হেসে খেলে সফল হওয়া যায় না। সাফল্যের জন্য প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়…. “নীতি” এই বিশ্বাসেই পথ চলে। তার বাবার মতো দুশ্চিন্তা করে জীবন পার করতে চায় না, চায় না নির্ভার থাকতেও। দুশ্চিন্তা করে জীবন পার করে বোকারা আর চিন্তা করে সময় উপভোগ করে বুদ্ধিমানেরা। নীতিও থাকতে চায় বুদ্ধিমানের দলে।”জীবন আসলে বাইসাইকেল চালানোর মতো, ভারসাম্য বজায় রেখে এটা চালিয়ে যেতেই হয়।” – আইনস্টাইনের সাথে আমিও একমত। নীতি ভাবছে আর তার পঙ্খিরাজ বাইসাইকেলটা আপন গতিতে চলছেই গন্তব্যে পোঁছাবে বলে।
“নীতি” সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে ব্যালকুনি থেকে দেখলো “প্রীতি”। স্বভাব বসত চিৎকার করে ডাকলো, নীতি… এ্যাঁই নীতি শোন্ না । এই পাঁচতলার ব্যালকুনি থেকে নীতি কি শুনতে পাবে? প্রীতি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। মাঝে মাঝে আমি এত বোকার মতো কাজ করি, এজন্যই তো মা আমাকে হাদা মেয়ে বলে। মোবাইলটাই তো ছিল হাতে। রিং দিলে ঠিক সাইকেল থামাতো আমার বোনটি। আর আমার কলটা ধরে একটুকরো ম্লান হাসি দিয়ে বলতো, “দিদি বল্ তো কি বলবি, আমার এখন তাড়া আছে।”
নীতির জন্য প্রীতির বড্ড মায়া, ভেতর থেকে একটা আত্মার টান অনুভব করে। করবেই না কেন? দু’জনের দেহে একই রক্ত বইছে। বাড়ির মানুষ বাইরের হয়েছে কপাল দোষে। তবে কপালকে দোষীয়ে পার পাওয়া যায় না। মানুষ তার কর্মফলেও নিগৃহীত হয় কখনো কখনো।
নীতি’র সাইকেল থামলো একটা কোচিং সেন্টারের সামনে। এখানে সে পড়ায় সকালে। তাই খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়। “পদ্মপুর” গ্রামে বাবা মেয়ের বসবাস। এই পদ্মপুরের নামকরণ হয় পদ্মপুকুরের নাম অনুসারে। যা এককালে তাদের ছিল। শহরে আসতে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তার গ্রামের সড়কে টেম্পু, অটো চলে। কিন্তু তা দিয়ে এসে তার লাভের চেয়ে লোকশান হয় বেশি। তাই তো স্বাধীন বাহন বেছে নিয়েছে সাইকেল। ইচ্ছে আছে, টাকা পয়সা জমিয়ে একটা বাইক কিনবে। তখন সব কাজ সহজ হয়ে যাবে। কমদিন তো হলো না স্টুডেন্ট পড়াচ্ছে। হাতে জমিয়েছিলো কিছু টাকা। কিন্তু বাবাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই সব টাকা খরচ হয়ে যায়। আর বাঁচিয়ে যে রাখতেই হবে তাকে। তার আর আপন বলতে কে আছে। চারপাশে তো আপনজন নামধারী পরজনে ভরা। পিশিরা ছিলো আপনার আপন। তারাও গত হয়েছেন কয়েক বছর। আর জ্যাঠু তো বেশ আগেই এ বসুধা ছেড়েছেন। তবে বেঁচে থেকেও না থাকার মতোই ছিলেন। জ্যাঠিমার হাতের মুঠোয় ছিলেন। ছেলে গুলোতো জমিদার বাবু। আমি যে তাদের বোন পরিচয়ই দেয় না। রইলো বাকি আমার প্রীতি দিদি। ছোটকার মেয়ে। এই হাহাকারের শূন্যতায় ঐ একজনই আছে আমার আপনজন বলতে। তেমন কিছু করতে পারে না কাকীমার জন্য। তবে মায়ার স্রোতে ভাসে আমার জন্য। এটুকুই খুব আপন ভাবায়।
চুপিচুপি কত কিছু দিতে চায়, আমার মন নিতে সায় দেয় না। ধমক দিয়ে বলে, “তোর নামটা সার্থক…নীতি, নীতি থেকে একটুও সরে না, অনড়, অটল।”
আমিও হাসতে হাসতে বলি, দিদি তোমার নামটাও সার্থক, “তুমি এত প্রীতিময় প্রীতি। আমার চিবুক আলতো করে ছুঁয়ে বলে মাস্টারনি বড্ড শিখেছিস কথা।”
এই ভার্সিটি কোচিং সেন্টারের অনেক টিচারের মধ্যে সেও একজন। এখানকার ক্লাস নিয়ে নিজে যায় তার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। এখানে সে গণিত বিষয় নিয়ে পড়ছে। অর্নাস ফাইনাল ইয়ারের মেধাবী ছাত্রী। আর্থিক ও পারিবারিক কারণে ভার্সিটিতে চান্স পেয়েও পড়তে পারলো না। বিশেষ করে অসুস্থ অসহায় বাবার কারণে। তার বেস্ট ফ্রেন্ড “সাজিদ” ভার্সিটিতেই পড়ছে। তার তো পিছুটান নাই। বাবা-মায়ের আদরের ছেলে সে তো ভার্সিটিতে পড়বেই। সাধারণ গেরস্ত পরিবারের ছেলে সাজিদ। আমার ঠাকুরদার মতো জমিদার ছিল না ওরা। আবার আমার বাবার মতো ওর বাবা নিঃসহায় নিঃসম্বলও না। সাজিদের’র দাদা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আর ওর বাবাও এখন স্কুল শিক্ষক। আমাদের মতো বিষয়-আশয় নেই। আর বিষয়ের বিষে নীলও হয় না ওদের যাপিত জীবন। অল্প কিছু জমি ও বাড়িখানাই ওদের সম্পদ। হাতে গোনা পয়সার জীবন ওদের, তবে সচ্ছল, শিক্ষিত পরিবার।
নীতিশ রায় আমার বাবা। বাড়ির ছোট ছেলে। তার বাবাকে পাঁচবছর বয়সে হারায়। ঠাকুরদার স্মৃতি বাবার স্মৃতিপটে ভাসে না। আমার ঠাকুরদার নাম ডাক অনেক। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে। ঠাকুরদার প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই সাজিদের বাবা শিক্ষক। আমিও ঐ স্কুলে চাকুরির অফার পাই কমিটি থেকে। কিন্তু আমার জ্যাঠুর ছেলেরা বাঁধা দেয়। আর আমার ইচ্ছেও ছিল না। বরং শহরের কোচিং এ ক্লাস নিয়ে চটজলদি নিজের কলেজে যেতে পারি। আর মাইনেটাও একটু বেশি।
আজ সারাদিন এত ব্যস্ততা ছিল যে ফোন চেক করার সময় পায়নি। অনেক গুলো মিসড্ কল প্রীতি দিদির। কল দেয়ার সময় নাই। গ্রামের পথ, এমনিতেই সাঁঝ নামে বাড়ি ফিরতে।
বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই বাবার খুকখুক কাশি। কী বাবা, আজ কি কাশিটা বেড়েছে? যাওয়ার সময় বলেছিলাম, কষ্ট করে একটু গরম জল করে খেয়ো। খাওনি তো… সারাদিন তো ছাইপাঁশ খেয়ে নিজের সাড়েসর্বনাশ করেছো। তার ফলতো এখন ভোগ করতেই হবে। নীতি রোজ এমনই ভাবে বকবক করতে করতে গৃহপ্রবেশ করে। বাবা ছেলেটা তার কন্যা মাকে বড্ড ভয় পায় আবার প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাই চুপকথা হয়ে চুপ করে শোনে। আওয়াজ করে না।
ফ্রিজে তো সকালের রান্না গুলো আছেই। একটু পরে রাতের ভাত চাপিয়ে দেবো চুলোয়। ভাগ্যিস বড়ো পিশি স্বর্গে যাবার আগে একটা ফ্রিজ কিনে দিয়ে আমাদের স্বর্গে রেখেছেন । এই দীনতায় ছুটে চলা জীবনে ঘরে একটা ফ্রিজ থাকা নীতির জন্য স্বর্গ পাওয়া। বাপ মেয়ের যাপিত জীবনের মতোই জং পড়ে গেছে ফ্রিজের গায়ে। তবে কাজ তো চলে যাচ্ছে। গরম জলে নুন দিয়ে ঘুটে নীতি বাবার হাতে স্টীলের মগটা হাতে দিয়ে বললো, সময় নিয়ে গার্গেল করো। আমি আদা চা করে আনছি।
সর্বহারা বাপের গুণী কন্যাটিই সম্বল, সম্পদ আর এই মাথা গুঁজার ঠাঁই টুকু । এককালে নীতিশ রায় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিষয়-আশয় এর মালিক ছিল। কিন্তু অলস লোকেরা বুদ্ধিহীনতায় ভোগে। আর সবকিছু একসময় হারায়। নীতিশ রায়েরও তাই হয়। তার আন্ডারে যারা কাজ করতো তারাই এখন মনিব শ্রেণীর লোক। তারা জমিদার নামটি কিনে ফেলেছে অতি সহজেই। আর তার ভাইয়েরাও জমিদার নামটা হারায়নি। কিছু হলেও বুদ্ধির জোরে বাঁচিয়ে রেখেছে। শহরের বাড়িতে দালানের মতোই মাথা উঁচু করে থাকে। নীতিশ রায় অসুস্থতায়, নিজ কর্মের গ্লানিতে আর কিছু ভাবতে পারে না বা ভাবতেও চায় না। বেঁচেও থাকতেও চাইতো না। কিন্তু তার সুকন্যার জন্য কিছু করতে না পারলেও শ্বাস নিতে চায়, মেয়ের পাশে থাকতে চায় নিভু নিভু প্রদীপ হয়ে। ঐ আলো টুকু যে দরকার এখনো “নীতি”র পথচলায়। যখন তার মেয়ের পথে একটা উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলবে তখন সে নীরবে নিশ্চিন্তপুরে চলে যাবে।
এখন বিষয়-আশয় নেই তার বিষও নেই। টিউশনি করে বাপ মেয়ের দিন চলে যায় কোনরকম। পড়া শেষ হলে ভালো একটা চাকুরিতে ঢুকবে এই ভাবনায় আছে নীতি। এই বয়সী একটা মেয়ের আরো কত সুখ স্বপ্ন থাকে কিন্তু সেগুলোকে সে পাত্তা দেয় না। বরং এড়িয়ে চলে। সাজিদ এখনও ফোন করে। গ্রামে এলে জোর করে সাইকেল থামিয়ে কথা বলে। বুঝতে পারে সাজিদের স্বপ্নালু মন। কিন্তু নীতি জানে এগুলো ঘুমালী স্বপন… কখনো হবে না বপন। বাস্তবতা লৌহ দন্ড। তাই এড়িয়ে চলে। সাজিদের মা একদম পছন্দ করেন না ওদের মেলামেশা। ধর্মীয় বিষয় তো আছেই তাছাড়া এমন সাইকেল উড়া মেয়ের সাথে মিশতে দিতে চান না। অথচও ছোটবেলায় কত আদর করেছেন সাজিদের মা। ক্লাসে প্রথম স্থান পেতো নীতি। তার ছেলে দশের বাইরে ছিল। মেধাবী ছাত্রীর কদর ছিল। তখন জাতপাত যেতো না। অথচও এখন সুযোগ পেলেই দু’টো কথা শুনাতে ছাড়ে না। তবে নীতিও ছেড়ে দেয় না।
ওদিকে তার কাকাতো বোন প্রীতি কত যে সমন্ধ আনে বোনের জন্য। তার মনটা খুব ভালো। বোনের জন্য যেন তার ঘুম হয় না। নীতি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো প্রীতি দিদির কল গুলো মিসড্ কল হয়ে আছে। আর দু’দিন আগে সাজিদের কলও মিসড্ কল হয়েই আছে। কল করা দরকার। ফোনে ব্যালেন্স ছিল না আর ডাটাও শেষ। খুব একটা রাত হয়নি সন্ধ্যা রাত আরকি। গ্রামে অবশ্য এটাই বেশ রাত। এখন কি বাড়ির সামনের দোকানটা খোলা পাবো? দরজা থেকে উঁকি দেয় নীতি। হুম আলো জ্বলছে। দু’চারজন দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে বলে গেলো ফ্লেক্সি নিতে।
দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বললো, “বাপকা বেটি, একসময় বাপ নিশাচর ছিল এখন বেটি নিশিতা।”
-কি বললে, খবদার বাজে কথা বলবে না। জ্যাঠুকে সম্মান করতে পারোনি তোমরা, কুলাঙ্গার সন্তানের সাথে না থেকে স্বর্গে গিয়ে শান্তিতে আছেন জ্যাঠু। বাপকে দাম দাওনি । শুধু বাপের বিষয়-আশয়কে দাম দিয়েছো। তোমাদের তো দাদা বলতে আমার ঘেন্না লাগে। কথাও বলিনা। আমার সাথে কথা বলতে আসো কোন সাহসে?
-কি বললি? তোর এত সাহস নীতি, আঙুল তুলে কথা বলতে শিখেছিস? এখনো তো কোন পাশ-টাস দিসনি। মেয়ে হয়ে সকাল, সাঁঝ কেবল সাইকেল চালিয়ে বেড়াস। আর ঐ দু’পয়সার মাস্টারের ছেলের সাথে ঘুরিস। দাঁড়া, বাপকে নিয়ে এইচালার তলে তোর দিন ফুঁড়িয়ে এলো বলে।
কথা না বাড়িয়ে নীতি চলে এলো। তখন মেজাজ খারাপ করে গরম দেখালেও, জ্যাঠুর ছোট ছেলের কথা গুলো খুব ভাবাচ্ছে। এর আগে এই বিষয়-আশয় নিয়ে অনেক ঝামেলা করেছে। লোক দিয়ে বাবাকে মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তাই তো সব ছেড়ে দিয়ে শুধু মাথা গুঁজে আছি এই ভাঙাচোরা গ্রামের বাড়ির এক কোণায়। এটাও নিতে চায়? তাই তো ইঙ্গিত করলো। নানান রকম দুর্ভাবনায় নীতির চোখের পাতা এক হয়। বাবার গোঙানিতে নীতির ঘুম ভাঙে। পোড়া পোড়া গন্ধ। চারিদিকে ধোঁয়া। কানে ভেসে আসছে… আহারে বাপ-দাদার ভিটেটাও পুড়লো, মেয়েটার আসলে কপাল পোড়া।
ধসনামা বাড়ির ধোঁয়াশা’য় কেমন একটা জ্বালা অনুভব করলো নীতি। মনে হলো, যাদের বিষয়-আশয় নাই তারাই শান্তিতে আছে। বিষয়ের বিষের নীলে ভাসতে হয় না…বিষের জ্বালায় জ্বলতেও হয় না।
Views: 54