তখন আমার বড় আপা মনোবিজ্ঞানে পড়তেন। প্রায় দিনই আমাদের কাজিনসহ মোটামুটি কুড়ি-পঁচিশ জনকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন রকম খেলা খেলতেন। কেন খেলতেন সেসব বিষয়গুলো এখন আর তত মনে নেই কিন্তু খেলাগুলোর কথা মনে আছে। একটার কথা বলি।
আমাদের পঁচিশ জনকে তিনি একটি বৃত্তের মত করে দাঁড় করালেন। তারপর একজনের কানে কানে একটা গল্প বললেন। গল্প শেষ হলে যাকে গল্পটি বললেন, তার পাশের জনের কানে কানে বলতে বললেন। সে আবার তার পাশের জনের কানে, তারপরের জন তার পাশের জনের কানে করে বলতে বলতে পঁচিশ নম্বর জনকে বললেন, প্রকাশ্যে সবাইকে শুনিয়ে বলতে। পঁচিশতম জন যেটা বললো, তার সাথে বড় আপার গল্পের খুব কমই মিল থাকতো। পরিবর্তন হতে হতে তিল কখনো তাল হয়ে যেত আবার তাল হয়ে যেত তিল।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই খেলাটিকে কি বলে সেটা বলার উদ্দেশ্য আমার নয়। আমি এই খেলাটি থেকে শিখেছিলাম, যে কোন বিষয় জানতে হলে যতটা সম্ভব ভেতরে যেতে হবে, ঘটনার কাছাকাছি যেতে হবে।
বাংলাদেশী বাঙালীদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীনতা। একইভাবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়ও হলো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিক এবং গ্রহণযোগ্যভাবে সামনে না থাকা। যতদিন গেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। কারা করেছে, কেন করেছে সেটা না হয় থাক। আমার মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বেশি বিকৃত করা হয়েছে। এখনও তার ধারাবাহিকতা চলছে।
যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই যারা এ বিষয়ে বই লিখেছেন তাদেরগুলো অনেকাংশে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে আমার মনে হয়।
শওকত ওসমানের লেখার হাত যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। তার লেখা উপন্যাস, “জাহান্নম হইতে বিদায়” আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য একটি দলিল বলে মনে হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয় নভেম্বর-১৯৭১ -এ। তখনও যদ্ধ শেষ হয়নি।
পাকিস্তানী বাহিনীর যে বর্বরতা বইটিতে ফুটে উঠেছে তা আমাদেরকে একদিকে যেমন অশ্রুসিক্ত করে তেমনিভাবে দেশের প্রতি কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধও করে।
বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষ করে গাজী রহমান বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বয়স তাকে অস্ত্র ধরে যদ্ধ করবার মত শক্তি দেয় না। কিন্তু তবুও সে দাগী আসামী। তার স্কুলেই সংগঠিত হতো স্বাধীনতার নানা কর্মকৌশল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শ্যেন দৃষ্টিকে এড়িয়ে সে আত্নগোপন করে তারই এক সাবেক ছাত্র ইউসুফের বাসায়। ইউসুফের স্ত্রী সখিনাকে তিনি কন্যাসম ভাবলেও তার কাছেই তাকে মিথ্যা বলতে হয়, যা তার স্বভাবসিদ্ধ নয়।
সখিনার মা-বাবা হারানো একমাত্র ভাই, ঢাকায় পড়ে। সখিনা আর ইউসুফই অনেক কষ্টে এতদিন তার পড়ার খরচ চালিয়ে আসছিলো। আজ একমাস হলো তার খোঁজ নেই। তারা অবিরত কান্নায় বাড়িটাকে মরার বাড়িতে পরিণত করে রেখেছে। গাজী রহমান সখিনার ভাই খালেদের মৃত্যুর কথা জানতেন। তার বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে এসেছে খুব বিশ্বস্ত একজন সংবাদদাতা। তবু সখিনাকে মিথ্যা প্রবোধ দেয় গাজী রহমান। বলে তার কাছে স্পষ্ট খবর আছে, খালেদ বেঁচে আছে এবং সে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছে। মিথ্যা সান্ত্বনা পায় সখিনা।
ছাত্রের বাড়িও তার জন্যে নিরাপদ নয়। শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে গাজী রহমান পৌঁছে যায় বন্ধু রেজা আলির বাড়ি। সেখানেই সে পেয়ে যায় আরেক বন্ধু কিরণ রায়কে। সেও বয়ো:বৃদ্ধ। তাকেও খুঁজছে মিলিটারি। সেখানেই কর্মপন্থা ঠিক হয়। গাজী রহমানকে বর্ডারের দিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেসব এলাকায় গিয়ে মুক্তিফৌজের মধ্যে বক্তৃতা করে তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। অপরিচিত পথ প্রদর্শক সৈয়দ আলীর সাথে সে পৌঁছে যায় বর্ডারে । সেখানে গিয়ে সে সৈয়দ আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে তার পরিচয়। সৈয়দ আলী বলে-
”গোলামের কোন পরিচয় থাকে না, স্যার। গোলাম গোলামই। স্বাধীন বাংলাদেশেই হবে আমার পরিচয়।”
বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গাজী রহমান বর্ডারে পৌঁছে। রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে। ছোট ছোট বাচ্চাদের লাশের চোখ উপড়ে খেতে দেখে কাক শকুনকে। পোড়া ঘর দেখে, ধর্ষিতার লাশ দেখে। বার বার নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে, বেঁচে থেকে কি লাভ! তবু মৃত্যু তাকে তাড়া করে বেড়ায়। পাকিস্তানী বাহিনীও তাকে তাড়া করে মৃত্যুর মতই। গাজী রহমান অপমৃত্যুকে ভয় পায় না। তার মন বলে-
” অপমৃত্যুর ভয় না-থাকা হয় দুঃসাহস, নচেৎ মূর্খতা। সংসারের বিনা কাজে হঠাৎ জন্তুর মত আয়ু খোয়ানো কারো অভিপ্রেত নয়। একবারই যখন বাঁচা, তার সমাপ্তি অর্থবহ হওয়া উচিত।”
একবার হাঁটের কাছে কিছু তরুণ আর কিছু প্রৌঢ়কে আটক করে পাকিস্তানী বাহিনী। তারা তাদেরকে দিয়ে খালি বাজারের দোকান পাট লুট করাতে চায়। পাঁচজন তরুণ লুট করতে অস্বীকার করে। তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। অন্যদের দিয়ে লুট করানোর সময় তারা ভিডিও করে। প্রৌঢ়রা বুঝতে পারেনা, কেন তাদের লুট করার দৃশ্য ভিডিও করা হলো। গাজী রহমান নৌকার সহযাত্রী তরুণের মতই বোঝে এসব দৃশ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে, পূর্বপাকিস্তানীদের লুটেরা সাজাতে।
ভিডিও দৃশ্য ধারণ কিংবা মিথ্যা প্রচার এখনও সারা বিশ্বের সমস্ত ক্ষমতাবানরা ব্যবহার করছে। নিপীড়িত মানুষের উপর পরিচালিত নিপীড়নকে বৈধ করতে এখনও মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আজো দেশে দেশে যুদ্ধকে বৈধ করতে মিডিয়ার অপব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে শওকত ওসমানের “জাহান্নম হইতে বিদায়” আজও সমান আবেদনময়ী হয়ে বিরাজ করছে আমাদের সাহিত্য ভান্ডারে।
নিজের মাতৃভূমিকে তাদেরই কাছে কিভাবে জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছিল পাকিস্তানী বাহিনী, সেটা জানার জন্যে এই বই পড়া আবশ্যক। যারা নিজেদের শেকড় চিনতে চান, তাদের জন্যেও বইটি জরুরী।
বইয়ের নাম- জাহান্নম হইতে বিদায়
বইয়ের ধরণ- উপন্যাস
লেখক- শওকত ওসমান
বর্তমান প্রকাশক- সময় প্রকাশন
প্রচ্ছদ- নওসাবা ডালিয়া
মূল্য- এক শত টাকা মাত্র
Views: 212