বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। আর এই বিভিন্নরকম অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু উপলব্ধি করি তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু কথা তুলে ধরছি।
একটা ক্লাসে যদি আটজন বিশেষ শিশু থাকে,তাহলে আটজনের আচরণের ভিন্নতা থাকবে। অর্থাৎ আটজন শিশু আট রকম হবে। কারো বয়স হয়তো নয় বছর আবার কারো চৌদ্দ। তবে এরা একই ক্লাসের স্টুডেন্ট। কারণ তাদের ক্যাটাগরি এক। অর্থাৎ এসব বিশেষ শিশুদের মধ্যে ASD, ADHD, DOWNS, ID, HI, VI, CP শিশু আছে। বিশেষ শিশুদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলে আলাদা ক্লাস দেয়া হয়। চেষ্টা করা হয় একটা ক্লাসে যেন সব শিশু এক ক্যাটাগরির হয়। অনেকে না জেনেই জনসম্মুখে যে কোনো বিশেষ শিশুকে অটিজম বলে ফেলে। অথচ সবাই অটিজম না। এখানে ডাউন্স(DOWNS) অথবা সেলিব্রাল পলসি(CP) শিশুও থাকতে পারে। এটা বিশেষ শিশু সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। গোটা সমাজ এবং পরিবারের এইসব বিশেষ শিশু সম্পর্কে সচেতনতা জরুরী প্রয়োজন।
একজন বিশেষ শিশুর জন্য একজন বিশেষ শিক্ষক প্রয়োজন। যদি তা সম্ভব না হয় তবে দু’জন বিশেষ শিশুর জন্য একজন বিশেষ শিক্ষক দিলেও হয়। যা আসলে বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য সম্ভব হয় না। সেটা হতে পারে জনবল সংকুলানের জন্য, হতে পারে দক্ষতার অভাবের কারণে,হতে পারে এসব শিশুদের নিয়ে কাজ করার অনাগ্রহের জন্য। এই কাজটা পুরোটাই আসলে সেবা। যারা ভালোবেসে এই কাজে আসবেন,তারা তাদের পুরোটাই দেবেন।
বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে অভিভাবকদের মানসিক অবস্থা। বিশেষ শিশুর বাবা মায়েদের মানসিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় থাকে যে তাদের নিজেদের উপর অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এসব শিশুদের বাবা মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিজেদের উপরে বোঝা মনে করেন। আমরা যদি নিজেদের সন্তানদের দ্বারা ভবিষ্যতে আমাদের ভরনপোষণের কথা চিন্তা করি,সেক্ষেত্রে একজন বাবা অথবা মা তার বিশেষ সন্তানকে অবশ্যই তাদের নিজেদের এবং সমাজের বোঝা মনে করবেন। এটা তাদের জন্য একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যারা সন্তানের ভালো চিন্তা করে প্রতিষ্ঠানে দেন, তারা আশা করেন সন্তানটি ভালো হয়ে যাবে। আশা করাটাই স্বাভাবিক। এমন নজির তো অবশ্যই আছে, যে শিশু তার নিজের কাজটুকু করতে পারবে বলে কেউ আশা করেনি। সেই শিশুটি যখন সঠিক যত্ন পেয়েছে তখন শুধু নিজের না সমাজেরও উন্নতি হয়েছে। তবে এর পেছনে তার পরিবারের অক্লান্ত পরিশ্রম আছে। প্রতিষ্ঠান কেবল দিক নির্দেশনা দেবে। বাকি পুরোটাই কিন্তু অভিভাবকদের উপর নির্ভর করে। একজন বিশেষ শিশুকে সমাজের স্বাভাবিক পরিবেশে খাপ খাওয়াতে চাইলে, সেই শিশুর পরিবারের সব সদস্য যেমন বাবা,মা,ভাই,বোন,গৃহপরিচারিকা, দারোয়ান, ড্রাইভার,মালি এমনকি দূরের কাছের আত্মীয় বন্ধু সবাইকে সহনশীল ও পজিটিভ মনোভাব পোষন করতে হবে। একই মনোভাব পোষন করে বিশেষ শিশুটির সাথে আচরণ করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই সব বিশেষ শিশুর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে। যা আমাদের সমাজে এখনো বিরল ঘটনা।
যারা বিশেষ শিশুর বাবা মা হন তাদের অনেক রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। পরিবার,সমাজ,আত্মীয় স্বজন প্রতিনিয়ত তাদের হেয় প্রতিপন্ন করেন। যেন এরকম সন্তান জন্ম দেয়ার পেছনে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ আছে। যেসব শিশুর অটিজম আছে তারা একই আচরণ বার বার করে। কারো কারো কন্ঠ দিয়ে মিনিংলেস শব্দ বের হয়। যে কারণে বাবা, মা সন্তানটিকে বাইরে বের করতে লজ্জা পান। অথচ এসব শিশুকে সব জায়গায় নিতে হবে। বাজারে,খেলার মাঠে,আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি সবখানে নিতে হবে। হয়তো বাবা,মা নিয়েও গেলেন। কিন্তু বাচ্চাটার এই অদ্ভুত আচরণের কারণে আসেপাশের সব মানুষ ঘুরে ঘুরে তাকায় এবং হাসে যা ঐ অভিভাবকের জন্য অনেক সময় লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনেক সময় অনেক অভিভাবক তার শিশুটিকে শুধু প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসেন। আর কোথাও নেন না। অথচ যেসব অভিভাবক সমাজের মানুষের এমন অজ্ঞতা পাত্তা না দিয়ে নিজের গতিতে চলেন,সেই সব অভিভাবক অনেক সময় সফল হন।
একবার এক বিশেষ শিশুর অভিভাবককে বলতে শুনেছি, “কোন পাপের ফল আমি পেয়েছি! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নিজে মরি,আমার সন্তানটাকেও মেরে ফেলি। আর জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য হয় না।” বলেই পরক্ষনে আবার নিজের সেই বিশেষ সন্তানকেই জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন। কিন্তু যতই উনি আদর করুন না কেন, একবার ঘুনাক্ষরে ও টের পেলেন না একটু আগে তার মুখের দুটো কথা দিয়ে তিনি তার আদরের সন্তানের কত বড় একটা ক্ষতি করে ফেললেন।
আমরা ভাবি এই সব শিশুরা কিছু বোঝে না। অথচ এরাই সবচেয়ে বেশি বোঝে। অভিভাবকের মুখের হাসি,অসাধারণ ধৈর্যই পারে বিশেষ শিশুদের কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলতে। অনেক সময় এই সব শিশু সমাজের অনেক রকম উপকারে আসে। দক্ষ জনশক্তি হিসেবেও কাজে লাগে। আর একজন বিশেষ শিশু যখন সমাজের কোনো একটা সেক্টরে নিজের দক্ষতা প্রমান করতে পারবে,একটা দেশের ও পরিবারের জন্য এরচেয়ে সুখের কথা আর কি হতে পারে। তবে এরজন্য অভিভাবকদের অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে এবং বুকে কষ্ট অথচ মুখে হাসি নিয়ে তার এই শিশুকে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে উপহার মনে করে কাজ করে যেতে হবে।
যদি ধর্মীয় লাইনে কথা বলি,তাহলে বলবো একজন বিশেষ শিশু যেসব পরিবারে আছে সেসব পরিবার আপাত দৃষ্টিতে কষ্টে আছে মনে করলেও আদতে তাদের জন্য এটা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে গুনাহ মাফের একটা কৌশল। এই মানব সন্তানটির পেছনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয় বান্দা অবশ্যই। এই ব্যাপারটা তারাই বুঝবেন,যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আছে।
এই সব শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে বিশেষ শিশুদের বাবা মায়েদের জানা প্রয়োজন অটিজম কি এবং কেন হয়। কি করলে এই সব শিশুদের সমাজের স্বাভাবিক গন্ডিতে ঢোকানো সম্ভব। তাহলে অভিভাবকেরা সময় মতো সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে দিবেন এবং স্পেশাল এডুকেটর ও থেরাপিস্টদের উপর আস্থা রাখতে পারবেন। অনেক পড়ালেখার মাধ্যমে এই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তবেই সন্তানকে বোঝা মনে না করে প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় তৈরি করে তাদের ভালোর পথে,আলোর পথে নিয়ে আসতে পারবেন। তবে এখানে একটা কথা আমি অবশ্যই বলবো যে, বিশেষ শিশুদের সমস্যাই হচ্ছে আচরণ গত সমস্যা। সবার আগে এসব শিশুদের আচরণ ঠিক করে তবেই একাডেমিক দক্ষতায় এগোতে হবে। যেটা সম্পর্কে অভিভাবকেরা এখনো অজ্ঞতায় নিমজ্জিত।
বিশেষ শিশুদের অভিভাবকগন অনেক বেশি সেনসিটিভ হয়ে থাকেন। তার উপর আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদের আরো বেশি সেনসিটিভ করে তোলে। তবে অবিভাবকদের যদি এ সম্পর্কে ধারনা থাকে,তাহলে তারা নিজেরা এসব শিশুদের নিয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন। এবং সমাজের নেগেটিভ পরিবেশকেও সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সমন্বিত কাজের মাধ্যমে একজন অটিস্টিক শিশুকে তার আচরণ গত সমস্যা থেকে বের করে আনা সম্ভব। এবং তাকেও দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তরিত করা সম্ভব। তবে তার আগে চাই বিশেষ শিশুর অভিভাবকদের এই সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং নেগেটিভ মানসিকতা পরিহার করা। এসব শিশু সম্পর্কে সমাজের মানসিকতা বদল হয়তো হবে কোনো এক সময়। কিন্তু তাই বলে তো আমরা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমাদের সন্তানদের কষ্ট দিতে পারি না।
বিশেষ শিশু নিজেরাও জানে না তারা কি করছে। হাসি,কান্না, সুখ,দুঃখ,সমাজে পরিবেশে মেলামেশার নিয়ম,ক্ষুধার প্রকাশ এমন আরো অনেক স্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে এরা অবহিত নয়। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে ধৈর্য্য নিয়ে এসব শিশুকে তাদের আচরণ গত সমস্যা থেকে বের করে আনা। সুস্থ হোক সমাজ ও পরিবেশ।মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হোক। কোমলমতি এসব শিশুদের জন্য নিশ্চিন্ত আবাস গড়ে উঠুক।
সালমা তালুকদার
Views: 85