দ্বিতীয় পর্ব
আমরা বিকেল সোয়া ৫টা নাগাদ পন্চান্ন মিনিটের আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে নেপালের মাটির স্পর্শ পেলাম। বিমান থেকে খুব একটা ভাবসাব নিয়ে নামলাম।
প্রথম আকাশে ওড়া, প্রথম উপর থেকে দেশকে দেখা,প্রথম বিদেশে আসা, সবকিছুতেই ওয়াও টাইপ মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।
নামতেই বড় একটা বাস এসে নিয়ে গেলো ত্রিভুবন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে। ত্রিভুবনের নামে কেন বিমানবন্দর? জানতে পারলাম, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উনাকে সিংহাসনে বসতে হয়েছিল এবং জীবনের শেষ পাঁচ বছর সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল।
উনাকে স্মরনীয় করে রাখতেই তাদের একমাত্র অান্তর্জাতিক বিমানবন্দর টির নাম ‘ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’।
ইমিগ্রেশনে ঢুকেই দেখি দুই লাইনে বিভক্ত। আমি গিয়ে ফরেনার লাইনে দাড়ালাম, জসিম ডমিস্টিক লাইনে।
ওকে ইশারা দিলাম, এখানে আয়।
ও আমাকে বুঝিয়ে দিল, তুমি ত ফরেনার লাইনে দাড়িয়ে আছ। আমি বললাম, আমরা তো এখন ফরেনার ই। ওর মনে পড়ল, ও আমরা ত এখন ফরেনার।
খুবই সহজ ইমিগ্রেশন, বাংলাদেশের জেনে মোটামুটি ভালই ইজ্জত করল, যেটা আমরা “ওমানে” গিয়ে নিগৃহীত হয়েছিলাম, সেই বেইজ্জুতির কাহিনি ওমানের ভ্রমন গল্পে করা যাবে।
জাস্ট এক কপি ছবি নিল।
আর সকল প্রশ্ন ইংরেজীতে, যার বাংলা দাড়ায়ঃ
‘এই প্রথম এসেছেন’?
জি।
‘কতদিন থাকবেন’?
পাঁচদিন।
‘এভারেস্ট ট্রেকিং করবেন’?
জি, না। জাস্ট বেড়াতে আসছি।
‘এক মাসের ভিসা দিয়ে দিলাম’।
ধন্যবাদ।
‘আশা করছি, আবার আমাদের দেশ ভ্রমন করবেন’।
জি, চেষ্টা করব।
নেপালীদের কাছে মা ও মাতৃভুমি স্বর্গের চেয়েও নাকি প্রিয়। এটা জেনে নিজের দেশের কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
পাসপোর্টে ভিসা সীল মারা হয়ে গেল।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই ডলারকে নেপালি রুপিতে পরিবর্তিত করে নিলাম।আমাদের আট হাজার টাকায় ওদের দশ হাজার নেপালী রুপি।
মোবাইল সীম কিনে বাইরে পা রাখতেই টেক্সিওয়ালাদের হাকডাক। গন্তব্য “থামেল”।
‘থামেল’ হল, কাঠমুন্ডু র মধ্যেই শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য একটি খুবই নিরাপদ বিনোদন এলাকা। যেখানে কোন দূর্ঘটনার হার প্রায় শুন্যের কাছাকাছি।
টেক্সি ৭০০-৮০০ রুপি চাচ্ছে। তবে নেপালে ইন্ডিয়ান রুপিও যত্রতত্র হরহামেশা বিনিময় হয়।
জসিম বলল, চল হেটে একটু সামনে গিয়ে টং দোকানের চা খাই, তারপরে ডিসিশন নিব কি করা যায়। কথামত দুজনে প্রায় এক কিলো হেটে গিয়ে অসাধারন এককাপ চা, পেয়াজু টাইপের কি জানি খেলাম, চা টা সত্যিই দারুন ছিল।
নেপালীদের বসবাস শুরু প্রায় নয় হাজার বছর আগে, এদের রাজনীতি বহুদলীয় প্রজাতন্ত্রের কাঠামোতে, তবে ২০০৮সালের ২৮ মে নেপালের আইনসভা, সংবিধানে সংশোধন আনে এবং নেপালকে একটি প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রে রুপান্তরিত করে। কিনতু প্রচলিত আছে, চীন ও ভারতের দয়াপুষ্ট এই নেপাল।
যার ৮০% লোকই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।এদের ভাষা নেপালী। মাত্র ৬০%লোক নেপালী ভাষায় কথা বলে, বাকিরা হিন্দি মিশানো নিজেদের মত করে কথা বলে।কিছুটা হিন্দি ভাষার মত, তবে হিন্দি নয়।
অনেকটা আমার শ্বশুড় বাড়ীর মত, কুমিল্লার মধ্যে চৌদ্দগ্রাম আর নাঙলকোটের ভাষা প্রায় ৭০% ই নোয়াখালির সাথে মিলে যায়। তবে না কুমিল্লার মত, না নোয়াখালির মত।
আমার ছেলে মুগ্ধ বলে, আব্বু, নানুর বাড়ীতে বাংলা ভাষায় কথা বলেনা কেন? তখন আমি চুপ করে ওর মায়ের দিকে তাকাই। নেপালের কোথাও কোথাও এরকম না হিন্দি না নেপালী।
জসিম হিন্দিটা চালিয়ে যাবে আর আমি ইংরেজী।
চা খেতে খেতে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জসিম জেনে নিল, বাসে করে ‘থামেল’ যাওয়া যাবে, দুজনের খরচ পড়বে নব্বই রুপির মত। সাথে সাথে গিয়ে বাসে ওঠে পড়লাম।
সাতশ’ র পরিবর্তে মাত্র নব্বই রুপিতে থামেলের কাছাকাছি নেমে জানতে পারলাম একটু হাটলেই গন্তব্য। দুই ফরেনার(!) হাটছি, পুরান ঢাকার মত গিন্জি এরিয়া, রাত আটটার মধ্যেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, সুনসান নীরবতা, ভয়ে ভয়ে হাটছি আর বলছি, দোস্ত, ঠিক পথে আছি ত? প্রায় দশ মিনিটের পথ পেরিয়ে হোটেল মোটেল সবকিছু জমজমাট দেখে কলিজায় পানি এল।
কয়েকটি হোটেলে কঠিন দরদাম করে এক হাজার একশত রুপিতে রফাদফা হল।
হোটেলে ফ্রেশ হয়ে ম্যানাজারের সাথে আধো ইংরেজী, আধো হিন্দি মিশিয়ে কখনো বোবার মত অভিনয় করে জেনে নিলাম সৌন্দর্য্যের লীলাভুমি ‘পোখারা’য় সহজে কিভাবে যাওয়া যায়। এজন্য তাদের কাছ থেকেই ট্যুরিস্ট বাসে বুকিং দিয়ে দিলাম।
কোনমতে রাতের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পর্যটকদের আকর্ষন ‘থামেল’ এর রুপ দেখতে। পুরো নেপাল যখন ঘুমে, থামেল তখন হৈ চৈ এ মাতোয়ারা। প্রথমবারের মত মিউজিক বার দেখলাম।
লাইভ মিউজিক চলে আর সাথে বিভিন্ন খাদ্য অখাদ্য, যার যেটা পছন্দ, তবে ওখানে বিদেশী পর্যটকের চেয়ে স্হানীয় স্টুডেন্ট রাই বেশি মনে হল। তবে পর্যটকদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ওরা নিশ্চিত করে থাকে। যা আমাদের দেশে বিরল।
ঘুরাঘুরি শেষ করে হোটেলে ফিরেছি, সকাল সাতটায় পোখারার বাস ধরতে হবে।
ভোরে ঘুম থেকেই ওঠেই নামায পড়ে আবার ব্যাগ গোছানো শুরু। টোস্ট, ডিম ভাজা আর চা খেয়েই হ্রদের শহর, সৌন্দর্যময় শহর ‘পোখারা’র উদ্দেশ্যে ট্যুরিস্ট বাসে আমরা দুই বন্ধু……
আপনি নেপাল গিয়েছেন, অথচ পোখারায় যাননি। আপনার নেপাল যাওয়াটাই বৃথা।
লেখক, যমুনা ব্যাংকের কর্মকর্তা।
চলবে…..
Views: 115