“সাগর” এবার ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তার বাবা সাগরে থাকে। জাহাজ চালায়। ছুটিতে এসেছিল। প্রথম সন্তানের বিশাল ফলাফলে মহাখুশি। তার ছেলে ডাক্তার হবে। পুরো গ্রামের লোককে মিষ্টিমুখ করিয়েছে। একদিন তার জাহাজে ফিরে যাওয়ার দিন আসে।
বাবাকে বিদায় দিতে সঙ্গে আসে ছেলে “সাগর”। তাদের গ্রাম থেকে শহরে যেতে হলে একটা ছোট্ট নদী পার হতে হয়। সবসময় নৌকা পারাপারের জন্য খেয়া থাকেই ঘাটে। নদীর ঘাট পর্যন্ত এসে ” সাগর” বাবাকে বিদায় জানিয়ে নৌকার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে ঘাটে দাঁড়িয়েই। একটা মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজ শুনলো সাগর। একটু সরে দাঁড়ান, নৌকায় উঠবো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একদল স্কুল ড্রেস পরিহিত মেয়েরা। কথা না বলে সরে দাঁড়ালো। খলখল হাসির শব্দ তুলে নৌকোয় গিয়ে উঠলো সেই স্কুলে পড়ুয়া মেয়ে গুলো। সামনে দুই বেণী ঝুলানো, সুনয়না মেয়েটি বুঝি তাকে বলেছিলো সরে দাঁড়াতে। তাকিয়ে থাকে সেই নৌকোর দিকে। মেয়ে গুলো বড্ড চঞ্চল মনে হলো, যেন চপলা হরিণী। কি নাম তার? কোথায় তার ঘর? সম্বিৎ ফিরে এলো, সাগরের মনে হলো এত সব ভাবছি কেন? হঠাৎ চকিত দেখা, মন কেন হলো মনহারা?
বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো। সাগর সাগরের মতোই বিশাল হৃদয়ের একটা ছেলে। তবে উত্তাল সাগর নয় শান্ত সাগর। বাবা-মায়ের ভালো ছেলে। লেখাপড়া নিয়েই থাকে। বালিকা বিদ্যালয় ওদের স্কুলের কাছাকাছি। তবুও কখনো এমন করে মেয়েদের দিকে খেয়াল করেনি। আজ যে কি হলো, চোখ থেকে সেই চোখ এক তিলও সরছে না, আর মন থেকে সরালেও মনের কার্ণিশ ধরে যেন ঝুলছে নয়ন দুটি । কী যন্ত্রণায় পড়লাম। সেই মেয়েটি কি আমায় নিয়ে ভাবছে? মা ডাকছে, নিশ্চয়ই বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে। পরে ফোনে কথা হলো কি না। হায় আল্লাহ আমি তো ফোন সাইল্যান্ট করে রেখেছি। নিশ্চয়ই বাবা ফোন দিয়েছিলো। সাগর ফোন বের করে দেখে পাঁচটা মিসড্ কল। চটজলদি ফোন করে বাবার সাথে কথা বলে নিলো সে। বাবা ঠিকমত পৌঁছে গিয়েছে।
ভাত খেতে বসে সাগরের মা জিজ্ঞেস করে তার বাবার কথা। অল্প কথায় উত্তর দিয়ে ঘরে যায়। সাগরের মা একটু তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে। ভেবে নেয় আজ তার বাপে গেছে তো.. মনটা খারাপ ছেলের।
সাগর আবার নদীর পাড়ে যায় বিকেলে। একা একা বসে থাকে নদীর পাড়ে পাকুড়ের গাছটার ছায়ে। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। রাতেও যেন ঘুম আসছে না। বার বার হাসির শব্দ শুনছে। ভাবলো আগামীকাল একবার দুপুরে যাবো নদীর পাড়ে যখন স্কুল ছুটি হয়। পরেরদিন তাই করলো সাগর। সেই চঞ্চল হরিণীর দেখাও পেলো। চট করে ঘাটের সামনে দাঁড়ালো। মেয়েরা বলে উঠলো, আরেহ্ আজও। নৌকায় উঠবো যে। এবার সাগর ঠিক দেখে নেয় আওয়াজটি কার। ও যার কথা ভাবছে সেই লম্বা বেণুনীর চপলা হরিণীর মিষ্টি আওয়াজ। মুখে কিছু না বলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায় সাগর আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই নৌকায়। মেয়েটিও একপলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেন তাকালো না, সাগরের অশ্বস্তি লাগে। বাড়ি ফিরে যায়। ভাবতে থাকে মেয়েটি কি ওকে পছন্দ করেনি?
পরেরদিন আবার যায় ঘাটে। কিন্তু ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে না সাগর। গাছের আড়ালে দাঁড়ায়। বালিকার দল এসে ঘাট ফাঁকা পেয়ে দুড়দাড় নৌকায় ওঠে কিন্তু সেই চঞ্চলা হরিণীর চোখ কিছু একটা খুঁজে। সাগর তা দেখে আনন্দে চিৎকার দিতে যেয়েও নিজের কণ্ঠকে শাসন করে। সেদিন আর সাগর দেখা দেয়নি। মনে অনেক আনন্দ নিয়ে আপন মনে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরছিলো। পথে গ্রামের এক দাদার সাথে দেখা। অকারণে হেসে যাচ্ছে দেখে সেই দাদা বলে কি ভাই “সাগর” মনে এত ফূর্তি ক্যান? সাগর বলে আমি “নদী”রে পাইছি দাদা। কী কয় এই পোলা…উঠতি বয়সের পোলাপাইনের মাথাই নষ্ট।
সাগরের যেন রাত কাটে না। সে গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছে। তার নাম আমার জানার দরকার নাই। সে আমার “নদী” বুক ভেজানো “নদী” ভালোবাসার “নদী”। সকাল হলেই ঘড়ি দেখা শুরু করে সাগর । আজ নদীর ঘাটে যেয়ে একটা ডিঙি নৌকা ঠিক করে। ওদের নৌকার পাশে পাশে যাবে।
আজও বালিকার দল দৌড়ে নৌকায় উঠলো। হরিণী চোখ জোড়া খুঁজলো। পরে নৌকা ছাড়ার পরে দেখতে পেলো সাগরকে। হরিণীর চোখে খুশির ঝিলিক। সাগরও যেন ঢেউ খেলো খুশির জোয়ারে। মেয়েটি কাগজের নৌকা বানিয়ে ছুঁড়ে দিলো। ঠিক ধরে ফেলে “সাগর”। খুলে দেখে সেদিন এলেন না কেন? আর এখন পিছু নিয়েছেন? সাগর পড়ে হাসতে থাকে আর হাত করজোড়ে ক্ষমা চায়। আবার একটা কাগজের নৌকা ছুঁড়ে দেয়। নৌকা খুলে দেখে, মনখারাপ হয়ে যায়। মাঝিকে বলে নৌকা ঘুরাও। তাকে যেতে নিষেধ করলো কেন?
ওদিকে খলখল করে হাসছে “নদী” সাগরের ফিরে যাওয়া দেখে। পরদিন আবার যায়। কিছু দূর গেলেই ফিরতে বলে। সাগর সুবোধ বালকের মতো ফিরে আসে। আর চঞ্চলা হরিণী হাসতে থাকে। একদিনও ওপারে যাওয়া হচ্ছে না। কোন গ্রামে তার বসবাস জানা হলো না। এমনকি নামটাও “নদী”ই থেকে গেলো। ও জেনেছে আমি ওকে “নদী” বলি আর আমার নাম “সাগর”। সে বলে এটাই তো ভালো হলো সাগর আর নদী। তবে একদিন কাগজের নৌকায় লিখে ছুঁড়ে দিয়েছিলো আমি তো ছোট্ট নদী, সাগরে মিলবো কী করে?
তারপর কয়েকদিন ঘাটে যেয়ে সাগর দেখতে পায় না বালিকার দলকে। মাঝি ভাই বললো, অহন তো স্কুল বন্ধ। স্কুলে যেয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে স্কুল কবে খুলবে? দারোয়ান জানালো তা বলতে পারছে না। সরকার থেকে নির্দেশ আসছে ভাইরাস না যাওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ। সাগর যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। ওরও তো সব আটকে আছে অদৃশ্য শত্রুর শত্রুতায়। সাগর ভাবলো, নদীর তো আসল নাম জানি না। স্কুলে খোঁজ নেবো কি করে? নাহ্ এভাবে হবে না। নিশ্চয়ই ঘাটের মাঝি চাচা জানবে ওদের গ্রাম । মাঝির কাছে পরেরদিন এলো। মাঝি চাচার শরীর খারাপ। সে আসেনি তবে তার ছেলে এসেছে ঘাটে। সে বলতে পারে না। সেই মাঝির ছেলে বললো আগামীকাল তার বাপের কাছে জেনে আসবে তাদের কোন ঘাটে নামাতো।
সারাদিন সারারাত চিন্তায় ঘুম এলো না সাগরের। পরেরদিন সকালেই ঘাটে গেলো। মাঝির ছেলেকে নিয়ে নদীর গ্রাম খুঁজতে গেলো। মাঝির ছেলে বললো এভাবে কি পাবেন খুঁইজ্যা? আমার বাপে তো তাদের ঘাটে নামাই দিসে গ্রামের নাম জানে না। সাগর ভাবলো একমিনিট, তাই তো। তার শরীর দরদর করে ঘামছে। কী ভাবে খুঁজে পাবে তাকে কী ভাবে?? ঐ ঘাটে যেয়ে দাঁড়াতে দু’জন লোক উঠলো। করোনা নিয়ে কথা বলছে। সেই গ্রামে এক বয়স্ক মহিলা করোনায় মারা গেছে। তার পরিবারকে একঘরে করে রেখেছে মানে লক ডাউন । তাদের জিজ্ঞেস করতে চাইলো কিছু কিন্তু কি জিজ্ঞেস করবে সাগর ভেবে পেলো না। নৌকায় আবার উঠলো। ঐ দুই লোকের গল্প শুনছে চুপ করে। কানে এলো বুড়ি তো গেলো এখন নাতনিরও অবস্থা খারাপ, বাঁচবে না মনে হয়। হঠাৎ সাগরের কেন জানি মনে হলো নাতনি বুঝি তার “নদী”। জিজ্ঞেস করলো তার নাতনি কি ফুলতলি গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তো? হ্যাঁ পড়তো, দশম শ্রেণিতে। ছাত্রী ভালো নাদিরা। সাগর বললো, নাদিরা?
হ্যাঁ, নাদিরা। মেয়েটার মা নেই। বাবা আর দাদি ছিলো। দাদি চলে গেলো, মেয়েটা দাদিকে দেখা শোনা করেছে। এ এমন এক ভাইরাস তিনদিনেই মানুষ গুলান নাই হয়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হয়। সাগর বাঁধা দিয়ে বলে, এই ভাইরাসে বয়স্করা বিপদজনক অবস্থায় আছে। যাদের বয়স কম তাদের তেমন ভয় নাই।
বাড়িতে ফিরে সাগর। সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার। তার বাবার খবর নেয়, ভালো আছে। তবে এখন অনেকদিন আসতে পারবে না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। মহামারী যেন জেঁকে বসেছে। ঘাটেও লোকজন কম। একটা নৌকা পারাপারের কাজে থাকে। আগে বাড়ি থেকে বের হলে মা কিছুই জিজ্ঞেস করতো না। এখন সারাক্ষণ বলে, বাইরে যাস্ না বাবা। নাহ্ আগামীকাল নদীদের গ্রাম খুঁজে বের করবো। ওর আসল নাম নাদিরা মনে হয়। একদিন কাগজের নৌকায় লিখেছিল “নদী” নামটা ভুল না, আমার নামের দু’টো অক্ষর “নদী”তে আছে।
“নাদিরা” নামেই তাকে খুঁজবো। পরেরদিন আবার গেলো সেই ঘাটে। নামতেই এক লোককে কাঁদতে দেখে ঘাটের অদূরে। দূরত্ব বজায় রেখেই জানতে চাইলো সাগর, কেন কাঁদছেন আপনি? কোন উত্তর নেই। একটু পরেই দু’টো মেয়ে এলো, মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। সাগর চিনতে পারেনি ওদের, কিন্তু ওরা ঠিকই চিনেছে। বললো, সাগর ভাইয়া, হুহু করে কেঁদে ফেললো। সাগর অবাক হয়ে তাকালো মেয়ে গুলোর দিকে। ওরা আমার নাম জানে কি করে? তোমরা কে? তোমরা কিভাবে আমাকে চেনো?
ওরা বললো, স্কুলে যাওয়া আসার সময় আপনাকে দেখেছি। আর নাদিরা আমাদের ভালো বন্ধু। ও চলে যাওয়ার আগে আপনার কথা বলেছে, বলেই কাঁদতে শুরু করলো।
— কোথায় চলে গেলো? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে? কোথায় নদী? আমার নদী কোথায়??
সেই লোকটি এবার বললো, ওর মা অভিমান করে ওর জন্মের সময় চইল্যা গেছে, ওহন আমার দুই মা আমারে এতিম কইরা চইল্যা গেলো। তারা সবটি অভিমান কইরা গেলো যাক্, আমিও আইতাসি। এই নদীতে আমিও যামু।
সাগর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ধপাস্ করে একটা গাছের গুড়িতে বসে পড়ে। কি বলছেন?
মেয়ে গুলো বলে গ্রামের লোকজন জানাজা ও মাটি দিতে দেয়নি। তাই চাচাজান এই নদীতে নাদিরাকে ভাসায় দিসে।
সাগরের মনে পড়ে গেলো অনেক কথা। ওর পিছু নিলে অভিমান করতো নদী। একদিন কিছু সর্ষে ফুল তোড়া বেঁধে ছুঁড়ে দেয়াতেও ভীষণ অভিমান করেছিলো। কারণ ওর সহপাঠীরা জেনে যাবে। কাগজের নৌকায় লিখেছিলো, সাগর “নদী”কে এই নদীতেই তো পাও, শুধু কেন পিছু নাও? সেই অভিমান গুলো তো আমি মেনে নিয়েছিলাম। আর ফুল ছুঁড়ে দেইনি, পিছুও নেইনি। কোনদিন কাছাকাছি যাইনি, কথাও হয়নি। শুধু ভালোবেসেছি প্রাণভরে নীরবে, জানতাম নদী একদিন সাগরে মিলবে।
টপ, টপ, টপাস করে নোনতা মতো স্বাদ বেদনাহত পাখির অধর গড়ালো, ভেতরটা বলে উঠলো সাগরের কাছে “নদী”র এ কেমন অভিমান?
#শাবানা_ইসলাম_বন্যা
(কবি ও লেখক)
রচনা কাল : ১২ জুলাই ২০২০
Views: 53