- নারী নেতৃত্ব
রাফিয়া ইসলাম ভাবনা
-
“নারী নেতৃত্বে বিশ্ব গড়ি
লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করি”
নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা প্রতিটি মানুষকেই অনন্যতা প্রদান করে। জীবনপথের প্রতি পদেপদে নেতৃত্ব নামক গুণাবলীর প্রয়োজন হয়। আর নেতৃত্ব প্রদানের সাথে নারীর রয়েছে অনবদ্য এক যোগসূত্র। বর্তমান বিশ্বে নারী নেতৃত্বের জয়জয়কার সর্বাগ্রেই পরিলক্ষিত হয়। আর নারী নেতৃত্বের এই গুণাবলী ইতিবাচক সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে অত্যন্ত সক্রিয় অনুষঙ্গ।
নারী নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়েই এ বছর জাতিসংঘ কর্তৃক, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘উইমেন ইন লিডারশিপ :অ্যাচিভিং এন ইক্যুয়াল ফিউচার ইন এ কভিড-১৯ ওয়ার্ল্ড’।
মূলত আদিকাল থেকে বিভিন্ন বিষয়ে নারী অধিকার নিশ্চিতে বিষয়টি সমাজে দৃষ্টিগোচর হলেও সমাজে, সংসারে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে নারী নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ করার ক্ষেত্রে দিবসটির সক্রিয়তা রয়েছে।
নারী এক অপ্রতিরোধ্য প্রাণসত্ত্বা যে কিনা তার জীবনপথের বহুবিধ প্রতিকূলতায় ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রতিটি সময় অতিবাহিত করে। অগণিত প্রতিবন্ধকতা তথা লিঙ্গ বৈষম্য,নারীর প্রতি সহিংসতা,অমানবিক নির্যাতন,
সাংসারিক টানাপোড়ন,মানসিক অবসাদগ্রস্ততা প্রভৃতি অনুষঙ্গ কখনো কোনো নারীকে দমিয়ে রাখতে পারেনা।
আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস কে পাথেয় করে
ক্রমশ প্রতিটি নারী দুর্বার গতিতে স্বীয় নেতৃত্বের সাথে এগিয়ে যায় কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।
বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের অবস্থান নিরীক্ষা করলে পরিলক্ষিত হবে যে, অর্থনৈতিক মানদণ্ড শক্তিশালী করে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে নারীদের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা।
দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনের মতে,
নারীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নে ১৪৯টি দেশের মাঝে পঞ্চম এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
দশ বছর পিছনে ফিরে তাকিয়ে অর্থাৎ ২০১১ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া তিনজন মহীয়সী নারীর কথা এই লেখনীতে সংযুক্ত করা যায়। ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে জাতিসংঘের সহায়তায় নিজ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইলেন জনসন সারলিফ নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সমগ্র লাইবেরিয়ার তিনি সমাজ সংস্কারক এবং শান্তিকর্মী; “লৌহমানবী” হিসেবেও তিনি খ্যাত। এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মহিলা সংগ্রামীর প্রতীক হিসেবে খ্যাত তাওয়াকল কারমান। আবার ২০০২ সালে মুসলমান এবং খ্রিষ্টান মহিলাদের একজোট করে “লেইমা” গড়ে তুলেছিলেন “উইমেন ফর পিস”। শান্তির জন্য নারীদের এই দলটি হাটে-বাজারে গিয়ে গান গেয়ে কন্যা শিশুদের প্রতি সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে নারী এই দলটি বলিষ্ঠ কণ্ঠে করেছিল “যৌন হরতাল” সমগ্র বিশ্ব এবং আফ্রিকায় চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল লেইমার লক্ষ্য। মূলত এই তিন মহীয়সীর দৃঢ়চেতার নেতৃত্বই তাদের লক্ষ্যভেদ করতে সহায়ক হয়েছে।
সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দিশেহারা, ঠিক এই পরিস্থিতিতেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় নারী নেতৃত্বের দক্ষতাপূর্ণ ভূমিকা এবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বিভিন্ন গবেষণা, জার্নাল, গণমাধ্যম, প্রতিবেদন সহ বিভিন্নভাবে নারী নেতৃত্ব প্রদানকারী রাষ্ট্রগুলো করোনা সংক্রামণ মোকাবিলায় দক্ষতাপূর্ণ যোগ্যতা দেখিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।
করোনাকালীন সময়ে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানক্ষেত্র অর্থাৎ চিকিৎসা পদ্ধতিতে নার্সিং সেক্টরের মধ্যে ৬ শতাংশ পুরুষ ও ৯৪ শতাংশ নারী। বলা বাহুল্য, কোভিড বিস্তার রোধে এবং অসুস্থদের সেবা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা। আবার মাঠপর্যায়ের উন্নয়নকর্মীদের একটা বিশাল অংশও নারী, কোভিড-১৯ ঠেকাতে এরা সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা দিয়ে গেছেন।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন সক্রিয় ও ইতিবাচক কাজগুলোতেও এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। কোভিডের সময় অনলাইনে যে পরিমাণ নারী উদ্যোক্তা দেখা গিয়েছে তা অভাবনীয়। কর্মক্ষম রেখে নিজেকে স্বাবলম্বী করে পরিবারে নেতৃত্ব প্রদানে ভূমিকা রাখার মানসে এই ধরণের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
University of Liverpool- এর জার্নালে প্রকাশিত ‘Are Women Leaders doing better on coronavirus?’ এর The data backs itup সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য এই লেখনীতে প্রাসঙ্গিক। কেননা, সমীক্ষায় ১৯৪টি দেশের করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০% নারী নেতৃত্বে পরিচালিত রাষ্ট্রগুলোতে COVID-19 সংক্রমণ হার ও মৃত্যুহার পুরুষ নেতৃত্বে পরিচালিত রাষ্ট্রের তুলনায় অনেকাংশেই কম।
বিভিন্ন দেশের নারী নেতৃত্বের দেশগুলোতে মূলত Socio-Demographic ও Economic বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়।
নারী নেতৃত্বের দেশগুলো করোনার প্রারম্ভেই জীবনের ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে গৃহে থাকা, আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও দেশের কর্ণধারদের সুরক্ষিত রাখতে ও সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, করোনা তথ্য প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদির প্রতি জোর আরোপ করা সহ প্রয়োজন সাপেক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মূলত নারী নেতৃত্বে মানবকেন্দ্রিক।
সারাবিশ্বেই এগিয়ে রয়েছে নারী নেতৃত্বাধীন দেশগুলো। জার্মান, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়েছে। আর ইতিমধ্যেই বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন উক্ত নারী নেত্রীদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যা আসলে নারী নেতৃত্বের ইতিবাচকতারই প্রতিফলন।
নারী নেত্রীরা সবসময়ই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তরুণীদের নিকট বরাবরই অধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এ সম্পর্কিত
একটি গবেষণায় দেখা যায়, সফল নারী নেতৃত্বের ছবি ছাত্রীদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। পুরুষ নেতার ছবি দেখে ছাত্রীরা খুব একটা অনুপ্রাণিত বোধ করে না। উক্ত গবেষণার ফলাফলের মন্তব্য করা হয় এমন যে: “রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব শুধু সমতার আকাঙ্ক্ষাই বাড়ায় না, নারী নেতৃত্বের কারণে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা আরও বাড়ে।”
প্রসঙ্গক্রমে মনে হতে পারে, তাহলে নারী নেতৃত্বে অগ্রসরমান নারীরা কিভাবে পরিবারকে সামলাচ্ছে? বা পারিবারিক ক্ষেত্রে নেতিবাচকতা তৈরী করছে কি নারী নেতৃত্ব?
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সংস্কৃত “নৃ” থেকে (নৃ+ঈ) নারী শব্দটির উৎপত্তি। স্ত্রী-বাচকতা বোঝাতে এই নারী শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নারী ব্যক্তিতে স্নিগ্ধ,সংসারে মমতাময়ী, কর্মক্ষেত্রে পরিশ্রমী, নৃপতির শক্তি, পরিবারের ভবিষ্যৎ। বিংশ শতাব্দীর নারীরা সকল প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙিয়ে ক্রমশ সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। ঘর আর কর্মক্ষেত্রকে দুই হাতে সমান তালে সামলে যেতে তাদের জুড়ি মেলা ভার! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) – এর সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী নারী, পুরুষের দ্বিগুণ কাজ করেন। জরিপ মতে,স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী এমন পরিবারে ৮৫% ক্ষেত্রেই রান্নার কাজ করেন নারী। এছাড়াও জরিপ মতে, ৫৩% কর্মজীবী নারী পরিবারের অন্য সদস্য তথা-শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ সদস্যদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
আবার যদি পরদেশের প্রেক্ষাপট অবলোকন করি তাহলে দেখা যায়, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কন্যা সন্তানের মা হওয়া দ্বিতীয় কোন নারী। এর আগে দায়িত্ব পালনকালে মা হওয়া প্রথম ব্যক্তি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। অর্থাৎ প্রতীয়মান হয় যে, একজন নারী ঘরে-বাইরে সর্বত্রই সুনিপুণা!
আগামী সময়ের প্রতিকূলতা মোকাবেলায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নেতৃত্ব দিতে নারীদের নেতা হয়ে উঠতে হবে। এজন্য সংগঠন করার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, সাংগঠনিক দক্ষতা একজন নারী তথা মানুষের আত্মিক উন্নয়ন সাধন ও করতে দক্ষ ও কুশলী হয়ে উঠতে বহুবিধভাবে সাহায্য করে।
আর বৈষম্যহীন ও সমতাপূর্ণ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে শান্তি আনয়নে ও সামাজিক সংহতি বজায় রাখতে নারী নেতৃত্বের সক্রিয় সম্পৃক্ততা অনস্বীকার্য।
এলক্ষ্যে নারী নেতৃত্বের কথাগুলো ঘরোয়া আলাপে, গল্পে, নাটকে, সিনেমায়, কবিতায়, প্রবন্ধে, নিবন্ধে, সোশাল মিডিয়া সহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে করে ভবিষ্যতের নারীরা গগতগুুতগ ও নেতৃত্বের ইতিবাচক বিকাশে অতিমাত্রায় উৎসাহিত হবে।
পরিশেষে,
সামাজিক সহিংসতা, নারী নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথা কখনো যেন নারীর মনকে খর্ব করে জীবনপথে দমিয়ে রাখতে না পারে এবং মাথা উঁচু করে বাঁচত পারে তাই নারীকেই বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে নারীবান্ধব বিশ্ব গড়ে তুলতে স্বপ্নচারিণী হতে হবে।
….
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
প্যানেল মেম্বার, অংশু।
Views: 119