বইঃ অরিয়েন্টালিজম
লেখকঃ এডওয়ার্ড সাঈদ
অনুবাদকঃ ফয়েজ আলম
প্রচ্ছদঃ মাহবুব কামরান
প্রকাশনীঃ র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা
পৃষ্ঠাঃ ৪১৬
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫০
২০১৫ সালে একটি ঘটনা বেশ আলোচিত হয়, ইসরায়েলের আদালত একচেটিয়া ভাবে এক ইসরায়েলি আরব কবিকে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে। তার অপরাধ হিসেবে বলা হয়, তিনি তার লেখার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধী সংঘটনকে উৎসাহিত করছে।
কবির নাম দারিন তাতো।
তাৎক্ষনিকভাবে লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পেন’ কবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বার্তা দেয়, দারিন তাতোর সেই কাজটাই করেছেন, যেটি লেখকরা প্রতিদিন করেন- আমরা প্রতিদিন আমাদের শব্দ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানাই।”
আদালতে কবি বলেছিলেন, “আদালত বলেছে আমি সন্ত্রাসবাদের দোষে দোষী। যদি এটা সন্ত্রাসবাদ হয়, আমি গোটা দুনিয়াকে আমার ‘সন্ত্রাসবাদী ভালোবাসা’ জানাই।”
সাম্প্রতিক পটভূমিতে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক অলিখিত আয়না যেন ইসরাইল আর প্যালেস্টাইনের ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা। এমনি এক ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে আসা একজন মানুষ এডওয়ার্ড সাঈদ। তার সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রাখা এক রত্নের নাম ‘অরিয়েন্টালিজম’। যে বইটি প্রাচ্যতত্ত্বকে নিয়ে বোঝার আর দেখার এক নতুন চেহারায় আবর্তিত হয়।
এডওয়ার্ড সাঈদ অরিয়েন্টালিজমে ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এক বহুল আলোচিত টার্ম হিসেবে, মুলতঃ প্রাচ্যতত্ত্ব বলতে প্রাচ্য অর্থাৎ পাশ্চাত্যের বিপরীত সাংস্কৃতিক জগতকে বোঝায়। ইংরেজি ওরিয়েন্ট শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে আগত ওরিয়েন্স। ওরিয়েন্স আবার ল্যাটিন ওরিয়েন্স শব্দটির সমার্থক যা বিশ্বের পূর্ব অংশকে ইঙ্গিত করে, রুপক অর্থে বলা যায়, পুর্ব দিকেই সুর্য উদিত হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া মতে, “প্রাচ্য” শব্দটি দ্বারা মূলত ভূমধ্যসাগর এবং দক্ষিণ ইউরোপের পূর্বের দেশগুলিকে বোঝায়।
প্রাচ্যের উপরে পাশ্চাত্যের যে নিগুঢ় আধিপত্যের প্রতিফলন সাঈদ অরিয়েন্টালিজম বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও প্রতিফলন — প্রাচ্যের ঐ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের দাপট, আরোপণ আর ধরনের ইতিহাস।
আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শুরুর দিকের সময়কালে প্রাচ্যবিদ বলতে বোঝাত, যারা পূর্বের ভাষা নিয়ে, প্রাচ্যের সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে দক্ষ ছিল এবং এই দক্ষতা পাশ্চাত্যের সাথে একাডেমিক কাজে ফুটিয়ে তুলত। সাঈদ বলেন, প্রাচ্য হলো পশ্চিমের জ্ঞান জগতের নির্মাণ; পশ্চিমের নিকট প্রাচ্য ছিলো দূর ও অজানা।
মুলতঃ এই দ্বন্দ্বমূলক অজানায় প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য একে অপরের নিকট প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে। আগ্রহের সর্বোচ্চ সীমাতে আসে ‘উপনিবেশ’ নামক অস্ত্রের প্রতিফলন যাকে বলা যায়, পশ্চিমা প্রভাবের অধীনে প্রাচ্যের জাগরণ অথবা আধিপত্যের শিকার প্রাচ্যের উপর উপনিবেশ শক্তির বলয়। খুব সহজ করে বলা যায় পাশ্চাত্যের ভূমিদস্যূতার রূপ হিসেবে।
অরিয়েন্টালিজমে এডওয়ার্ড সাঈদ প্রাচ্যতত্ত্বকে প্রতিফলিত করেছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আর ভৌগেলিক সীমানার এই সুক্ষ্ম বিশ্লেষণে যেটা পাশ্চাত্য আরোপন করে প্রাচ্যকে রেসিজিম আর সেক্সিজমে সিম্বল হিসেবে দেখিয়ে। যেমন-
১) প্রাচ্যতত্ত্বে প্রাচ্যকে চিহ্নিত করে আদিম সভ্যতার কোনো বর্বর উপাখ্যান হিসেবে, উদাহারন হিসেবে বলা যায়- বার্বারিজমের ভিত্তি হিসেবে।
২) একে অন্যের উপরে নিষ্ঠুর বলিদান হিসেবে যেখানে প্রাচ্যবাসী নিজস্ব ইতিহাস তুলে আনতে ব্যর্থ অথবা ধূলিসাৎ করছে নিকট ভবিষ্যৎকে।
৩) পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ আর প্রাচ্যেকে নিকৃষ্ট বোধের আকার হিসেবে। যার ভিত্তিতেই উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার ধারণা আসে।
৪) তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রাচ্য সভ্যতাকে যাচাইয়ের মানসিকতা যেখানে প্রাচ্যকে প্রতিপক্ষের আসনে ধাবমান করা।
সাঈদের ভাষ্যমতে, পাশ্চাত্যের উপনিবেশ মনোভাব প্রাচ্যকে সংশোধন না করে বরং আরো চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারনে পাশ্চাত্যে প্রাচ্যের প্রতি যে নিকৃষ্ট ভাব দেখায় ফলশ্রুতিতে আঠারো শতকের শেষ থেকে প্রাচ্যতত্ত্বের সক্রিয় যাত্রা শুরু হয়। মুলতঃ সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একে অপরের যে বিপরীত মেরুকরণ প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য নামে তাই অরিয়েন্টালিজমের মূল ভিত্তি। বেনজামিন ডিজরাইলির মতে, “পুব হলো উন্নতির এক পেশা'”।
মুলতঃ প্রাচ্য স্বয়ংসম্পূর্ণএক ভাণ্ডার যার রয়েছে এক উর্বরা ভূমি আর বৃহৎ প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। এত ঐশ্বর্যভরা ভূমির উপর তাই উপনিবেশতার চাবুক পেটানো পূর্বপরিকল্পিত ভাবেই দখলদারিত্বের সাথে জড়িত। পাশ্চাত্য সে কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাচ্যতত্ত্বের ভিত্তি গেড়ে দিয়ে তা ছড়িয়েছে সাংস্কৃতিক আবরণের ছদ্মবেশে, মনস্তাত্ত্বিক পঙ্গুতার ভিত্তি গড়ে দিয়ে। প্রাচ্যতত্ত্বের এই টার্ম ব্যবহার হয়েছে উপনিবেশের সমস্ত ভূমিগুলোতে আর পাচার হয়েছে একে একে সমস্ত সম্পদ আধুনিক দাসত্বের রূপে। উদাহরণস্বরুপ একটু চোখ ফেরাতে পারি দৃশ্যমান প্রেক্ষাপটে। কোহিনূর হীরার ইতিহাসের সূচনা ১৩০৪ খৃষ্টাব্দে। এর মূল মালিক কাকাতিয়া রাজবংশ। ষোড়শ শতকে মালাওয়ার রাজাদের অধিকারে ছিল। মোঘল সম্রাটদের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৫৩০ সালে হুমায়ুনের অধিকারে আসে, যাকে পরবর্তীতে বাবরের হীরা বলে প্রচার করা হয়। মোগল সাম্রাজ্যের বিক্ষিপ্ত শাসনামলে মুসলিমদের অধীনে রাখার জন্য পারস্যের নাদির শাহ উপমহাদেশে এসে লুন্ঠন করে এই হীরকখন্ড আর নাম দেয় কোহিনূর মণি। নাদির শাহের মৃত্যুর পরে তা নিয়ে যায় এক আফগান শাসক। পাঞ্জাবের শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিংহ আফগানদের নিকট থেকে দখল করে জগন্নাথের মন্দিরে দান করেন এই হীরক খন্ড। ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে লর্ড ডালহৌসী শিখ রাজা দিলিপ সিং থেকে চুক্তি করে নিয়ে গিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে শোভিত করে এই হীরক খন্ড। ১৯৫৩ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ অভিষেকে ভারত কোহিনূর মণি দাবি করে, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তা আমলে নেয়নি। বর্তমানে কাকাতিয়া রাজবংশের সেই কোহিনূর হীরা টাওয়ার অব লন্ডনে শোভা পাচ্ছে!
এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্ব যদিও সামগ্রিক আলোচনা প্রাচ্যের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল কিন্তু উপনিবেশের গোড়াপত্তন হয়েছে যেসব অঞ্চলে প্রাচ্যতত্ত্ব তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এই জন্যেই সাঈদের অরিয়েন্টালিজম অবশ্যপাঠ্য। একটু উপমহাদেশের দিকে নজর দিলে ১৯৪৭ এর বিভক্তির প্রসঙ্গে বললে, ১৯৪৬ সালে মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সৃষ্ট চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পরস্পর বিরোধী অবস্থান স্থায়ীভাবে নিরসনকল্পে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। আবহমানকাল ধরে চলে আসা সম্পর্কের চিড় ধরিয়ে সৃষ্টি করে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের রূপে নব্য উপনিবেশিক যুগের সৃষ্টি। ধর্মের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে ধোঁয়ার মত মগজ আর মননে, সংস্কৃতিকে ব্যবহার করেছে সামাজিক সংঘাতের মাধ্যম হিসেবে, দ্য মর্ডান সোশিয়লজিক্যাল থিউরিতে টেইলর যেটাকে বলেছে “Which deals with the rules of society”.
অরিয়েন্টালিজম তাই অবশ্যপাঠ্য প্রত্যেক মানুষের যাপনের ভিত্তি জানার জন্য। জানার জন্য কীভাবে পাশ্চাত্য প্রাচ্যতত্ত্ব আমাদের মগজের ভিতরে চালিত করেছে। ভীল-সাওতাল-মুণ্ডাকে শারীরিক কদর্য, বাঙ্গালীর মিশ্রতাবাদের ইতিহাস এগুলো মুলতঃ বহুযুগ ধরে উপনিবেশিক শাসনের বুলিতে পাশ্চাত্যের কথনকেই আমরা নিজেদের মুখের বুলি হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমরা বিশ্বাস করেছি, ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ( ৪মে, ১৮০০) না থাকলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের উম্মেষ হতনা অথচ ইংরেজদের বাংলা শেখাতেই কিন্তু এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।আমাদের পড়তে লজ্জা করেনা পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। অথচ মগজের বেড়াজালে আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছে মঙ্গল সাহিত্যের কথা,জীবনী সাহিত্য, নাথ সাহিত্য পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধির কথা।
আপনার অরিয়েন্টালিজম পড়তেই হবে!
কেন?
কীভাবে এখনো আপনার জীবন-যাপন উপনিবেশিক দাসত্বে বন্দী তা জানার জন্য!
#হ্যাপিরিডিং
Hits: 227