বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে- ‘শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য’। অর্থাৎ দেহ ও মন ভালো থাকা মানেই স্বাস্থ্য ভালো থাকা। দেহ ও মন পরস্পরের পরিপূরক। শরীর যতই সুস্থ থাকুক, ভালো কিছু করার জন্য মানসিক সুস্থতা আবশ্যক। মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে, মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতির সুষ্ঠু সমন্বয়। এই মানসিক বিষয়গুলোর সঠিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই মানুষ তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে সম্পাদন করে এবং পরস্পরের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে। এসব যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে মানব শিশুকে উত্তম মানুষে পরিণত করার জন্য শিক্ষকের ভূমিকা অপরিহার্য।
মনমানসিকতা উত্তম না হলে উত্তম কর্মের উপযোগী হয় না মানুষ। এরিস্টটলের মতে- ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই শিক্ষা’। সুস্থ মন গঠন একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া! ছোটবেলা থেকে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রেখেই গঠন করতে হয় শিক্ষার্থীর সুস্থ মন। যিনি এই কাজে যত বেশি সফল তিনিই তত বেশি উত্তম শিক্ষক। বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান বা মোকাবিলা করে সঠিক পথে এগিয়ে চলার জন্য শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক শক্তি লাভের জ্ঞান-দক্ষতা প্রদান করা শিক্ষকের গুরু দায়িত্ব। শিক্ষার্থীর মনকে এমনভাবে গঠন করতে হয় যেনো সে কোনদিন ভেঙ্গে না পড়ে ব্যর্থতায়, নিমজ্জিত না হয় বিষন্নতায়। স্বপ্রেষিত হয়ে সে যেনো নিজেই আজীবন ধরে রাখতে পারে নিজের কর্মোদ্যম ও মানসিক সুস্থতা।
প্রেষণা হচ্ছে মানসিক সুস্থতার প্রধান উপাদান। এই উপাদানটি শিক্ষার্থীর মনে চিরদিনের মতো প্রোথিত করে দেওয়াই উত্তম শিক্ষকের কাজ। যিনি এই কাজে সফল তিনিই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শিক্ষা প্রদানের চেয়ে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রেষণার অফুরন্ত শক্তিতেই সম্ভব দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রয়োগ। মূলত প্রেষণার শক্তিতেই সাধিত হয় কর্ম, অর্জিত হয় অগ্রগতি। যে শিক্ষার্থী নিজের মধ্যে প্রতিনিয়ত শুভ কাজের অনুপ্রেরণা উৎপাদন করতে পারে সেই মানসিকভাবে সুস্থ ও সবল। অনুপ্রাণিত মানুষই অবিষন্ন, উদ্যমী। শিক্ষার্থীর মধ্যে এই প্রেরণা উৎপাদনের ক্ষমতা জাগ্রত করাই শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ফেডরিক হার্বার্ট এর মতে- “শিক্ষা হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন”। একান্ত আপনজন হয়ে খুব কাছে থেকে শিক্ষার্থীকে পর্যবেক্ষণ করে তার বয়স অনুসারে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বুঝে বারবার দিতে হয় প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তার পরিবারের সদস্যদের সাথেও করতে হয় মত বিনিময়। সুস্থ দেহ গঠনের জন্য যেমন গড়ে দিতে হয় সঠিকভাবে নাওয়া, খাওয়া, ঘুম, ব্যায়াম, বেড়ানো ও খেলাধুলার অভ্যাস; তেমনি নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে সুস্থ মন গঠনের জন্য দিতে হয় মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ এবং ভালো কাজ করার উৎসাহ, উদ্দীপনা ও মনোবল। সেইসাথে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জাগ্রত করতে হয় সঠিক ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা মানব প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, দেশ প্রেম, জাতীয়তা বোধ, ন্যায়-নীতি বোধ, সৃজনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, দায়িত্ব-কর্তব্যপরায়নতা ইত্যাদি মহামূল্যবান গুণাবলি। তবেই মানব শিশু হয়ে উঠে প্রত্যাশিত সুস্থ মনের অধিকারী তথা সুশিক্ষিত মানুষ। তবেই সে সঠিকভাবে পালন করতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য এবং করতে পারে পরস্পরের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এ+ ফলাফলের পাশাপাশি এ+ মানুষ গড়ার এই মহান ব্রতে মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। তাই শিক্ষককে হতে হয় অত্যন্ত মেধাবী, আগ্রহী, উদ্যমী, ধৈর্যশীল, নিবেদিত, অনুপ্রাণিত, প্রশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষার্থীর সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির মাধ্যমেই শিক্ষক হয়ে উঠেন পরম শ্রদ্ধার পাত্র এবং দেশ ও জাতি হয়ে উঠে চির উন্নত।
লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
Views: 104