স্কুলবেলায় রচনা লেখা শিখতাম।
গরুর রচনা মুখস্থ না হওয়ায় দু’হাতে দু’কান ধরিয়ে আমাকে মাস্টারমশাই হাই বেঞ্চের উপরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
লজ্জায় অপমানে আমি শহীদ মিনারের মত এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নির্বাক।
গ্রীষ্মকালের উপর রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম, চাতক পাখিরা পানি পানি বলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।
উপমা ঠিক ছিলো কিনা জানিনা।
স্যার লম্বা বেত চাবুকের মতো ঝোলাতে ঝোলাতে বলেছিলেন, চাতক পাখি দেখেছিস কখনো?
আমি বেতকে চাবুক হতে দেখে সব গুলিয়ে ফেললাম।
আমার কাছে নিজেকে খাজনা দিতে না পারা প্রজার মতো মনে হলো।
আমি দু’হাত জোড় করে মাস্টারমশাইয়ের দিকে মাথা নত করে কুর্ণিশ করতে করতে বললাম, “আজ্ঞে না মহারাজ, আমি চাতক দেখিনি।”
চাবুকের মতো বেত আমার পিঠে গিয়ে অজ্ঞতার চামড়া তুলে নিয়েছিলো।
মাস্টারমশাই তিন মাস মাইনে না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে বলেছিলেন, গ্রামের ছেলে চাতক চিনিস না। আজ তোকে চিনিয়েই ছাড়বো। আরে ব্যাটা মাস্টাররাও তো চাতক। চেয়ে থাকে টাকশালের দিকে। বাচ্চার খাদ্য, পথ্য কবে জুটবে তার দিকে।
চিরবঞ্চিত প্রজার মতো,
কৃষকের মতো,
মাইনে না পাওয়া গার্মেন্টস কর্মীর মতো,
রক্তভেজা আমি গুরুদেবের কাছে মাথা নত করেছিলাম।
প্রতিবাদ করিনি। প্রতিবাদ করতে নেই।
তারপর থেকে আমি বনে-জঙ্গলে,
পাহাড়ে-নদীতে ঘুরি।
আমি এখন চাতক পাখি চিনি।
চিনি জলময়ূরও। নানা রঙা বুলবুল চিনি। মাছরাঙা চিনি।
পাখি চিনতে গিয়ে আমি ফুল চিনেছি। গাছ চিনেছি। মাছ চিনেছি।
ভ্যাটফুলগুলো আমাকে ভেংচি কেটে বলে, কি হে মশায়, চাতক চিনো তো এখন?
আমি চাতক চিনি।
খুব ভালো করেই চিনি।
চাতকের নানা জাতও চিনি।
চাতক প্রজারা বৃদ্ধভাতা পেতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে ঘুষ দিয়েও কিভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তা আমার চেয়ে আর কে বেশি চিনে!
গার্মেন্টসের কর্মী করিমন নেছা, বেতনের জন্য যে তিন মাস থেকে চাতক হয়ে আছে তা কি দেখিনি আমি?
ধান রোপণের মৌসুম শেষ হতে চললেও সার কিনতে না পারা কৃষকের চাতক চক্ষু না চেনার মতো নির্বোধ তো আমি নই।
চাতক আমার চেয়ে কে বেশি চিনে বল?
গভীর রাতে তোকে দেখতে আমিও কি আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে চাতক হয়ে যাই না?
আমার চাতক চোখে তোর সুখি ঘর-দোর, বিছানা-বালিশ-সঙ্গী কি ধরা দেয় না?
আমি কি চাতক হয়ে অপেক্ষা করিনা তোর সঙ্গ লাভের?
মাস্টারমশাই, কোথায় আপনার বেতের চাবুক?
একবার শুধু দয়া করুন আমাকে।
আমিও সে চাবুক দিয়ে অন্তর শাসন করতে চাই।
নিজেকে খুঁচিয়ে দেখতে চাই, আর কোন রক্তক্ষরণ বাকি আছে কিনা।
একবার, শুধু একবার দিননা আপনার বেতের চাবুক।
Views: 59