প্রবাস জীবন, সেকি খুব সুখের সাগরে ভাসার জীবন,নাকি অনেক কষ্ট,বেদনা মনের গভীরে চেপে রেখে বেছে নেয়া একটি জীবন, একমাত্র প্রবাসীরাই ব্যাপার টা উপলব্ধি করতে পারেন।
মানুষ প্রবাসে কেন যায়? হয়তো কোনো আর্থ সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অথবা একটু ভাল,নিরাপদে থাকবার আশায়।নিজের জন্মভূমি, পরিচিত পরিবেশ, পরিজন ছেড়ে প্রবাস জীবন বেছে নেয়া, নিশ্চয়ই খুব সহজ কিছু নয়।জীবনের অনেক কষ্ট, বেদনা ধামাচাপা দিয়ে প্রবাসীকে জীবন যাপন করতে হয়।নিজ দেশ ছেড়ে ভিন্ন ভুমি খুব সহজেই নিশ্চয়ই তাদেরকে আপণ করে নেয় না,তার জন্য কঠোর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে তাদের দিন পার করতে হয়। ভিন্ন দেশের আইনকানুন, সামাজিক রীতিনীতি সবই তাদেরকে সঠিকভাবে পালন করতে হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, কঠোর পরিশ্রম করে হয়তো কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ তাদের জীবনে ফিরে আসে। এর মাধ্যমে তারা প্রিয়জনের মুখে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে অথবা নিজেরা একটু ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা করে।
বেশির ভাগ প্রবাসী কিন্তু তাদের উপার্জনের অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশেই প্রেরন করেন। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, দেশের জন্য কর্তব্য, এর পরিবর্তে দেশ থেকে কতটুকু নিরাপত্তা তারা পান? আজকাল দুর্বিত্তশ্রেণীর সহজ টার্গেটে পরিনত হয়েছেন প্রবাসীরা।এই মানুষ রূপী দানব গুলোর ধারণা, প্রবাসী মানেই কাড়ি কাড়ি টাকা, প্রয়োজন হলে তাদের মেরে কেটে তাদের টাকা পয়সা, এমনকি জীবন লুটে নাও।
এই কষ্টের অর্থ উপার্জনের পিছনে যে কতটুকু রক্ত পানি করা পরিশ্রম মিশে আছে তা এই মানুষ রূপী বিবেকহীন পশুগুলোর কল্পনারও বাইরে। প্রায়ই পত্র পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন এর খবরে দেখা যায় প্রবাসীর হেনস্তা, চাঁদাবাজি, গুম খুনের শিকার হচ্ছেন।কারণ তারা সহজ টার্গেট।
কিন্তু কেন এই অসংগতি, কে এর দায় ভার নিবে?তাহলে কি প্রবাসীরাই অপরাধী? মানুষ কি প্রবাসে যাবে না, নাকি গেলেও স্বদেশে ফিরে আসতে পারবে না? প্রবাসীরা তাদের কষ্টের বিনিময়ে কতটুকু প্রতিদান পাচ্ছেন?
এবার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলি।একবার দেশে ছুটিতে যাবার দুইদিনের মধ্যেই বাড়িতে ডাকাতি হলো। বারান্দার গ্রিল কেটে মেহমানরা আসেন। তাদের হয়তো বোঝার ভুল ছিল, তারা একটা ফ্ল্যাটে ঢুকে জিজ্ঞেস করে এখানে বিদেশ থেকে কারা এসেছে? ভাগ্যক্রমে আমরা ছিলাম অন্য একটি ফ্ল্যাটে। যাইহোক সেই ফ্ল্যাটে ঢুকে বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে সেই ফ্ল্যাটের ৩ জনকে কুপিয়ে মারাত্মক ভাবে আহত করেছে, তারপর যা পায় তাই নিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায়। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা মারাও যেতে পারতো যদি না আমরা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতাম।
ঘটনার পর স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, এ কেমন অভ্যর্থনা, এই ঘটনার শিকার তো আমারই হবার কথা ছিল? এরপর যে কয়দিন দেশে ছিলাম, রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের বিবেক এতো নিম্নস্তরে কিভাবে পৌঁছে যাচ্ছে! চিন্তা চেতনার এত অবক্ষয় কেন হচ্ছে? এর দায় ভার কার? কে প্রবাসীদের নিরাপত্তা দেবে?
প্রবাসীরা দিন রাত কষ্ট করে বিদেশ গমণ করেন একটু সুখের আশায়, কিন্তু নিজ দেশের কাছ হতে এ কেমন অভ্যর্থনা পায় তারা? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? এর কি প্রতিকার হওয়া উচিত নয়?
আজকাল দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনারও যেন পরিবর্তন হচ্ছে। আত্মীয় স্বজন দের সাথে এসব সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে গেলে বরং উল্টো উপদেশ পাই, যেন দেশে বেড়াতে আসলে লুকিয়ে লুকিয়েই আসি।আশ্চর্যের কথা! প্রবাসীরা স্বদেশে আসবেন লুকিয়ে লুকিয়ে, যাতে দুর্বিত্তরা টের না পায়!
কি তাদের অপরাধ!
একজন প্রবাসী চিকিৎসক হিসেবে আমার কষ্টগুলো শুধু আমিই উপলব্ধি করি, যখন আমার সন্তান অসুস্থ থাকলেও তার সেবা করার সুযোগ ও আমার হয় না। আমাকে ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষের সেবা করার জন্য ছুটে যেতে হয়।
এতকিছুর পরও মনে আশা জাগে আমার দেশ একদিন সত্যিই সোনার বাংলা হবে, সোনার মানুষে ভরে যাবে এই দেশ,কিন্তু তার জন্য পদক্ষেপ তো দেশের মানুষকেই নিতে হবে, নইলে তো সামনে শুধুই অন্ধকার। আমরা যে আশার আলো দেখতে চাই।
লেখক : প্রবাসী চিকিৎসক, সউদি আরব।
Views: 46