মুহিব চুপ করে বসে আছে ঘাসের উপর। সামনে টলমলে পানির পুকুর। মাঝে মধ্যে সেই শান্ত পানিতে মুহিব হাতের কাছ থেকে ইটের ছোট টুকরো তুলে ছুড়ে দিচ্ছে। শান্ত পানির বুকে গোল বৃত্ত তৈরী হয়ে বড় হতে হতে এক সময় মিলিয়ে যাচ্ছে সেই বৃত্ত।
রাজেশ এসে কাঁধে হাত দিয়ে ডাকে,
-মুহিব চল, পিকনিকের খাতায় নাম লিখাবি না? স্যার সবার নাম লিখছেন তো!
-আমার পিকনিকে যেতে ইচ্ছে করছে না রে! তুই স্যার কে গিয়ে বল।
রাজেশ চলে যায়। হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। সবাই পিকনিকে যাবার আনন্দে মেতে আছে। মুহিব সুযোগ বুঝে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে পুকুর পাড়ে বসে আছে। সব আনন্দ সবার জন্য নয় মুহিব সেটা জানে। তবে এ নিয়ে তার মনে কোন আক্ষেপ নেই।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। মুহিব ঘরে ফেরার জন্য উঠে দাড়ায়। এখন আর হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে না। হয়তো সবাই পিকনিকের লিষ্টে নাম লিখিয়ে বাড়ী ফিরে গেছে। মুহিব মনে মনে খুশীই হয়। সবার সাথে দেখা হলে একই প্রশ্ন করতো, কেন যাবি না মুহিব?
স্কুলের গেটের কাছে আসতেই মুহিব শুনলো হেডস্যার তার নাম ধরে ডাকছেন।
মুহিব ধীর পায়ে, মাথা নীচু করে এগিয়ে আসে স্যারের কাছে। তার গলাটা বড্ড শুকনো লাগছে।
-আচ্ছালামু আলাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আচ্ছালাম। একটু আমার রুমে আয়।
হেডস্যারের পিছু পিছু মুহিব এগিয়ে যায়। খুব অস্বস্তি লাগছে তার। না জানি স্যার কী সব প্রশ্ন করবেন। পৃথিবীতে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। কিছু উত্তর নিজের বুকের ভেতর লালন করতে হয়ে, আগলে রাখতে হয় নিজের মাঝে।
-মুহিব, পিকনিকে যাবি না কেন? কুমিল্লার ময়নামতি! সবাই মহাখুশী, তোর কোন পাত্তা নেই। সামনের বছর তো কলেজে চলে যাবি। স্কুল জীবনের এটাই শেষ পিকনিক!
মুহিব মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। হেডস্যার হাল্কা নীল রঙের একটা খাতা খুলে বসলেন।
-এখানে, এই যে দেখ তোর নাম লিখলাম। মুহিব বিন মাহবুব। জমা ছয়’শো টাকা। নে ধর, তোর নাম সই করে দে!
-কিন্তু স্যার, আমি তো টাকা আনি নাই! তাছাড়া এত টাকার কথা আমি বাসায় বলতে পারবো না স্যার! লেখাপড়ার পেছনে অনেক টাকা চলে যায়!
-সই কর মুহিব। বড় হয়ে এই টাকা আমাকে দিয়ে দিস যা! আমার প্রিয় ছাত্র পিকনিকে যাবে না তা কি হয় রে!
ষোল বছরের মুহিব আপ্রাণ চেষ্টা করেও চোখের পানি লুকাতে পারে না। হেডস্যার তার পিঠে হাত রাখেন।
-বাড়ী যা। বাবা-মা চিন্তা করবেন।
বাড়ী ফিরে মুহিব বাবা, মা’র কাছে, ছোটবোন নিশার কাছে সেই গল্প বলতে গিয়ে আবার চোখের পানি লুকাতে ব্যর্থ হয়।
শুক্রবার সকাল আট’টায় স্কুল গেট থেকে পিকনিকের গাড়ী ছাড়বে। আজ বুধবার।
শাহিদা ছেলের কাছে এসে পিঠে হাত দিয়ে দাড়ান।
-কিছু বলবা মা?
-বাবা, পিকনিকে তো সবাই ভালো কাপড়, জুতা পরে যাবে। তোমার তো তেমন ভালো কিছু নেই! গায়ের সোয়েটারটাও খুব পুরাতন। আমি না হয় তোমার জন্য একটা জ্যাকেট কিনে আনি!
-থাক মা, এখন খরচ করার দরকার নেই। একদিনের ব্যাপার মাত্র! সবাই আনন্দে থাকবে, কেউ কারো সাজ, পোশাক খেয়াল করবে না!
-তোমার আব্বা বলছেন এক জোড়া জুতা কিনতে। নরম, আরাম পাও এমন জুতা। অফিস যাবার সময় পাঁচ’শো টাকা দিয়ে গেছেন। তোমাকে মনসুর চাচার দোকানে গিয়ে জুতা পছন্দ করে নিতে বলছেন। এই টাকায় না হলে আর যা লাগে তা সামনের মাসে তোমার বাবা দিয়ে দেবেন। যাও বাবা, জুতা কিনে আনো। আমিও একটু বাইরে যাবো।
মুহিবের বুকের ভেতর কষ্টের মেঘ জমে। এই পাঁচ’ শো টাকার বাড়তি খরচটা আব্বা কীভাবে সামলাবেন? সে তিন’শো টাকার মধ্যে একটা স্যান্ডেল দেখে, পেয়েও যায়। পায়ে দিতে বেশী আরাম না, শক্ত সোল। সমস্যা নেই! এটা নিয়ে বিশ টাকা দিয়ে চারিদিক সেলাই করে নিতে হবে। তাতে টেকসই হবে স্যান্ডেল। আব্বাকে বলতে হবে, জুতা পরলে গরম লাগে। এক’শো আশি টাকা আব্বাকে ফেরত দিতে পারবে ভেবে মুহিব শান্তি পায়।
সকাল সাত’টার মধ্যে মুহিব গোসল করে দুটো রুটি বেগুন ভাজি দিয়ে খেয়ে নিলো। আব্বা পানির বোতল, এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট আর এক’ শো টাকার একটা নোট মুহিবের পকেটে দিলেন। মা একটা ব্লু রঙের জ্যাকেট ভাজ খুলে মুহিবের গায়ে ধরে বললেন,
-একদম মাপ মত হয়েছে!
-এটা আবার কেনার কী দরকার ছিল মা?
-সমস্যা নেই, বাপ। তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
-খুব পছন্দ হয়েছে। এটা আমার প্রিয় রং। পরে আরাম পাচ্ছি মা।
শাহিদার চোখে আনন্দ বেদনার মিশ্র অশ্রুকণা। ছেলে জানতে চায় নি কোন দোকান থেকে কেনা। লেখা পড়ার বাইরে অন্যান্য বিষয়গুলো মুহিব যেন এড়িয়ে চলে, কিংবা চলতে হয় পিতা, মাতার সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে।
বান্ধবী পারুলের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে এই জ্যাকেট কিনেছে শাহিদা ছেলের জন্য। ব্লু জ্যাকেটটা যে মুহিবের সাইজ মত পাওয়া গেল! দোকানে ঢুকে তো শাহিদা অবাক! জামা কাপড়ের এতো দাম এসব দোকানে!! একটা জ্যাকেট পছন্দ হলো কিন্তু দাম বারো’শো টাকা! ভাবা যায়!
শাহিদার তিন’শো টাকা সম্বল। মন খারাপ করে বের হয়ে আসে দোকান থেকে সে। ছেলেমেয়ের প্রয়োজনগুলো মেটাতেও অপারগ সে। তার সেই সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে খুব কান্না পায়। এই বয়সী ছেলেদের মনে কত শখ থাকে, আবদার থাকে!
ফুটপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শাহিদার চোখ পড়ে একটা ভ্যানে অনেক রকমের জ্যাকেট। এক’শো! এক’শো..বলে একজন চিৎকার করছেন! যা নেবেন তাই এক’শো!!
শাহিদা এগিয়ে যায়। একেবারে মন্দ নয়। বাসায় গিয়ে ধুয়ে আয়রন করে নিলে মুহিব বুঝতেই পারবে না এটা ফুটপথের জ্যাকেট। কি যে সুন্দর নীল রঙ!
রাত নয়’টার পর মুহিব ফিরে এলো। একটা কাগজের বক্স ছোটবোন নিশার হাতে দিয়ে বললো, তোর জন্য! একটা আপেল, একটা সমুছা আর একটা মিষ্টি। নিশা সমুছা মাকে দিয়ে আপেল আর মিষ্টি নিলো। শাহিদা সমুছা দু’ভাগ করে অর্ধেক স্বামীর মুখে দিয়ে মুহিবের দিকে তাকালো।
-তুমি না খেয়ে বাসায় নিয়ে এলে কেন বাবা?
-মা আমি তো কত কী খেলাম। ওখানে পৌছেই নাস্তা, তারপর দুপুরে পোলাও, কাবাব, রোস্ট, কোক! বিকেলে আবার এই নাস্তার প্যাকেট। এত কি খাওয়া যায় বলো? তাই নিয়ে এলাম।
-অনেক আনন্দ হলো বুঝি?
-হ্যা, অনেক অনেক আনন্দ হলো মা! সবচেয়ে মজার কথা কি জানো, বন্ধুরা সবাই আমার জ্যাকেট দেখে পাগল! কি সুন্দর! কি সুন্দর!! আন্টি কোথা থেকে কিনলেন, কত দাম? আমরাও কিনবো!!
-তুমি কী বললে?
-বললাম, আমার মা আমার জন্য সেই জিনিসটাই কেনেন যেটার আর কোন কপি হয় না!
শাহিদা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ বদলান।
-খুব ক্লান্ত হয়ে আছো। হাত, মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে আসো, তোমার আব্বা খাবার নিয়ে বসে আছেন।
———————-
রাত গভীর হয়ে আসছে, মুহিব জেগে। পিকনিকের ক্লান্তি ছাড়িয়ে বারবার মা’র মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
মিরপুর দশ নাম্বার থেকে স্যান্ডেল জোড়া কিনে যখন সেলাই করাচ্ছিল মুহিব, তখন হঠাৎ চোখে পড়ে রাস্তার ওপাশে ভ্যানের সামনে মা কি যেন কিনে ব্যাগে ভরে দ্রুত পা চালালেন। মুহিবের কানে ভাসছে, যা নেবেন এক’শো! এক’শো! এক’শো!!!
এই সংসারে মায়েরা যেমন নিত্য অভিনয় করেন ভালো থাকার, সন্তানদেরও কখনো কখনো এমন অভিনয় করে যেতে হয়, ভালো আছি, খুব ভালো আছি মা!
মুহিব চেয়ারের উপর থেকে ব্লু জ্যাকেটটা টেনে নেয় বুকের কাছে। এই জ্যাকেটে তার মায়ের সবটুকু ভালোবাসা, এই জ্যাকেট তো দাম দিয়ে কেনা যায় না!
Views: 188