জাপানে বাচ্চাদের নামের শেষে চান আর বড়দের সাথে সান যোগ করে ডাকা হয়। সুতরাং তোত্তচান বললে বুঝতেই পারবেন তার নাম আসলে তোত্ত আর চান হচ্ছে তার নামের লেজ।
তোত্তচানকে তার প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অপরাধ গুরুতর। সে ক্লাসে জোরে জোরে ডেস্কের ঢাকনাটি খোলে আর লাগায়। জানালা দিয়ে ফেরিওয়ালাদের ডাকে। তখন ফেরিওয়ালারা নানারকম বাজনা বাজিয়ে গান গাইতো আর তোত্তচান ক্লাসের সব বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে সেটা উপভোগ করতো। অপরাধ আরো আছে, লেখাপড়ায় মনযোগী না হয়ে সে জানালা দিয়ে সোয়ালো পাখির সাথে কথা বলতো।
তোত্তচানের মা কিন্তু বললেন না যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বললেন, “একটা ভালো স্কুল পাওয়া গেছে আমরা তোমাকে সেখানে ভর্তি করার চেষ্টা করবো। যদি তুমি সেখানকার পরীক্ষায় টিকে যাও তাহলে তোমাকে তারা ভর্তি করে নিবে। মায়ের দুশ্চিন্তায় ঘুমই আসলো না সারা রাত, যদি তোত্তচান পরীক্ষায় না টিকে!
নতুন স্কুলের গেটে গিয়েই তোত্তচান সিদ্ধান্ত নেয়, এই স্কুলে তাকে পড়তেই হবে। কী সুন্দর গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি গেট। মোটেও কংক্রীটের নয়। স্কুলে ঢুকে তার চোখ ছানাবড়া। ক্লাসরুম গুলো একবারে অরিজিনাল রেলের বগি। স্টেশন থেকে এতদূর কিভাবে বগিগুলো আনা হলো, তাও একটা বিরাট বিস্ময়। এটা স্কুল নাকি রেল স্টেশন!
ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলো। মাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে প্রধান শিক্ষক তার পরীক্ষা নেওয়া শুরু করবেন। পরীক্ষা শুরুর আগেই তোত্তচান প্রধান শিক্ষককে প্রশ্ন করলো, “ তুমি কি প্রধান শিক্ষক নাকি স্টেশনের লোক?”
তোত্তচান ভেবেছিলো তাকে প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন করবেন আর তাকে তার উত্তর দিতে হবে। ব্যাপার ঘটলো পুরো উল্টো। প্রধান শিক্ষক তাকে বললেন, “বলোতো তোত্তচান, তোমার সম্পর্কে কি কি বলতে চাও?”
তোত্তচান সুযোগ পেয়ে হড়বড়িয়ে কত কথা বললো! তার কুকুর রকির কথা, স্টেশনের টিকেট চেকার তাকে টিকিট দেয়নি সে কথা, সর্দি লাগলে নাক সুড়ুৎ সুড়ুৎ করলে মা রেগে যান সে কথা। আগের স্কুলের কথাও বললো সে। একসময় তার কথা ফুরিয়ে গেল। কথা ফুরিয়ে গেলে, সে জানতে পারলো, সে একটানা চার ঘন্টা কথা বলেছে। এরমধ্যে প্রধান শিক্ষক কোন কথা বলেননি। মন দিয়ে তার কথা শুনেছেন। তোত্তচানের কথা শেষ হলে তিনি বললেন, “আজ থেকে তুমি এই স্কুলের একজন।” তোত্তচান তো অবাক, “এ আবার কেমন পরীক্ষা!”
কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা গেল এই স্কুল একদম অন্যরকম। একটা বড় ডাইনিং রুমে সব বাচ্চারা টিফিনের সময় খেতে বসে। সবার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতে হয়। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ প্রতিদিন “সমুদ্রের কিছু আর পাহাড়ের কিছু খেতে হবে।”
তোত্তচান অবশ্য প্রথমদিন বুঝতে পারলো না সমুদ্রের আর পাহাড়ের বিষয়টা কি। পরে বুঝলো পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত। সমুদ্র থেকে দেখলে বাকি অংশ পাহাড় বা ডাঙা আর ডাঙা থেকে দেখলে বাকিটা সমুদ্র।
টিফিন পিরিয়ডে প্রধান শিক্ষক সব বাচ্চাদের খাবারের প্লেটের সামনে গিয়ে দেখতে লাগলেন তারা কি খাবার এনেছে। সামুদ্রীক মাছ বা শৈবাল সমুদ্রের খাবার। শাক-সব্জি বা লতাগুল্মগুলো পাহাড়ের খাবার। সবাই সাধারণত দুই ধরণের খাবারই আনে । প্রধানশিক্ষকের পেছনে পেছনে তার স্ত্রী গামলা ভর্তি সমু্দ্র আর পাহাড়ের খাবার নিয়ে ঘুরে। কেউ যদি শুধু সমুদ্রের খাবার আনে তখন প্রধান শিক্ষক বলেন, “এই বাবুটিকে পাহাড় থেকে কিছু খাবার দাও।” তখন তার স্ত্রী বাচ্চাটির প্লেটে পাহাড়ের খাবার দেয়। যার প্লেটে সমুদ্রের নেই, তাকে সেভাবেই সমুদ্রের খাবার দেওয়া হয়।
বাচ্চাদের প্রথম ক্লাসে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দেওয়া হয়, আজ কি কি পড়ানো হবে। কোনটা আগে বা কোনটা পরে পড়ানো হবে, তার ধরা বাঁধা কোন নিয়ম নেই। যার যার ইচ্ছে মত আগে পরে পড়তে পারে। কেউ আগে ছবি আঁকে, কেউ অংক করে কেউ বা শুরু করে বিজ্ঞান। দুপুরের মধ্যে যদি সবার পড়া তৈরি হয়ে যায়, তাহলে তাদের হাঁটাহাঁটি ক্লাস শুরু হয়। শিক্ষক তাদের নিয়ে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নদী, মাঠ বা উপসনালয়ে নিয়ে যান বেড়াতে।
তোত্তচানের নতুন স্কুলের নাম তোময়ে স্কুল। সেখানে সবার আগে আত্নবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা হতো। যেমন বেঁটে বলে যে ছেলেটি হীনমনত্যায় ভূগতো। সেই আকিরা তাকাহাশি বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সব খেলায় প্রথম হলো। প্রথম হওয়ার কারণ হলো, তার সাইজেই সব খেলা উদ্ভাবন করা হয়েছিল। সবাইকে দৌঁড় দিতে হবে একটা পাইপের মধ্যে দিয়ে। লম্বা বাচ্চারা তো পাইপের মধ্যে দৌঁড়াতেই পারলো না। বার বার পড়ে যেতে লাগলো আর সেই বেঁটে ছেলেটাই গুটি গুটি পায়ে প্রথম হয়ে গেল। তার আত্নবিশ্বাস বেড়ে গেল। সেই আত্নবিশ্বাসে একদিন বড় হয়ে সে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিগ্রি পেয়ে যায়। এখন সে হামানা হ্রদের পাড়ে এক বিরাট ইলেকট্রনিক্স কোম্পানীতে উচ্চপদে কর্মরত। অথচ স্বয়ং তার মা-বাবারা ছোট আকিরা তাকাহাশিকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
স্কুলের ছুটিতে ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে নদী-পাহাড়ে ক্যাম্পিং, বনভোজন, হাসপাতালে রোগীদের দেখতে যাওয়া, গান গেয়ে গেয়ে খাওয়া, রাতে অন্ধকার গোরস্থানে গিয়ে ভূত ভূত খেলা, ভয় পাওয়া, সব মিলে অসাধারণ একটা স্কুল জীবন।
তেৎসুকো কুরোয়ানাগি জাপানি টেলিভিশনের একটি প্রভাতি অনুষ্ঠান করেন। তার ক্লাস ওয়ানের স্মৃতি নিয়ে তিনি এই বইটি লিখেন। তার সেই অসাধারণ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রধান শিক্ষক সোসাকু কোবাইয়াশি। তিনি গবেষণা করেছেন বাচ্চাদের উপযোগী শিক্ষা নিয়ে। ১৯৪৫ সালের যুদ্ধে মার্কিনিরা জাপানে বোমা ফেললে তোময়ে স্কুল ধ্বংস হয়ে যায়। স্বল্পকালীন সময়ের এই স্কুল একটি আদর্শ স্কুল হতে পারতো। সেজন্যেই তেৎসুকো কুরোয়ানাগি এই বইটি লিখেন।
বইটি প্রকাশের প্রথম বছরই পঁয়তাল্লিশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। বর্তমানে বইটির বিভিন্ন অধ্যায় জাপানে স্কুলের পাঠ্য। সারা বিশ্বে অসংখ্য ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে।
প্রতিটি মা-বাবার বইটি পড়া উচিত। অন্ততঃ তাদের সন্তানদের স্বার্থে।
বইয়ের নাম- “তোত্তচান, জানালার ধারের ছোট্ট মেয়েটি”
লেখক- তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
অনুবাদক- চৈতী রহমান
প্রকাশক- দুন্দুভি
পরিবেশক- দ্যু প্রকাশন
মূল্য-২৫০ টাকা
Views: 126