- মধ্যবিত্ত
সাজিদা জেসমিন
জন্মটা আমার বিশাল বনেদি পরিবারে হয় নি। একেবারে পুরোপুরি মধ্যবিত্ত যাকে বলে। তবে পুরানো হিসেব কষতে
গিয়ে এককালের জমিদারি পরিবার বললে খুব একটা তুচ্ছ করা হবে না বোধহয়। তাই সময়ের সাথে অবস্থার পরিবর্তন হলেও আগেকার আয়েশি জীবনযাপন এখনো বংশের কেউ ছাড়তে পারে নি৷ বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত তীক্ষ্ণ মেজাজ আর চলাফেরায় আভিজাত্য এ যেন আমাদের রক্তের শিরায় শিরায় বহমান। পকেটে কানাকড়ি না থাকলে ও চলাফেরায় আভিজাত্য থাকা চাই।
পাশের বাড়ির রহিম কাকুর কথাই ধরা যাক। বয়স ৪৫ ছুঁই ছুঁই। তবে তার বংশগরিমা এখনো আচরণে স্পষ্ট ফুঁটে উঠে। মাঝেমধ্যে ভাবতে বসি কীসের এত দেমাগ তার? পকেটে কানাকড়ি নেই। মেয়েটা অল্প বয়সে বিদায়
করেছে বাড়ি থেকে । ছেলেটার অবস্থাও কাজকাম হীন ভবঘুরে সাহেবজাদার মতো। বলি কি মশাই, নিজে ঠিক না চললে পরের অবস্থা তো এমন হবেই। এসব ভাবতে ভাবতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যাই।
পরিবার মানবজীবনের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের ছায়ায় বড় হয়ে আমরা সামনে এগোয়। সে হোক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত; পরিবার হতে প্রাপ্ত শিক্ষা আমরা জীবন গঠনে কাজে লাগাই। বাবার কথাই বলি ।
সারাজীবন “মানবতাই পরম ধর্ম, তাহার উপর নাই” – এই মতবাদ নিয়ে চলা মানষু তিনি । পকেটে ১০ টাকা থাকলেও দিব্যি হেসে কেউ চাইতে আসলে দিতে কার্পণ্য করেন নি কখনো। উনার নিজের চালচুলা না থাক, পরের ক্ষিদে মেটাতে হবে এই পণে তার জীবনদর্শন।
বাবা ওপাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন এক যুগ পেরিয়েছে। হঠাৎ করে বদলে যাওয়া পরিবারের হাল ধরেছেন আমার সাহসি জননী। ভাবতে ভাবতে অবাক হই পচিঁশ বছর আর এমনই বা কি বয়স ছিলো? যে বয়সে সবাই ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখে সেই বয়সে তিনি দিব্যি তিন কন্যাদ্বয়কে নিয়ে ছুটে চলেছেন নিজস্ব গতিতে। মাঝেমাঝে ভাবি বোধহয় কোন এক অশরীরী শক্তি ভর করেছে মায়ের উপর। এমনও আবার মানষু হয় নাকি? জীবনযুদ্ধ নামক মহাযুদ্ধের রণাঙ্গনে উনি কেবল অবতীর্ণ হয়ে ক্ষান্ত হননি, এগিয়ে গেলেন বীরদর্পে।
দীর্ঘ পনেরো বছরে তিন কন্যাদ্বয়কে আগলে রেখেছেন কুচক্রী মহল থেকে। সমাজের শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার পণ করেছেন। এই মহাযুদ্ধে অবতরণের সাহস বোধহয় আমার কখনো হত না। একদিকে মধ্যবিত্তের প্রতিকূলতা, সেই সাথে মাথার উপর ছাঁদ হিসেবে বাবার হাত না থাকা। সব মিলিয়ে বিশাল এক যবুথবু অবস্থা থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি।
দুই অক্ষরের একটি শব্দে তার পূর্ণতা কী পায় ‘মা’?
মধ্যবিত্তদের নিয়ে সমাজে বেশ কিছু নিয়ম-কাননু আছে৷ নিয়ম বললে ঠিক ভুল হবে, অনিয়ম শব্দটাই হয়তো বেশ মানাবে। মধ্যবিত্তদের নাকি বড় স্বপ্ন দেখতে নেই। তা আমার মা জননীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। সমাজের বিত্তবান তথা কুচক্রী মহলই বলি বেশ যন্ত্রণা দেয় নানা বিষয়ে। তাদের যেন সবকিছুতেই সমস্যা। তাই এদিকটায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে বৈ কি! তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন তিন কন্যাদ্বয় নিয়ে। পরিবারে বড়দের ক্ষেত্রে ও জীবনযুদ্ধ নামক রণক্ষেত্র বেশ জটিল। সে বেলায় আমার শিক্ষাটা আমি পেয়েছি এমন এক মায়ের কাছে যার কাছে জীবন মানেই প্রতি পদে রণক্ষেত্রের উন্মত্ত যুদ্ধ। আর সে হিসেবে বেশ ভালো একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু আমার জীবনযুদ্ধ যাত্রা। যে যাত্রায় আছে হাসি-কান্নার মিশ্রিত গল্প। সে গল্প নাহয় বন্দী থাক কোন রঙিন খামে।
যাহোক, পরিবারের অবস্থা যেমনেই হোক, সেখানে মায়ের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মায়েরাই পরিবারে
সন্তানদের জীবনগঠনের চাবিকাঠি। আর সেই চাবি যেদিকে ঘুরে সেদিকেই সন্তানেরা পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে সে নিম্নবিত্ত কি উচ্চবিত্ত তার তফাৎ খুব একটা অর্থবহ নয়। পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাতেই সন্তান বেড়ে উঠে । পরিপূর্ণ বিকাশের শুরুটাও হয় পরিবার থেকেই। পরিবারকে বলা চলে শিক্ষার আতুড়ঘর।
Views: 127