“এই খাতাটা কার?”
চোখ নিচু করে হোমওয়ার্কের খাতাগুলো দেখতে দেখতে একটু জোড়েই বলে উঠলাম।
একটা ছোট্ট কণ্ঠ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল আমার। আমি অপ্রস্তুত আর স্তিমিত হয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিত নিঃস্তব্ধভাবে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে রইলাম। আমি মোটেও তৈরী ছিলাম না আলামিনকে দেখার জন্য।
কাছে ডেকে বুকের মাঝে লুকিয়ে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু ক্লাস ভর্তি শিশু। পারলাম না। যদি ওরাও লুকাতে চায় এই ভয়েই হয়তো!
শুধু জড়িয়ে ধরে মাথাতে হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম তোমার শরীরটা ভালো তো ?
একটা মনভুলানো হাসি দিয়ে বলল, আমি ভালো আছি তো ম্যাম । ওর কানে কানে বলেছি, তোমার যা লাগবে আজ থেকে আমার কাছে বলবা। কি বলবা তো?
ওর মুখ দেখে আমি বুঝিনি কি বুঝাতে চেয়েছে আমাকে।
তবে একটা সরলতা আর মিষ্টতা ওর মুখজুড়ে ছেয়ে আছে। কে বলবে যে আলামিনের মা গতকালই গত হয়েছে!
আজ আলামিন স্কুলে এসেছে। হোমওয়ার্কও করে এনেছে। লাইন গুলো সোজা ছিলো না তাই জোরে করে বলে ফেলেছি অথচ ওর জীবনটাই বেলাইন হয়ে গেছে। গতকাল বয়ে গেয়ে একটা ভয়ানক তান্ডব। যার ছিঁটে ফোঁটা বুঝার মত বয়সও ওর হয়নি!
স্কুল শেষে আজ হোম ভিজিটে গিয়েছিলাম আলামিনের বাড়িতে।
এমন ভিজিট আমার জীবনে প্রথম বাড়ের মত। হৃদযন্ত্র হুহু করছে আর পা চলছে পুকুরপার ও লেবুবাগানকে পিছনে ফেলে ফেলে। শোকের সেই বাড়িটিতে আমাকে পৌঁছে দিতে।
খুব নিচু টিনের চালে একটা ছোট্ট ঘর।চেয়ার আগেই পেতে রাখা ছিলো। কারন আমি গ্রামের বের হলেই সেই খবর আগেই পৌঁছে যাই। ভালোবাসার ঘ্রাণেই হয়তো।
আলামিন নানীর বাড়িতে থাকে। মাত্র ছয় বছর বয়স আলামিনের।
বছর তিনেক আগে ওর বাবা মারা গেছে। এরপর আলামিনের মাকে আবার বিয়ে দেওয়া হয় । তবে সেই হাজবেন্ড সেকেন্ড ম্যারেজ করে আলামিনের মাকে আর দেখে না। তাই আলামিনের অসুস্থ মা, নানী আর আলামিন এই তিনের একটা ক্ষুদ্র সংসার ছিলো। ওর মামা আছে তিনটা। কিন্তু মা বোনের খরচ কেউ বহন করেন না। এক মায়ের পেটে অযুত সন্তানের আশ্রয় হলেও সন্তানের কাছে মায়ের আশ্রয়টা কেনন যেন হয়ে উঠে না! তারপর আবার এখানে বোন আর বোনের সন্তান!
সবচেয়ে দুঃখজনক যেই বিষয়টা আমার হৃদয়কে বিষন্ন করে তুলেছে সেটা হলো আলামিনের নানা বেঁচে আছেন। কিন্তু তিনি ও তার বউ, অসুস্থ সন্তানের খরচ বহন করেন না। আরেকটা বিয়ে করে সংসার পেতেছেন একই দেয়ালের ওপাশে!
দীর্ঘসময় কিডনিজনিত সমস্যাতে বিছানাতে লেগেছিলো আলামিনের মা।
এতটা সময় আলামিনের নানীই মানুষের বাড়িতে কাজ করে চিকিৎসা ও অন্নের যোগান দিতো।
হোমভিজিটে গিয়ে কতশত গল্পের সাক্ষ্য হতে হয় আমাকে! আহারে জীবন! কেন এমন!
আজ থেকে ওরা দুজন!
হে আল্লাহ্!! তুমি একজন আলামিনের সব কেড়ে নিলে! এতো কষ্ট আর দুঃখ নিয়ে একটা মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে থাকতে পারে!!
আজ স্কুল বাগানে মাধবীলতা গাছে প্রথম ফুল ফুটেছে। সব বাচ্চারা চিৎকার করে ডেকে ডেকে একটু পর পর জানান দিচ্ছে ম্যাম ফুল ফুটেছে। কেননা ওরা সবাই জানে এই ফুল ফোটা নিয়ে আমি কতটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলাম গত আট মাস থেকে । ওরা সবাই আমার ঠৌঁটে হাসি দেখতে পছন্দ করে। সত্যিই এটা আনন্দে আচ্ছাদিত হবার মতো সংবাদ
অথচ আজ সকাল থেকেই আমার হৃদয় আচ্ছন্ন কষ্টে ।
এই অসহায় মানুষগুলোর দ্বায়িত্ব নেয়না এই রাষ্ট্র। ওদের হাসির জন্য দেশের সংবিধানে কোন ধারা আছে কি!
জীবন থেকে নেয়া
গল্প নয় সত্যি
#আমাদের_আলামিন
সুমেরা জামান
Views: 31