নীলগিরি নীলাচলের চূড়ায় বসে মেঘ দেখতে প্রতিবছরের ছুটিতে কিংবা শীতে হাজার হাজার পর্যটক পাড়ি জমায় বান্দরবান। অথবা এ্যাডভেঞ্জার প্রিয়দের পছন্দ বগা লেক কিংবা কেওকারাডং। শহর রাঙ্গামাটির স্থানীয় পর্যটকও কম নয় সে তালিকায়।অথচ ফুরমোন আমরা কজন চিনি?
কজন গেছি?
নাম শুনেছিই বা কদিন হচ্ছে!
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নীলাচলের উচ্চতা প্রায় ১৬০০ ফুট এবং নীলগিরির ২২০০ ফুট হলেও ফুরোমন আছে ২৬০০ ফুট উচ্চতায়।
রাঙ্গামাটির প্রবেশদ্বারেই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে শহরকে বুকে আগলে রেখেছে যে ফুরমোন আমাদের কাছে তার গল্প অজানা। পরিচয়ও।
সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ফুরমোন চূড়ায় রয়েছে বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের প্রতিমূর্তি। যা ১৯৯২ সালে স্থাপিত। লোক কথায় প্রচলিত- বনভান্তে ধ্যান করেছিলেন এই পাহাড়ের চূড়াতেও। এর সাথে রয়েছে বৌদ্ধভান্তেদের ম্যডিটেশন সেন্টারও।
ফুরমোনে উঠার রাস্তা মূলত দুটো। একটি মানিকছড়ি হয়ে কুতুকছড়ি দিয়ে ফুরোমনের পাদদেশ ঘিরে গড়া ইটের রাস্তা। অন্যটি সাপছড়ি দিয়ে একদম পাহাড়ী বন জঙ্গলের রাস্তা। এ্যাডভেঞ্চার যাদের প্রিয় তাদের জন্য দুটো পথই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ দিবে। ইটের রাস্তাটা তুলনামূলক দীর্ঘ এবং সময়টাও বেশি লাগে। তবে অনেকখানি উঠে তারপর হুটহাট চোখের সামনে দু এক পরিবার ছন ছাউনির বাসা কিংবা ষাঠোর্দ্ধ বুড়িমার অবাক চাহনি দেখতে খারাপ লাগবে না। বরং তীব্র ঘাম আর ক্লান্তি ছড়ানো শরীরে প্রশান্তি কাজ করতে পারে এই ভেবে যে, ইনারা হয়তো প্রতিদিন না হোক প্রতি সপ্তাহে হলেও একবার এই পথ ধরেই উঠে নামে। আর আমিতো একবারই!
চুপচাপ শান্ত পরিবেশ ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া পথ ফুরোতেই চায়না। এই পথে তবুও ছুটে চলা। পৌঁছুতে হবেই, ফুরমোন ছুঁতেই হবে। একদিন দুদিন করে জমতে জমতে ভালোবাসাও জমেও গেছে ফুরমোনের সমান। এবারতো ফুরমোনে চড়াই চাই। রোদ বাড়ছে। আকাশে খানিকটা মেঘ ছিল আর খুব ভোরে রওনা দেয়ার কারণে রোদের প্রকোপ কম থাকলেও ভ্যাপসা গরমটা ছিলোই। ঘামে ভিজে একাকার। খুব বেশি পানিও খাওয়া যাচ্ছেনা। যারা নিয়মিত ট্র্যাকিং করেন তারা জানেন ট্র্যাংকিয়ে চট করে বেশি পানি খেয়ে নিলে হাঁটা মুশকিল হয়ে যায়। খুব একটা বিরতি নেইনি। থামলেই বরং ক্লান্ত হবো আর বেশি। এই পথে প্রায় সাড়ে তিনঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেলেও বিরতি নিয়েছি দুবার কেবল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখের সামনে ছোট দোকান। এক দৌঁড়ে দোকানে ঢুকেই ফ্রিজ দেখে মনে হলো মরুভূমিতে যেন এক ফোঁটা জল।
সত্তোর্দ্ধো নীলচন্দ্র দাদু। এই দোকানেই ঘর, এই দোকানেই বাড়ি। আশেপাশে টুকটাক কিছু ঘরবাড়ি আর ম্যাডিটেশন সেন্টারের ভান্তেরাই তার ক্রেতা আর এতেই জীবন। ছোট্ট একটা টিভিও রয়েছে এই দোকানে। সৌরবিদ্যুৎয়েই দাদুর দোকানে এতোকিছু।পাশেই সুউচ্চ সিঁড়িতে চোখ রেখেই টের পেলাম কাঙ্খিত গন্তব্যের খুব কাছাকাছিই আছি আমরা।বৌদ্ধমন্দিরের সিঁড়ি। দাদুর দোকানে বেশ খানিকক্ষন জিরিয়ে নিয়ে আবার পা বাড়ালাম সিঁড়ি ডিঙোতে। সিঁড়ির মাথায় ম্যাডিটেশন সেন্টার বেশ নীরব এই অংশটা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে করা এই সিঁড়ি এগোতে এগোতে চূড়া যেখানে নীরবে ধ্যানমগ্ন সেখানে যেন স্বয়ং বুদ্ধদেব। নিজ হাতে ছুঁয়েও দেখে নেয়া যায়। আর সামনেই মেঘ সবুজের বিন্যাস। এইখান থেকেও ঢের স্পষ্ট পুরো শহর।
এই পাহাড় ছেড়ে আরো দশ মিনিট সামনে এগোলে দেখা মিলবে ফুরমোন আর্মি ক্যাম্প। আর্মি ক্যাম্প ঘেষেই হ্যালিপ্যাড এবং ফুরমোন চূড়া। সামনে বিস্তৃত কাপ্তাই লেক আর আস্ত রাঙামাটি শহর।
অন্যপাশে শহর চট্টগ্রাম। আর ওই দূরে শহর রাঙ্গামাটির প্রবেশদ্বার। এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ইট পাথরের রাস্তা। ফুরমোন যেন যত্ন ভরা চোখে চেয়ে চেয়ে রাখে শহরের গল্প কথা।
পা এলিয়ে সবুজ ঘাসের উপর সপাট শুয়ে মেঘ আকাশের হাতছানি আর দূরে শহর জলের মুগ্ধতায় মূহুর্তেই বিমূর্ত হয়ে যায় ক্লান্তি।
আহ ফুরমোন, আমার ফুরমোন, আমাদের ফুরমোন।
মুগ্ধ বাতাস বিমুগ্ধ ভালোবাসায়।
চূড়া ছুতেই হঠাৎ দুঁফোটা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে গেলো। প্রকতির যেন ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য নেই দুদন্ডও।
শহর থেকে ১৫১৮ ফুট উপরে আর্মি ক্যাম্পে নীরব পাহাড়ায় থাকে বাংলার নওজোয়ানেরা। মূলত যাওয়ার আগে তাদের জানিয়ে যাওয়া ভালো।লোকারণ্য তুলনামূলক কম। এবং এই পাহাড় এখনো তেমন পরিচিত না হওয়ায় নিরাপত্তা বিষয়ে খানিকটা প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে ইনারা যথেষ্ট হেল্পফুল। সুউচ্চ জনমানবহীন নীরব পাহাড়ে কী কঠিন এক যাপিত জীবন!
সময় কীভাবে যেন ফুরিয়ে গেছে ফুরমোনের চোখে শহরের মাদকতায় ডুবে থাকতে থাকতে!
এবার নামার পালা।
নামবো এবার পাহাড় জঙ্গলের রাস্তায়। খানিকটা রিস্কি। ঝুম বৃষ্টি হলে এই রাস্তা দিয়ে নামা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায় নিশ্চিত! তবে পাহাড়ী পথে খুব তাড়াহুড়ো নিয়ে নামার চেষ্টা করা উচিত নয় কখনোই। আমরাও পা ফেলছি বেশ সতর্কভাবেই। খানিকটা যেয়ে দেখা মিললো তিন বটবৃক্ষের বিশাল ছায়াতলের। দুটো কাঠের বেঞ্চিও করে দেয়া আছে ভ্রমনপিয়াসী পথিকদের জন্য। বটবৃক্ষের বাতাস গায়ে জড়াতে গাছের নিচে এলিয়ে বসা আর খানিকটা বিশ্রাম। ফের হাঁটা। কখনো মাটির রাস্তায় আবার কখনো পাহাড়ী পাথুরে রাস্তা। ফাঁকে ফোঁকরে দু-একটা ঘরবাড়ির দেখা মিললো একদম প্রায় নিচের দিকটায় এসে। খুব বেশী সময় লাগেনা এই পথে নামতে। তুলনামূলক কষ্টও কম। পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় আমরা মূল রাস্তায়।সাপছড়ি রাস্তা।
এক পথে উঠে অন্য পথে নেমে সুবিধা যেটা হলো দুটো পথেরই সৌন্দর্য্য, মুগ্ধতা সাথে করে নিয়ে আসতে পেরেছি আমরা। পথে নেমে মনে হলো, ওই দূরে ফের যেন ডাকছে ফুরমোন। অপার ভালোবাসায়।
ফুরমোন চূড়া ফেলে নামতেই পেয়েছিলাম ছোট প্ল্যাকার্ডে লেখা “ধন্যবাদ আবার আসবেন”।
আবার আসার মায়াটা ছেড়ে আসা যায়নি। সাথে নিয়েই ফিরেছি। কবে না জানি আবার দেই ছুঁট……
ফুরমোন শহর রাঙ্গামাটির সুউচ্চ পর্বত।স্থানীয় ভাষার শব্দ ফুরমোনের অর্থ দাঁড়ায় ফুরফুরে মন। ঠিকই ফুরমোনের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘ পাহাড়ের মিতালীতে মন কেমন যেন সত্যিই ফুরফুরে হয়ে যায়। সব ক্লান্তি নিমিষে ফুরুত। ফুরমোন হয়ে উঠতে পারে শহর রাঙ্গামাটির পরিচিতি। ট্র্যাংকিয়ের অন্যতম স্থান।
সে জন্য হয়তো দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপও। জোরদার জরুরী নিরাপত্তারও।
ভালোবাসার মুগ্ধতার ফুরমোন আমার শহরকে আগলে রাখুক বুক পাঁজরে আদরে……
লেখক : ফিচার রাইটার, দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং স্কলার, বেঙ্গালুর ইউনিভার্সিটি।
Views: 59