‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ – যুদ্ধদিনের বিভীষিকা
—রেজওয়ান আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশিরভাগ সাহিত্যেই পূর্ণ নয় মাসের সংগ্রামমুখর বাস্তবতা আসেনি। তা না আসুক। সমগ্র দেশের মুক্তির সংগ্রামে মাঠপর্যায়ে অংশ না নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তখন। বিশেষত ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সামনে মুখ বন্ধ রাখতে, ঘৃণা জানাতে যে সাহস, দেশপ্রেম প্রয়োজন সেসবও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ উপন্যাসের কাহিনি যাকে ঘিরে আবর্তিত, তার সরাসরি অংশগ্রহণ যুদ্ধে না থাকলেও আমরা তার অভিজ্ঞতার আলোকে যুদ্ধ দেখতে পাই উপন্যাসে। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং অত্যাচারের বিবরণের পাশাপাশি ঘৃণা জানাতে দেখি।
গাজী রহমান। এক স্কুলশিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ের ঘূর্ণাবর্তে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরকম একটা অবস্থায় তাঁকে এক পুরনো ছাত্রের বাসায় আশ্রয় দিয়ে কাহিনীর সূত্রপাত করেছেন শওকত ওসমান। তিনি একাই তখন পাকসেনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত এমন নয়। নির্বিচারে বাঙালি নিধন চালিয়েছে ওরা সে সময়। গাজী রহমান তার সাক্ষী হয়েছেন পথে পথে পলায়নপর অবস্থায়। কাছেপিঠের সকলের পরামর্শই এক – নিরাপদ স্থানে যাতে আত্মগোপন করেন তিনি।
রেজা আলি, কিরণ রায় এবং সৈয়দ আলি উপন্যাসের তিনটি. গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এঁরা তিনজনই গাজীর হিতৈষীরূপে আবির্ভূত হন। মূলত এঁদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান গাজী রহমান।
সীমানার এপার-ওপার প্রাকৃতিক পরিবেশে দৃশ্যত কোনো পার্থক্য নেই। ভয়াবহ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে যুদ্ধবাস্তবতা। সে ভয়াবহতা এতটা যে, পূর্ববাংলায় উদ্ভূত পরিবেশকে ঔপন্যাসিক জাহান্নমের সাথে তুলনা করেছেন। প্রতীকী পরিচর্যায় অগ্নিদাহনের কথা এসেছে উপন্যাসে। আগেকার দিনে অসাবধানতাবশত আগুন লাগত গ্রামের গৃহস্থালিতে। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে এমন বিবরণ পাওয়া গেছে। এখনো এ ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু আরোপিত অগ্নিসংযোগ আর দৈবক্রমে, অসাবধানতায় অগ্নিকাণ্ডের মৌল পার্থক্য সূচিত করে ক্ষতির পরিমাণ। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাঞ্জাবি হানাদারদের আরোপিত অগ্নিসংযোগ ছিল মূলত বাঙালিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার নীলনকশার অংশ। স্থানে স্থানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ বাঙালির বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশলের প্রমাণ দিলেও পাক হানাদারদের বর্বরতা ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। এরকম একটা অবস্থায় গাজী রহমানের মধ্যে যে যুগপৎ ভয় এবং হীনম্মন্যতার মানস শওকত ওসমান এঁকেছেন, তা নিদারুণ বাস্তবসম্মত। তাঁর এই নড়বড়ে মানসিক অবস্থায় তাঁকে নিরন্তর সাহস যোগানোর চেষ্টায় সমুজ্জ্বল গুরুত্বপূর্ণ দুটো চরিত্র রেজা আলি এবং কিরণ রায়।
গাজী রহমানের দেখা ধ্বংসযজ্ঞের তাঁর বন্ধু রেজা আলিও সাক্ষী। এরকম মানবসৃষ্ট ধ্বংসলীলার একটা চিত্র আমরা সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবানে’ও দেখি। অবশ্য তিনি বিহারিদের নিষ্ঠুরতার চিত্র এঁকেছেন বিশেষ করে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পরেও বিহারিদের দৌরাত্ম্য কমেনি বরং আরো বেড়ে গিয়েছিল তাদের নৃশংসতার মাত্রা। ইতিহাস সেকথাই বলে। বিহারি প্রসঙ্গ এজন্য টানা যে ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ নেওয়ার পথে গাজী রহমানের সাথে আমরাও উপন্যাসে সাক্ষী হয়েছি – পাকিস্তানি সেনাদের কাছে বিহারিরা পরিচয় দেওয়ামাত্র মাফ পেয়ে যেত। ‘গেরিলা’ (‘নিষিদ্ধ লোবানে’র চলচ্চিত্ররূপ) সিনেমায়ও খুব সূক্ষ্মভাবে এ বাস্তবতা দেখানোর চেষ্টা ছিল।
গাজী রহমান এবং রেজা আলির চোখে মূলত পাঠককেই শওকত ওসমান দেখাতে চেয়েছেন ধ্বংসলীলার ভয়াবহতম প্রতিচ্ছবি। গাজী রহমান চরিত্রের আশ্রয়ে প্রতীকায়িত পরিচর্যার গুরুত্বপূর্ণ একটা আভাস দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন ঔপন্যাসিক।
“এমন এক শত্রুর পরিচয় আবহমান কাল থেকে ইতিহাসে কখনও পায়নি বাঙালি। তাদের কী আখ্যা দেবে – জন্তু, দানব বা আর কিছু, তাও বাঙালি কোনদিন স্থির করতে পারবে না। তেমন ঘৃণা প্রকাশের ভাষা বাঙালির কাছে এখনো অজ্ঞাত। তা হয়তো ভবিষ্যতে তৈরি করবে তার চারণ কবিবৃন্দ।”
দুবছর পরে শওকত ওসমান নিজেই তাদের ‘নেকড়ে’ বলে আখ্যায়িত করলেন (‘নেকড়ে অরণ্য’ – ১৯৭৩)। প্রায় সমসাময়িক কবি অমিয় চক্রবর্তী ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতায় লিখলেন – “… ওরা কারা বুনো দল ঢোকে …”
এই বুনো নেকড়েরা যে অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে, তার বিবরণ বোধকরি একবাক্যেই দিয়ে দিতে পেরেছেন ঔপন্যাসিক – “বুটের ঠোক্করে থেঁতলে গেছে বাংলাদেশ।” গদ্যের এতটাই শক্তি বোধকরি বোদ্ধার দূরতম বিশ্লেষণকে হার মানাতে যথেষ্ট।
গাজী রহমানের স্মৃতিপটে ভাস্বর যেসব চরিত্র তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধের জবানিতে এক রোমহর্ষক সত্য উঠে আসে। বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস নাতিদীর্ঘ নয়। চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন বাঙালির গোলামির ইতিহাসে পর্যবসিত বলেই একদিন ফুঁসে ওঠে বাঙালি। তবে তার প্রাক-ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। বাঙালি সেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়ে স্লোগান দিয়েছিল –
“হাত মে বিড়ি মু মে পান
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান!”
সেই পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণে সেই বাঙালিই প্রজন্মান্তরে স্লোগান দেয় “জয় বাংলা!”
বাঙালির পাকিস্তানপ্রীতির আজকের প্রসঙ্গ কথিত হিসেবে ভিন্নতর হলেও দেশবিভাগের প্রাক্কালে পাকিস্তান যে কতটা প্রার্থিত ছিল এবং তা যে কতটা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত আন্দোলনে অর্জিত তার কিছুটা বিবরণ আবু ইসহাকের কালজয়ী উপন্যাস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ (এ উপন্যাসে স্বাধীনতা, নতুন পতাকা প্রসঙ্গে হাসু-মায়মুনের উচ্ছ্বাস-আগ্রহে জয়গুনের মাতৃপ্রতীম প্রশ্রয়, উৎসবমুখর পরিবেশের গদ্যরূপ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়) দেয়। আর দেয় সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। অবশ্য প্রসঙ্গ বিচারে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ‘জাহান্নম হইতে বিদায়ে’র অধিকতর নিকটবর্তী।
ক্ষুদ্র পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’। পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে হয়ত এটা একটা কাপুরুষের পলায়নের আখ্যান। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সম্মুখযুদ্ধে না দাঁড়িয়েও যুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিভাত থাকা সম্ভব – এমন একাধিক ইঙ্গিত উপন্যাসে একাধিক জায়গায় রয়েছে। বুদ্ধিমান পাঠকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেসব খুঁজে বের করা।
▪
রিভিউ লেখক:শিক্ষার্থী-গবেষক,
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ (ষষ্ঠ আবর্তন),
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
Views: 125