দুই প্রার্থীর মতো তিনি সরকারবিরোধী নন। বন্ধুও নন যদিও।
উপাচার্য মহাশয়ও তার ভবনের পেছনদিকে একটি গোয়াল নির্মাণ করান। ঠিকাদার তবারক আলীর সহায়তায় পাওয়া গরুটাকে তিনি ভালবাসা আর মমতায় আপন করে নেন। স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর কষ্টদায়ক আচরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, খুনোখুনি, লাল-হলুদ-ডোরাকাটা দলের কূটকৌশল আর হাজারো ঝামেলার মাঝে তার একমাত্র ভালো লাগার জায়গা হয়ে উঠে তার গোয়াল ঘরটি। এক সময় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসও হয়ে উঠে এই গোয়ালঘর।
জনাথন সুইফটস্ এর “গালিভার্স ট্রাভেলস” এর বুক ফোর শেষে আমরা দেখি, গালিভার মনুষ্য সমাজ ছেড়ে, দুটো ঘোড়া কিনে, তাদের সাথে আস্তাবলে থাকা শুরু করে। মানুষের চেয়ে ঘোড়াকেই তার আপন মনে হয়। সে ভাবে মানুষের চেয়ে পশু উত্তম।
“গালিভার্স ট্রাভেলস” বিশ্বের সেরা স্যাটায়ার গ্রন্থ। আহমদ ছফার আবু জুনায়েদও বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদেরকে গোয়াল ঘরে ঢুকিয়ে ছেড়েছেন। এটাও কি বিরাট স্যাটায়ার নয়! রাষ্ট্রদূত যখন আবু জুনায়েদকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং গাভী এক সাথে মেইনটেইন করেন তখন সত্যিই চমকে উঠেছিলাম।
ভালো বইয়ের মজা হলো এর সার্বজনীনতা এবং সর্বকালীন সময়োপযোগিতা। “গাভী বিত্তান্ত” পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এই আজকের ঘটনাকে নিয়ে লেখা হয়েছে বইটি। সরকারী এবং বিরোধীদলের রাজনীতি, শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতি, ঠিকাদার, ঘুষ, দূর্নীতি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এতো চমৎকার এবং সাবলীলভাবে উঠে এসেছে যে, পাঠক মুগ্ধ হয়ে যাবেন পড়ার সময়।
উপন্যাসটি শেষ করে আমার প্রিয় সেই স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে। তাকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এই উপন্যাসটি পড়েই তিনি অধ্যক্ষ ভবনে গরু পুষেছিলেন কিনা।
বইয়ের নাম- গাভী বিত্তান্ত
লেখক- আহমদ ছফা
প্রচ্ছদ – আনোয়ার ফারুক
প্রকাশনী- হাওলাদার প্রকাশনী
লিখিত মূল্য- ২৫০ টাকা
Views: 119