আচ্ছা প্যাট্রিসিয়া আর আসার সময় পেল না? সারা বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ঐ একটিমাত্র দিন আছে যে দিনটাকে শম্পা আর সৌরভ একেবারে নিজের বলে মনে করে, আর এই দিনটাতে কাউকে ভাগ বসাতে দিতে চায়না, ঠিক সেই দিনটাতেই প্যাট্রিসিয়াকে ঢাকায় আসতে হবে? বস শফিকসাহেব ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন মিটিং এর এজেন্ডা থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে হবে, কোনদিকেই যেন কোনপ্রকার খুঁত না থাকে। প্যাট্রিসিয়া নিউইয়র্ক অফিসের দন্ডমুন্ডের কর্ত্রী। তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আগামী বছরের বিজনেস ভল্যুম। কাজেই তার কাছে কোম্পানীকে ঠিকমতো রিপ্রেজেন্ট না করলে বিজনেস হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা। চতুর্দিকে কম্পিটিটরদের তো অভাব নেই। কে কার ওপর কখন টেক্কা দেবে এই নিয়ে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। গত তিনবছরে প্যাট্রিসিয়ার সাথে সৌরভের একটা চমৎকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সৌরভ তার নিজের যোগ্যতায় ওদের প্রিন্সিপাল নিউইয়র্ক অফিসের সবার কাছেও বেশ প্রিয়। শফিকসাহেব সৌরভের কর্মদক্ষতাকে এক্সপ্লয়েট করতে চান। আর তাই সৌরভ তার যোগ্যতা দিয়ে অফিসের প্রায় সবচেয়ে বড় পদমর্যাদাটি দখল করতে চলেছে।
একটা কাজের অছিলায় ছুটির দরখাস্তটা পকেটে নিয়ে সৌরভ শফিকসাহেবের চেম্বারে ঢুকেছিল। কথায় কথায় খুব মৃদুস্বরে আমতা আমতা করে বলেওছিল, স্যার ঐ দিনে আমার একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে, না আসলে হয় না? কথাটা শুনে শফিকসাহেব ওর মুখের দিকে এমন করে তাকিয়েছিলেন যেন এরকম অদ্ভুত কথা বা আব্দার তিনি তাঁর সারাজীবনে কখনো শোনেননি। সৌরভ আর কোন কথা না বলে মাথা হেঁট করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
বাইরে বেরিয়ে নিজের চেয়ারে বসে রাগে ছুটির দরখাস্তটাকে খন্ড খন্ড করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে কিছুক্ষন গুম হয়ে রইলো। তারপর নানারকম পরিকল্পনা মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলো। প্রথমে মনে হলো চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া যায় কিনা, বাইরে ওর বেশ কয়েকটি অফার আছে। এরপর ভাবলো হঠাৎ করে ঐদিন একটা কাল্পনিক অসুখ বাধিয়ে তোলা যায় কিনা। এইসব সাতপাঁচ ভাবনার শেষে একসময় ও বুঝতে পারলো তার ভাবনাগুলোর সবক’টাই অবাস্তব আর অযৌক্তিক। কোম্পানীর এমন একটা প্রয়োজনের সময় তার মত একজন দায়িত্বশীল অফিসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটাকে এড়িয়ে চলতে পারে না।
শম্পাকেও তার এই বিপদের কথা বলতে পারছে না কারন সৌরভ ভেবে রেখেছে এইদিনটাতে শম্পাকে একটা বড় ধরনের সারপ্রাইজ দিতে হবে। সারাদিন সময় দিতে না পারলেও প্যাট্রিসিয়ার সাথে মিটিং শেষ করে বিকেলবেলায় শম্পাকে নিয়ে শহরের সবচেয়ে অভিজাত হোটেলে ডিনার করবে। ভাগ্যক্রমে ঐদিন হোটেলে চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। সেখানে দেশী শিল্পীদের সাথে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা কয়েকজন নামকরা শিল্পী অংশগ্রহন করবে। এইসব শিল্পীরা শম্পার খুব প্রিয়। সে দারুন খুশি হবে। সৌরভ গোপনে দামী দু’টো টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছে।
কিন্তু যা ভাবা যায় সবসময় তাই কি হয়? কে জানতো প্যাট্রিসিয়ার ফ্লাইট ডিলে হবে চারঘন্টা, আর সৌরভদের মিটিং শিডিউল পিছিয়ে যাবে ঐ চারঘন্টা। দুপুরে লাঞ্চের পর মিটিং শুরু হলো আর চললো রাত ১১টা পর্যন্ত। ফাঁসির আসামীরা মনে হয় একসময় অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। সৌরভের অবস্থা আজ সেই রকম। যদিও অত্যন্ত এফিশিয়েন্টলি সে মিটিংটাতে পার্টিসিপেট করেছে আর তার ফলে গতবছরের চেয়ে এ বছর কোম্পানী প্রায় দ্বিগুন অর্ডার পেয়ে গেল। শফিকসাহেব দারুন খুশি। আড়ালে ডেকে সৌরভকে বলেছেন, ব্রাভো মাই বয়! কনগ্রাচুলেশনস। কিন্তু এই উৎসাহবাক্য সৌরভকে একেবারেই স্পর্শ করলো না। এরপর বসের নির্দেশে প্যাট্রিসিয়াকে হোটেলে ড্রপ করে যখন বাসায় পৌঁছালো তখন রাত দেড়টা। কয়েকবার বেল বাজানোর পর কাজের মেয়েটা বিরক্ত হয়ে ঘুমচোখে দরজা খুলে দিল।
হনহন করে বেডরুমে ঢুকে সে হতবাক হয়ে গেল। রুমে লাইট জ্বলছে। বিছানার একপাশ শম্পা ঘুমিয়ে পড়েছে। পরনে পার্টি পোশাক। একটা দামি জামদানি শাড়ি, খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়ানো, কপালে টিপ, স্নিগ্ধপ্রসাধনে ঘুমন্ত মুখটা অপরূপ দেখাচ্ছে। অনেকক্ষন ধরে সৌরভ সেই চিরচেনা মুখটার দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হল এ যেন অন্য এক শম্পা যাকে সে এতদিন ধরে চিনতে পারেনি। সারা অবয়বজুড়ে যে অপূর্ব রূপ ছড়িয়ে পড়েছে। সে যেন আজই প্রথম এলো তার ঘরে। একসময় সৌরভ তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো কিন্তু সে ডাক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শম্পার কাছে পৌঁছলো না। আহা, বেচারি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, এত রাতে জোর করে জাগানো ঠিক হবে না। আজ সৌরভ নিজেও খুব ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে সে লাইট নিভিয়ে ওর পাশটিতে শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সৌরভ দেখলো শম্পা তার পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো সে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে সেদিনের পত্রিকাটা পড়ছে। কাছে গিয়ে বললো, জানো কাল না এমন একটা বিপদে পড়েছিলাম। কথা শেষ করতে না দিয়ে শম্পা গম্ভীরভাবে বললো, তোমার ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাখা আছে। বলেই সে উঠে অন্যদিকে চলে গেল এবং অফিসে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের অজুহাতে পরিচারিকার সাথে ব্যস্ত হয়ে রইল।
শম্পার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব আছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণের মধ্যেও সে উপেক্ষা বা এড়িয়ে চলার কৌশল জানে। বিরক্তি বা রাগের প্রকাশকে সে একেবারে নিস্পৃহ থেকে গোপন করতে জানে। পরবর্তী দিনগুলোতে সৌরভের সাথে খুব প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বলেনি। সৌরভ সেদিনকার প্রসঙ্গ তুলতে গেলে অত্যন্ত নির্বিকার থেকে তার কথায় কর্ণপাত করেনি। সেদিনকার প্রসঙ্গে সৌরভের যুক্তি প্রদর্শনের জবাবে শুধু একবার বলেছিল,”থাক না ওসব কথা, আমি তো জানি তুমি অফিসের বিগ বস। অফিসের জরুরি কাজ করেছ। তাতে সমস্যাটা কোথায়?”
সমস্যা যে কোথায় সে তো সৌরভ মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে। এভাবে শুধু দু’একটা প্রয়োজনীয় কথা বিনিময় করে নিজের স্ত্রীর সাথে এমন নিরানন্দ দিন যাপন করে চলা যায় না। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সৌরভের একসময় মনে হলো তার এমন কী দায়? সে কী ইচ্ছে করে সেদিন অফিস থেকে ফিরতে দেরি করেছে? অফিসের জন্যে সে যে পরিশ্রম দিচ্ছে তা কি শুধু নিজের একার জন্যে? সেও তো ইচ্ছে করলে নিজের জন্যে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিতে পারে। আজ ছুটির দিন। সকাল থেকে শম্পা খবরের কাগজ মুখে দিয়ে পড়ে আছে। সৌরভ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটার পর মনে হলো বন্ধু মঈনের বাসা থেকে আড্ডা দিয়ে আসলে হয়। ওখানে বন্ধু মঈন, তার স্ত্রী আর দুরসম্পর্কের এক পেয়িং গেস্ট দাদু থাকেন। যদিও ওদের বাসায় কখনো একা আসেনি। কিন্তু বিধি বাম। বন্ধু সস্ত্রীক বেড়াতে গেছে। অতএব ধরা পড়তে হলো দাদুর খপ্পরে। মঈনের এই দাদুটি সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে থাকেন আর মানুষজন পেলে জ্ঞানের কথাবার্তা শোনান।
সৌরভকে দেখে দাদু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, এসো এসো দাদুভাই। আজ তোমাকে পাওয়া গেছে, কিন্তু ব্যাপার কী? কপোতী কোথায়?
বাদ দিন তো দাদু, আপনাদের এখানে বুঝি একা আসতে নেই?
তা থাকবে না কেন, তবে সবসময় আমরা কপোত কপোতীকে একসাথে দেখতে অভ্যস্ত, কোনদিন তো এমন বিরহরূপে দেখি না, তাই। ব্যাপারটা কী ?
কিছু না, মনে হল আপনাদের দেখে আসি, চলে আসলাম।
উঁহু, আমার অভিজ্ঞ চোখ তো সে কথা বলে না, কিছু একটা ব্যাপার তো আছেই।
সৌরভ বুঝলো বুড়োর কাছে লুকিয়ে লাভ হবে না, জেরায় জেরায় অস্থির করে সে আসল কথাটা বার করে নেবেই। সংক্ষেপে সে তাদের সাম্প্রতিক মনোমালিন্যের ব্যাপারটা বলে ফেলল।
শুনে তো বুড়ো রীতিমত এক্সাইটেড হয়ে বলে উঠল, বুঝেছি, বুঝেছি অভিমান!
হ্যাঁ, অভিমান, কিন্তু অভিমানের তো একটা যুক্তি থাকতে হবে। অকারন অভিমানের কোন মানে হয়?
বুড়ো এবারে সিরিয়াস, বললে, শোন দাদু অভিমান অনেক সময় কারন অকারন মানে না। অভিমান এমন একটা অনুভূতি যেটা আমাদের দেশের মানুষদের নিজস্ব সম্পত্তি, একেবারে পেটেন্ট রাইট।
বুঝলাম না।
বুঝলে না? আচ্ছা অভিমান শব্দের ইংরিজি প্রতিশব্দ বলো তো।
Sensitiveness?
নিজের কাছেই জিজ্ঞেস করো ঐ শব্দটি কি ঠিক অভিমান বোঝায়? ডিক্সনারিতে হয়ত আরো কিছু শব্দ পাবে যেমন Pride, Egotism, Conceit কিন্তু কোনটাই ঠিকমতো অভিমান নামক অনুভূতিকে বোঝাতে পারে না। তার মানে বিদেশী ভাষায় অভিমানের কোনই প্রতিশব্দ হয় না। অভিমান কী জিনিষ বিদেশীরা বোঝেই না। যে গভীরভাবে ভালবাসতে জানে অভিমান তারই শোভা পায়। তুমি কবি জয়দেবের নাম শুনেছ?
গীতগোবিন্দের জয়দেব?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। শ্রীকৃষ্ণ আর রাধার অপূর্ব প্রেমলীলার কাহিনী এই গীতগোবিন্দের প্রতিটি ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে। তো সেই রাধা একদিন অভিমান করলেন কৃষ্ণের সাথে। তাঁর সন্দেহ কৃষ্ণ অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে তার সাথে রাত্রিযাপন করেছেন। রাত্রি জাগরনে তার চক্ষু লালবর্ণ ধারণ করেছে, কোন নারীর দাঁতের আঘাতে তাঁর নরম ঠোঁট কেটে গেছে এমনি অজস্র প্রমান তাঁর সারা শরীর জুড়ে। শ্রীকৃষ্ণ যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন যে ঠোঁটের ক্ষত সে তো জঙ্গলের ভ্রমরের হুলফোটানোতে সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু রাধা কোনকথাই বিশ্বাস করতে রাজি নন। তিনি কৃষ্ণকে কোনমতেই আর গ্রহণ করবেন না। এই পর্যায়ে কৃষ্ণ রাধার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবেন। কিন্তু ভক্ত জয়দেব কী করে এই কথা লিখবেন? দেবতা পায়ে ধরছেন তাঁর দয়িতের, এমন কথা ভক্তের কাছে যে বেয়াদবির সামিল। এখানে তিনি কী লিখবেন সেই কথা ভাবতে ভাবতে দিন কাটে, রাত কাটে সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। তালপাতার ওপর আর কলমের আঁচড় পড়ে না।
একদিন লেখা ছেড়ে তিনি চললেন স্নানের উদ্দেশ্যে নিকটস্থ গঙ্গার ঘাটে। একটু পরেই তিনি ফিরে আসলেন স্নান না সেরেই। স্ত্রী পদ্মাবতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ফিরে এলে যে?
জয়দেব বললেন, গীতগোবিন্দের যে স্থানটাতে তিনি আটকে গিয়েছিলেন সেটা এখন মনে পড়েছে, তাই সেটা লিখে রেখেই তিনি স্নানে যাবেন। এরপর লেখা শেষ করে তিনি স্নানে চলে গেলেন।
স্নান সমাপন শেষে ফিরে এসে তিনি দেখেন যে জটিল অংশটিতে লেখা হয়ে গেছে। অবাক বিস্ময়ে তিনি পদ্মাবতীকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আমার লেখার পাতায় লিখে গেল? পদ্মাবতী বললেন, কেন একটু আগে তুমিই তো লিখবে বলে স্নান না করেই ফিরে এসেছিলে। অবাক বিস্ময়ে জয়দেব বুঝতে পারলেন, দেবতা নিজে তাঁর ছদ্মবেশে এসে লিখে রেখে গেছেন, “এত করেও যদি তোমার মান না ভাঙে তবে তোমার পাদপদ্ম আমার মাথায় অলঙ্কারের মত স্থাপন করে দাও।”
বুঝলে তো প্রিয়ার মানভঞ্জন এত সোজা নয় দাদু।
বিদায় নিয়ে সৌরভ ফিরে চলেছে বাসায়। মনের মধ্যে বাজছে গীতগোবিন্দের একটা সুর, “দেহি পদপল্লবমুদারম”।
Views: 141