এক স্থিরচিত্রের বয়ান আর আবহমান বাংলা: ঠাকুর বন্দনা
—লাবণ্য শাহিদা
🕳১
সাহিত্যের সব শাখাতে আমাদের ঠাকুর মহাশয়ের বিচরণ ছিল মহীরুহের মত। চর্যাপদের বাঙ্গালির মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাস থেকে শুরু করে আধুনিক বাঙ্গালির যাপন, সবকিছুতে বাংলা সাহিত্য সিক্ত। হেমনলিনী থেকে শুরু করে অমিত কুমার অথবা রতন গুটি গুটি পায়ে বাংলা সাহিত্যের বিচরণ একসময়ে এসে পৌঁছে যায় রাজনৈতিক দর্শনের এক নিখুঁত বলয়ে। সেই দর্শনকে ঠাকুরমশায় ‘কালান্তর’ নামে অভিহিত করে। এ যেন বাংলা সাহিত্যের উম্মাদনা যৌবন রূপ থেকে স্থির এক ভাবনার উম্মেষের পথ!
কালান্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনে রচিত যার ভিত্তি বস্তুগত। মুলত এটি একটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ সংকলন। প্রকাশকাল বৈশাখ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ।রতন সিদ্দিকী এ প্রবন্ধের বাণীসমূহকে বলেছেন ‘প্রভুসম্মিত’। কারণ,এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়বস্তু ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ। বিষয়বস্তুর প্রাধান্যই এখানে মুখ্য। মোট বত্রিশটি প্রবন্ধের সমন্বয় ঘটেছে এই আলোচ্য গ্রন্থে। পরবর্তী সংস্করণ রবীন্দ্রনাথের সভ্যতার সংকট অভিভাষণটি এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিখ্যাত সমালোচক শিশিরকুমার দাশের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতের সামগ্রিক বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় ‘কালান্তর’ গ্রন্থে’।
উপমহাদেশের বিবাদ আর ভ্রাতৃপ্রেমের এক স্থায়ী উদাহরণ হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ, যেটা উঠে এসেছে এই প্রবন্ধের প্রতি পৃষ্ঠায় আধুনিক মননের সুপ্ত রূপে। কী পাবেন না এতে আপনি? ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। ইংরেজ রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে, নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে।’ প্রথম জীবনে ইংরেজ শাসনের প্রতি রবীন্দ্রনাথেরও মোহ ছিল; পরে তিনি এ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন। কালান্তরে উঠে এসেছে সেই মৌহভঙ্গের স্থিরচিত্র। ব্রিটিশ শাসনের মোহভঙ্গের যন্ত্রণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদের সুনিপুণ তুলির আঁচড়। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন এ প্রসঙ্গে উল্লেখের অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সমাজসেবাকে তিনি রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখেননি।’ কালান্তর রবীন্দ্র চেতনার বিস্ফোরণ, অর্ধশতাব্দী কাল-পরিসরে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার রূপান্তর ঘটেছে একাধিকবার। কালান্তরে তার প্রত্যেকটি রূপান্তর ভেসে এসেছে বাস্তবিক উপাখ্যানে।
এবার একটি গল্প বলি, হাজার বছরের পুরোনো একটি বাড়ি। যার চারপাশে জড়িয়ে বিছিয়ে রয়েছে ঘুণেধরা পলেস্তারা, জং আর আগেকার আবাসের চিহ্ন। বাড়িটিতে থেকে গেছে দুটি পরিবারের মানুষজন। বাড়িটির চারপাশে রয়ে গেছে সেসব মানুষের রেওয়াজের চিহ্ন, ধর্ম আর প্রথার চেহারায়। একসময় এ বাড়িতেই রামনিধিগুপ্ত থেকে শুরু করে এন্টনি ফিরিঙ্গী, রামপ্রসাদ সেন রেখে গেছে এক এক করে কর্মের ফল। বাড়িটির দ্বিতীয় পরিবারের গল্পতো বলা হয়নি। প্রথমেই বলেছি এখানে দু’টো পরিবারের বাস ছিল। আরেক পরিবারটি কিছুটা ভিন্ন চেতনার হলেও তাদের দুজনের মিলনে বাড়িটি স্থবিরতা কাটে। সুখের দিনের সমাপ্তি ঘনিয়ে এলো একদিন! বাণিজ্যের একদল এলো বাড়িটির এই রূপ লাস্যময়তা দেখে! তারা বিভিন্ন চাকচিক্যের দোহায় দিয়ে একদিন ঢুকে যায় সম্প্রীতি ভরা পরিবার দুটির মধ্যখানে! যে ভাবনায় আর আশাতে পরিবার দুটি এই চাকচিক্যে পা দিয়েছিল, একসময় দেখা দিল সেটা শুধু তাদেরকে পোড়াচ্ছেই! আমাদের এ বাড়িটি ভারতবর্ষ, যার দুই পরিবার হিন্দু-মুসলমান আর বাণিজ্য দলটি চিনতে আশা করি পাঠকের মুস্কিল হচ্ছেনা! জোর করে ঢুকতে হয়নি, হয়না। রবীন্দ্রনাথ অনেক বছর আগে থেকেও বুঝে গেছিল আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক রূপ! কালান্তরের প্রথম প্রবন্ধের এটা সারমর্ম রূপ।
এবার আপনাদের নিয়ে যায় আরেকটি গল্পে। একটি গ্রামের গল্প, যার ছিল এককালে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু দিনকে দিন তা ক্ষয়ে যায়। এ গ্রামেই কিছু যুবকরা এক হতে থাকে প্রতিটি অন্যায়ের বিলোপে। একি গ্রামে আবাস প্রত্যেকের। গ্রামটিতে নিয়ম-কানুন খুব কড়া। এরই মাঝে গ্রামের হাট থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শহরের কেন্দ্রে। শিক্ষা-দীক্ষা আর স্বাধীনতা নেই বললেই চলে গ্রামটিতে। তার মাঝে আবার শোষনের বেড়াজাল! এক সময়ে যুবকদের সম্মিলিত শক্তি ডাক দেয় সশস্ত্র সংগ্রামের! একে একে মারা যায় অজস্র যুবপ্রাণ। কিন্তু গ্রামের আকাশ যেন অসংখ্য নিষেধের আবরণে বাঁধা। যেটা কেড়ে নেয় বিপ্লবের সমস্ত প্রাণ। উপরের গল্পের এ আকাশ আসলে আমাদের ভারতবর্ষের আকাশ! যেটা প্রাণের বেগকে গতিহীন করে দেয় ঐতিহ্য আর ভক্তির অজুহাতে। কালান্তর প্রবন্ধের বিবেচনা ও অবিবেচনা প্রবন্ধের সারমর্মের বয়ান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন এখানে,
“কিন্তু সে দুঃসাহস নাই তাহারা আজও মধ্য অরণ্যতলে মুঢ়তার স্বকপোলকল্পিত বিভীষিকার কাঁটার বেড়াটুকুর মধ্যে যুগযুগান্তর গুঁড়ি মারিয়া বসিয়া আছে”।
আবার বলেছেন, “পৃথিবীর সমস্ত বড়ো সভ্যতাই দুঃসাহসের সৃষ্টি”। এই দুঃসাহসকে অবিবেচনার আবরণে লেখক আসলে সবচেয়ে বড় বিবেচনায় বলে আখ্যায়িত করলেন যেন।
স্বদেশী সমাজ নির্মাণে প্রয়াসী রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে এক সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের স্বরূপ অন্বেষণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, গোরা রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক উপন্যাস। ব্রিটিশ শাসনের এক অগ্নিবাণী উঠে এসেছিল রবীর প্রতি স্পর্শে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের জন্মেরও কয়েক বছর আগে কার্ল মার্কস তার ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে এ পরিবর্তনকে মান্যতা প্রদান করেছেন এভাবে, ‘ইংরেজরাই ভারতীয় সমাজের সমগ্র কাঠামোটাই ভেঙে দিয়েছে, পুনর্গঠনের কোনো লক্ষণ এখনো অদৃশ্য। … ব্রিটিশ-শাসিত হিন্দুস্তান তার সব অতীত ঐতিহ্য তার সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে।’ একসময় বাহুবলে রাজ্য জয় হত। একসময় মেধার আঁচড়ে শাসনের পূর্নবাসন ঘটে। পুজিবাদের রূপে, যাকে আমরা বলি পুজিবাদী সমাজব্যবস্থা! লোকের হিত করার প্রয়াসের সমন্বয় প্রবন্ধ লোকহিত; দেশের সংস্কারাচ্ছন্ন জীবন ও জনমণ্ডলীকে বিদ্রুপ প্রদর্শনের সমান্তরালে, এ জীবনের নাগপাশ মুক্ত হয়ে বাঁচার প্রেরণাও সঞ্চার দিয়েছেন যেখানে লেখক!
উনিশ শতক বাংলা আধুনিক সাহিত্যের বিকাশের সময়।এ শতক বাংলার কথিত রেনেসাঁসের কনিষ্ঠ সন্তানরূপে ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমনের মতো। এই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস ছিল। তিনি এ শতককে বিবেচনা করেছিলেন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে। তার একটি বিখ্যাত কথা এ সময়ে: ‘মানুষ জোড়ে স্থান, চিত্ত জোড়ে মনকে’।
🕳২
“মানুষ জোড়ে স্থান, চিত্ত জোড়ে মনকে” কথাটি পরিপূর্ণ অর্থ বুঝতে পারলাম কালান্তর প্রবন্ধটি শেষ করার পরে। বইটি পড়ার সময়ে মনে হয়েছে পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথকে দেখছি। তাই বলা হয়ে থাকে, এ সংকলনটি রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের রচনা।
এ প্রসঙ্গে প্রাণবান-কিংবদন্তি, শতায়ু অরবিন্দ পোদ্দার বলেনঃ ‘দুঃখে মর্মবেদনায় ক্রোধে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতায় যৌক্তিক পারম্পর্যে নিবিষ্ট এমন প্রবন্ধ পাঠের অভিজ্ঞতা সুদুর্লভ।’
বৈশ্বিক চেতনার এক চূড়ান্ত পরিস্ফুটন ঘটেছে এই প্রবন্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সুচিন্তিত ভাবনা; দীর্ঘ তেইশ বছরের রবীন্দ্রচিন্তার ব্যাপক প্রসারণ পরিলক্ষিত হয় এখানে।
সময়টা ১৯০৫। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক নব মাতনের জোয়ার চলছে তখন ভারতবর্ষে। সেই মাতনে বঙ্গভঙ্গ এসে জুড়ল আরেক বিষফোঁড়া হয়ে। এখানেও আমাদের রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের আগমন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এবং স্বদেশী আন্দোলনে তিনি প্রতিবাদে মুখর ছিলেন প্রথম থেকেই। তার এ প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ কলমের জোরে রাজপথ তোলপাড় করেছে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে রাজনীতি-চর্চার এক চিরন্তন সত্তার আমৃত্যু জারি ছিল।
এ প্রবন্ধের “কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম” শুরু হয়েছে ভারতবাসীর আত্ম উপলব্ধি দিয়ে; যেখানে ইংরেজরা অবজ্ঞা ভারে ভাবে কর্তৃক নেওয়ার মত শক্তি ভারতীয়দের নেই। এটি কলকাতা রামমোহন লাইব্রেরীতে এবং আলফ্রেড থিয়েটারে প্রথম পাঠ করেন তিনি। প্রবন্ধের শুরু একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে। বর্ষায় কলকাতায় ট্রাম লাইনের প্রয়োজনে চারদিকে কর্দমাক্ত রাস্তায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তবুও মুখ ফুটে প্রতিবাদ করার কেউ নেই। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যাক্তিরা করছেন, মান্য করতেই হবে। কিন্তু বিচক্ষণ রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে ধ্বনিত হয় আত্ম কর্তৃত্বের কথা। তিনি স্পষ্ট বলেন, “ভুল চুকের সমস্ত আশংকা মানিয়া লইয়াও আমরা আত্ম কর্তৃত্ব চাই। আমরা পড়িতে পড়িতে চলিব; দোহাই তোমার, আমাদের এই পড়ার দিকেই তাকাইয়া আমাদের চলার দিকে বাধা দিয়ো না”।
‘ছোটো ও বড়’ প্রবন্ধে হাজির করেছেন বিহার অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের অত্যাচারের কথা নিয়ে। তার অকপট স্বীকারোক্তি, এদেশের মতো বিচিত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চিত্র অন্য কোথাও খুঁজে পাননি। সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রের চালনাশক্তিতে পুলিশ এবং আমলাতান্ত্রিকতার । তার ভাষায়—” কোনো অস্বাভাবিকতাকে কেবলমাত্র গায়ের জোরে অত্যন্ত বলবান জাতিও শেষ পর্যন্ত সঙিনের আগায় সিধা রাখিতে পারেনা। ভার বাড়িয়া ওঠে, হাত ক্লান্ত হয় এবং বিশ্বপৃথিবীর বিপুল ভারাকর্ষণ স্বভাবের অসামঞ্জস্যকে ধূলিসাৎ করিয়া দেয়”।
স্বাধীকারপ্রমত্তঃ প্রবন্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধিকার অর্জনের কথা বলেছে, ভিক্ষার নিমিত্তে নয়। কালান্তরের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ হচ্ছে “বাতায়নিকের পত্র”। যাপিত জীবনের চক্রযান এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে ইউরোপকে সার্ভেভাল অফ দ্য ফিটেস্ট হিসেবে এনে নিজের অধিকারকে স্ট্রাগল ফর এক্সিস্টেন্ট হিসেবে আনা হয়েছে। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীতার মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে এ প্রবন্ধে।
আসলে রবীন্দ্রনাথের এ প্রবন্ধে কি নেই? আধুনিক যুগের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, শাক্ত পদাবলী সবই ফুটে উঠেছে এ প্রবন্ধে। শক্তিপূজোতে উঠে এসেছে শুধুমাত্র শক্তি বা দম্ভের জোরে পৃথিবীতে শান্তি আসেনা, যদি আসত তবে ইউরোপ অশান্তিতে পুড়ত না! আর ভারত মাকে দুঃখ জয়ের মাধ্যমেই শক্তির গঙ্গা আনতে হবে, যেভাবে ক্ষুদিরাম গেয়েছে,
“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী।
হাতে যদি থাকতো ছোরা
তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো
রক্ত-মাংসে এক করিতাম
দেখতো জগতবাসী”।
বিপুলা পৃথিবীর জয় শুধুমাত্র বিদ্যার জোরেই সম্ভব। শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে যার স্বরূপ ব্যাখা করা হয়েছে। এটি শান্তিনিকেতন আশ্রমবাসীদের সমক্ষে প্রথম পঠিত হয়। সত্যের আহবান স্বরাজ আন্দোলনের উপাখ্যানে রচিত, উঠে এসেছে গান্ধীর রাজনৈতিক গন্ডিবদ্ধতার কথা সমালোচনার রূপে। কালান্তর যেন রবীন্দ্রনাথের এক নতুন স্বরূপ।
প্রবন্ধ ‘সমস্যা’ প্রকৃতভাবেই ভারতবর্ষের সমস্যাকে চিহ্নিত করেছে। তার ভাষায়, ” আসল কথা, আমরা এক নই, আমাদের নিজেদের মধ্যে ভেদের অন্ত নেই। প্রথমেই বলেছি—- ভেদটা দুঃখ, ঐটেই পাপ। সে ভেদ বিদেশীর সঙ্গেই হোক আর স্বদেশীর সঙ্গেই হোক”! মোদ্দা কথা, আমরা হলে দশ হই, কখনো এক হতে পারিনা। যেটা পরবর্তী প্রবন্ধ সমাধানে হিসেবে এসেছে; শিক্ষাকে সমস্যার সমাধান হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির চরকা ঘোরানোর উদ্যোগের নিন্দা করেছে যেটা হয়েছিল স্বরাজ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। তিনি এখানে কর্মসংস্থানে সমবায় তত্ত্বের প্রাধান্য দিয়েছে। তিনি এরপরই স্বরাজ সাধনে লিখেছেন, “সম্মিলিত আত্ম কর্তৃত্বের চর্চা, তার পরিচয়, তার সম্বন্ধে গৌরববোধ জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত হলে তবেই সেই পাকা ভিত্তির উপর স্বরাজ সত্য হয়ে উঠতে পারে”।
বর্ণপ্রথাকে রক্তচক্ষুর তাপে তপ্ত করেছে শূদ্র ধর্ম প্রবন্ধে। রায়তের কথা যেটি প্রমথ চৌধুরী লিখিত ‘রায়তের কথা’ গ্রন্থের ভূমিকায় ব্যবহার হয়েছিল। পাঁচটি খন্ডের এ প্রবন্ধে রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজতন্ত্র, জমিদারি প্রথা ও রায়তদের বিরুদ্ধে জমি দেওয়ার প্রথাকে তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ করেছে। ১৯২৭ সালের পূর্বদ্বীপপুঞ্জ অভিমুখে যাত্রাকালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ‘বৃহত্তর ভারত পরিষদ’ কর্তৃক আয়োজিত বিদায়সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উত্তরে ভাষণটি ‘বৃহত্তর ভারত’ নামে এ প্রবন্ধে স্থান নিয়েছে। বৈশ্বিক ভাবে ভারতকে উপস্থাপিত করা হয়েছে এ প্রবন্ধে।
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কি? উত্তরটি পেতে জানতে হবে কালান্তরের হিন্দু-মুসলমান শিরোনামে প্রবন্ধ দুটি। প্রথমটি কালিদাস নাগকে লেখা চিঠি, অপরটি প্রবন্ধকারে লিখিত। প্রথমটি ফ্রান্সের চিঠির অন্তর্ভুক্ত। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রবন্ধটি ১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনে তার প্রতি শ্রদ্ধা-প্রদর্শনের জন্য আয়োজিত সভাতে ঠাকুর মশাই কর্তৃক বক্তৃতা। যেটা অনুলিখন হয় শ্রীপুলিনবিহারী সেন কর্তৃক। এখানেও মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রাখার ব্যাপারটিকে তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের ‘রাষ্ট্রনৈতিক মত’ আমার সবচেয়ে পছন্দের। এটি মন্তব্য হিসেবে লিখেছিলেন শ্রীশচীন সেন -লিখিত Political Philosophy of Rabindranath গ্রন্থ নিয়ে। রাজনৈতিক ভাবে রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেস, স্বরাজ পার্টি দু’টোতেই ছিল। শেষে কোনোটিতেই আর থাকেন নি। সেই অভিজ্ঞতার বয়ান এসেছে এ প্রবন্ধে।
কালান্তরে মূলত প্রতিবাদী সত্তার রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছে প্রতিটি অবয়বে। হিজলী ও চট্টগ্রাম প্রবন্ধটি তারই আরেক রূপ। হিজলী ও চট্টগ্রামের নৃশংস ঘটনাবলীর প্রতিবাদ ভেসে এসেছে আলোচিত উপাখ্যানে। রবীন্দ্রনাথ এখানে ঘটনার দোষীদের শাস্তি দাবী করে সমালোচনা করেন। প্রচলিত দণ্ডবিধি প্রবন্ধে তৎকালীণ সময়ে আসামীদের প্রতি আচরণকে রূঢ় বলেছেন। কবি বলেছেন, “রূঢ়তা করার দ্বারা ঔদ্ধত্যের যে আনন্দ আদিম অসংস্কৃত বুদ্ধির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে, দণ্ডনীতির সভ্যতাই তাকে অবধারিত করার সুযোগ দেয়”।
‘নারী’ প্রবন্ধখানি কলকাতার অ্যালবার্ট হলে নিখিলবঙ্গ-মহিলা-কর্মী সম্মেলন উপলক্ষে লেখা হয়েছিল, পরবর্তীতে সেটা কালান্তরে লিপিবদ্ধ হয়। অন্ধরক্ষণশীলতা সৃষ্টিশীলতার বিরোধী যেটা প্রতি নারীর মননে বিকশিত হওয়া দরকার সেটি এ প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। আগেই বলেছি যেহেতু রাজনৈতিক ভাবে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ছিল, কংগ্রেসেও দীর্ঘদিন রাজনীতিতে ছিল। পরবর্তী প্রবন্ধ কংগ্রেসে তা নিয়েই রবীন্দ্র অভিজ্ঞতা, গান্ধীজির রাজনৈতিক পলিসি নিয়ে আলোচনা টেনেছেন। এটা মুলতঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখেছেন। কালান্তর প্রবন্ধের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধের মধ্যে, কোনোটিতে গান্ধীজির প্রতি রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা কলম নিয়েছে, কোথাও আবার নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। বাংলার আকাশকে সঁপে দিয়েছে নেতাজীর হাতে। বাঙ্গালীর চেতনা সংগ্রামের আকাঙ্খা জপেছে প্রতি লাইনে। যেটা আমরা খুঁজে পাই কালান্তরে দেশনায়ক প্রবন্ধে। দুঃখজনক হলেও সত্যি এ প্রবন্ধটি রবীঠাকুরের জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের নিকট প্রচারিত হয়নি। এ প্রবন্ধটি রচিত হয়েছিল সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে সভা আয়োজনের নিমিত্তে। অবশ্য পরবর্তী প্রবন্ধ মহাজাতি-সদনও একি ভাবে বাঙ্গালীর রেঁনেসাসের স্তুতি করা হয়েছে।
“বাঙালির পণ, বাঙালির আশা
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা,
সত্য হউক—সত্য হউক—সত্য হউক হে ভগবান!
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন,
এক হউক—এক হউক— এক হউক হে ভগবান!”
আরোগ্য, প্রলয়ের সৃষ্টি আর নবযুগ এ প্রবন্ধগুলোতে মানবতার সম্মিলিত শক্তি এবং ঐক্যতানের কথা উচ্চারিত হয়েছে। এগুলো বেশিরভাগই শান্তিনিকেতনে কবির ভাষণের সংশোধিত উপাখ্যান। যুদ্ধের জরা, কলুষিত রাজনীতির শিকার, অশান্ত পৃথিবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-সত্তার বিকশিত ও দার্শনিক প্রতিমূর্তি প্রত্যক্ষ হয়েছে তার অন্তিমপর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সভ্যতার সংকট’-এ। যেখানে বিপন্ন পৃথিবীর দিকে তাকিয়েও আশাবাদী হয়েছিলেন তিনি, উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’
এ প্রবন্ধের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রবীন্দ্রনাথ ভাবনার চিত্তকে ভারতবর্ষের যে দিকে সমাপণ করেছেন, সেটি রাষ্ট্রপ্রধান নয়; বরং সমাজপ্রধান। কালান্তরকে যদি উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাইবেল বলা হয়, তবে সমাজ এবং প্রথাগুলো সেখানে অনুচ্ছেদ রূপে ফুটে উঠেছে।
তিনি নিজস্ব সত্তার বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন যে এখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব নয়; বরং প্রচলিত সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে বহুবিধ সামাজিক সংস্কারের নিয়মতান্ত্রিক বাঁধা, যা স্বদেশের অগ্রগামী চরিত্রকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে, বিকশিত হতে দিচ্ছে না ভারতবর্ষের উপস্থাপনকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালখণ্ডে ফ্যাসিবাদের মাথাচাড়া দেখে তিনি লিখেছিলেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ এ যেন উপমহাদেশে রেঁনেসাসের এক নবদিগন্ত। রমাঁ রলাঁ, আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তিনিও দণ্ডায়মান হয়েছিলেন বিপন্ন পৃথিবীর তরে। তারই পূর্বাভাস প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে ‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘সম্প্রতি পৃথিবীতে বৈশ্যরাজক যুগের পত্তন হইয়াছে। বাণিজ্য আর এখন নিছক বাণিজ্য নহে, সাম্রাজ্যের সঙ্গে একদিন তার গান্ধর্ব বিবাহ ঘটিয়া গেছে। …এক সময়ে জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি, এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’ অবাক হয়ে ভাবছি এত যুগ আগে বাঙ্গালীর দার্শনিক আধুনিক মানুষের পণ্যরূপে পরিগনিত হওয়াকে অনুধাবন করে গিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিবর্তন তার মনোজগতে দারুণ আলোড়ন ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তার আরেকটি বড় দিক হলো ভাবনার নিরন্তর ভাঙাগড়া। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, বিশ্ব-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার রাজনৈতিক চেতনার ভাঙাগড়ায় দারুণ সংযোজক হিসেবে কাজ করেছে।
এ প্রবন্ধটি আরো অনেকবার পড়ব। এমন পর্যালোচনার বয়ান আরো আসবে শিরদাঁড়া জুড়ে। প্রতিবার নতুন চিন্তার আর প্রকাশ আসবে তবুও এ প্রবন্ধটি প্রকৃত অনুধাবন হবে কিনা জানিনা; এ প্রবন্ধটি পড়তে গিয়ে তাই মনে হয়েছে।
“ঐ মহামানব আসে,
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক–
এল মহাজন্মের লগ্ন
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত”
Views: 445