আমি মা
দোলা ইসলাম
-
প্রথম পর্ব
পৃথিবী শব্দহীন, শুনশান নীরবতা। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে বোঝা যাচ্ছে রাতের বয়স বেড়েছে। দূরে পরপর কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। বুকের সাথে তিন-চারদিন বয়সী ক্রন্দনরত শিশুকে চেপে ধরে বেসুরো গলায় গান গেয়ে যাচ্ছেন একজন নতুন মা। আর বাংলা ইংরেজিতে জগাখিচুড়ি করে গুগল করে যাচ্ছেন, ক্লাসে গুগল আপা নামে খ্যাত চারদিন বায়সী মা,
“How do you calm a crying baby/fussy baby at night” অথবা Lullaby শুনিয়ে যাচ্ছেন একটার পর আরেকটা। গুগলে সার্চ করে আগেভাগে যা জেনে এসেছেন কোনটাই তেমন কোন কাজে দিচ্ছেনা। একটু থেমে আবার কেঁদে উঠবে এই শঙ্কায় রাত পার করে কোনমতে বেচারি মা। সকাল-দুপুর-রাত সব এখন এক। সে এখন দিনরাত চব্বিশ ঘন্টার জন্য মা! দিনের আলো, রাতের আঁধার সব এক এই আঁতুড়ঘরে।
এমন ঘটনা নতুন না। অনেকেই জীবনে এমন দুয়েকটি আতংকিত রাত পার করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন হয়তো। কিছু ব্যাপার এমনিতেই হয় কিন্তু কিছু ব্যাপার স্বাভাবিক না। কোন বাচ্চা অনেক বেশি আতংকিত করে তার আচরণের মাধ্যমে সাধারণত দুটি কারনে। প্রথমত মায়ের ভুলে, দ্বিতীয়ত মা-বাবার থেকে পাওয়া জিনগত কারনে।
এবার মায়ের ভুলে কিভাবে বলার আগে একটা কথা বলে নেই, আমি শিশু বিশেষজ্ঞ নই, ডাক্তারি বিদ্যা জানিনা কিন্তু নিজের ভুল থেকে যা বুঝেছি তাই বলছি এখন।
এবার বলছি, মায়ের ভুল কেন বলছি? মাতৃগর্ভেই মানবশিশু মায়ের অনুভূতি অনুভব করতে পারে। মায়ের হাসিতে, মায়ের খুশিতে সে যেমন ভাল অনুভব করে তেমন মায়ের মানসিক যন্ত্রণাও সে বুঝতে পারে। অনেক রিসার্চ এ বের হয়ে এসেছে যে মাতৃগর্ভেই বাচ্চা বুঝে যায় কে তার শত্রু? কে তার কাছের লোক? জন্মের পরে মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করা মানুষদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার অপারগতা দেখা যায়। ভ্রুণ থেকে মানুষ হবার ঠিক আগ মুহূর্ত থেকেই তার শেখার চেষ্টা শুরু হয়।
যাই হোক দেখা গিয়েছে যে গর্ভকালীন সময়ে যেকোন রকম মানসিক চাপ বাচ্চার উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। সামাজিক, পারিবারিক অসহযোগিতা, কাছের মানুষদের দ্বারা মনে আঘাত পাওয়া অথবা স্বাভাবিকভাবে যা তার পাওয়ার কথা তা না পাওয়া এগুলো যে মানসিক অবস্থার তৈরি করে তার প্রভাব ভীষণ রকম খারাপ হয়ে ওঠে অনাগত শিশুটির মানসিক বিকাশে। যার হিসেব গুনতে হয় মায়ের বাকিটা জীবন। এরকম বাচ্চা বড় করার সময় মায়ের যে অতিরিক্ত ঝক্কি পোহাতে হয় আর বাচ্চার যে মানসিক ক্ষতি হয় তার হিসেব ক’জনে রাখে! মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় তার ২৫% বিকাশ হয়ে যায় আমরা যা টের পাইনা, বুঝতেও পারিনা। কিছু জিনিস খেয়াল করলে আমরা আশ্চর্যজনক অনেক কিছু দেখতে পারব। এটা নিয়ে পরে কথা বলব।
আমাদের দেশে অথবা আমাদের সমাজে হবু মায়ের খানাদানা নিয়ে মানুষজন খুব বিচলিত থাকেন কিন্তু মনের বেলায় প্রায় ষোল আনা অচেতন হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশন, বেবি ব্লুজ এগুলো অর্থহীন কিছু শব্দ মাত্র, অতিরিক্ত ঢং ছাড়া কিছুই না। ডিপ্রেশনে ভোগা নতুন মায়ের কান্নাকাটি মানুষের বিরক্তির কারন। বেবি ব্লুজে আক্রান্ত নতুন মায়ের প্রাণ ত্যাগে ছিঃ ছিঃ করে সমাজ ক্লান্ত। কিন্তু এর প্রভাব পুরোটাই বুঝতে পারে ওই পরিবারটি আর ওই শিশুটি যে তার মাকে ছাড়া অবহেলায় বড় হচ্ছে।
আচ্ছা, সব ব্যাপারে সাবধান হওয়া মা যদি গর্ভের বাচ্চার ভালোর জন্য কিছু ব্যাপার উপেক্ষা না করে বেশি বেশি এসবরের মধ্যে ডুবে থাকে তাহলে সেটা কি মায়ের ভুল না? কারণ যতটুকু ভুগতে হবে সব তারই। সারাজীবন কষ্ট ভোগ করার যন্ত্রণার থেকে ৯ টি মাস কিছু জিনিস উপেক্ষা করতে পারার অভ্যাস করা উচিৎ কি না? যেকোন দুর্ভোগ তার একারই পোহাতে হবে যখন, প্রেগন্যান্টদের মানসিক স্বাস্থ্য যেখানে উপেক্ষিত সেখানে নিজের দায়িত্ব নিজেরই নিতে হবে বৈকি! এসবের জন্য যতটা শক্তি দরকার ঠিক ততটা দরকার সুবোধ, যখন মনে হবে তখনই কেবল মা হবার কথা ভাবা উচিৎ। না হয়, নিজে যেমন কষ্ট পাবে তেমন বাচ্চার মানসিক বিকাশ ঝুঁকির মুখে পড়বে। অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ একটি বাচ্চা সামলানো যেমন কষ্টের তেমনি বাচ্চাটির ভবিষ্যতের জন্যও সেটি বিপদজনক। তাই সব বুঝে হবু মায়েদের উচিৎ নিজের চারপাশে শক্ত দেয়াল জুড়ে দেওয়া যাতে কোন কথার ধারালো অস্ত্রের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে। দরকার পড়লে একঘরে হয়ে থাকা, নিজের প্রয়োজনে কিছুটা সময়ের জন্য বের হয়ে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আবার গুহাবাসী হওয়া। বেশিদিনের জন্য না, মাত্র তো নয়টি মাস! এর ফলাফল যে কত্ত সুন্দর হতে পারে তা ভেবে কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই আমার। কারণ আমি ঐ সময়টি হেলায় হারিয়েছি, কারণ আমি সাবধান হই নি, কারণ আমার আশেপাশের মানুষজনের কথায় সদা পরিবর্তনশীল মনটি নিয়ে বিপাকে পড়ে দিনরাত এক করে শুধু কেঁদেছি। তাই বলব, যা কিছু ভুল সব আমার; কারণ আমি মা!
আমি একজন কিশোরী মা না। সব বুঝেশুনে মা হবার কথা ভেবেছি। গর্ভকালীন অবস্থায় অনেক মাধ্যম থেকে অনেক কিছু জেনেছি কিন্তু কোন লাভ হয় নি। গুগল কিন্তু বারবার সতর্ক করেছে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। বাকি অনেক কিছু মানলেও এটা মানতে পারিনি। আশেপাশের মানুষের কারণে নিজের এবং নিজের সন্তানের জন্য বিপদ ডেকে এনেছি। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাগত উপেক্ষা, আর সব জেনেও অবুঝের মতো নিজের উপর সব দায়ভার চাপিয়ে যে অত্যাচার নিজের উপর করেছি তার যে ভোগান্তি তাও আমি একাই ভুগছি। ওই সময়ের কিছু ভুলের চড়া দাম দিতে হচ্ছে এখন আমার যার রেশ চলবে বাকি জীবন আমার আর আমার সন্তানের।
যাই হোক,
আমি এখন ২৫ মাসের মা। অনেক কিছু পার করে এসেছি। কিছু ব্যাপার অনেক কষ্টের ছিল আর কিছু ব্যাপার একটু সাবধানতার জন্য এড়িয়ে যেতে পেরেছি। আর আল্লাহ সাহায্য করেছেন আমার এই কণ্টকাকীর্ণ পথ চলতে, জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাই এটা তিনি চেয়েছেন বলেই বেঁচে আছি আমি।
আমি আজ এই লেখাটি লিখছি কারণ এমন আর একটি ঘটনাও যেন না ঘটে আমার আশেপাশে, পরিচিতদের জীবনে। সরাসরি গিয়ে অনেকের পাশে থাকতে পারবো না হয়তো কিন্তু কোন না কোন ভাবে যেন নতুন মায়েরা সতর্ক হয়ে তার আর তার সন্তানের সুন্দর জীবন গড়তে পারে এই জন্য আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
কি কী করেছি একটি না ঘুমাতে চাওয়া বাচ্চা নিয়ে, না খেতে চাওয়া বাচ্চার জন্য কি কী করি, অকারণ কান্না করা বাচ্চা সামলাতে, খুব বেশি রিযেক্ট করা বাচ্চাকে কিভাবে সামলেছি অথবা এখনও কি কি বিষয় খেয়াল করে চলি আমি এগুলো নিয়ে সামনের পর্বে লিখব। একসাথে লেখলে বিরক্ত হবেন সবাই। আমি লিখতে চাই কারণ আমি খুব করে চাই সুন্দর একটি সমাজ যেখানে শারীরিক আর মানসিক ভাবে সুস্থ্য, সদা হাস্যজ্জ্বল কিছু মানুষ ঘুরেফিরে বেড়াবে। অকারণ হাহাকার করা মানুষ দেখতে কার-ই বা কতদিন ভালো লাগে!
ভালো থাকুন সবা।
চলবে..
Views: 149