একটি মেয়ে। ফেসবুকেই প্রথম পরিচয়। তারপর বহুদিন কথা হতো ফেসবুকের কল্যাণেই। পোস্টে লাইক-কমেন্টের মাধ্যমে।
তারপর সময় পার হয়। আমাদের আলাপের গভীরতা বাড়ে। কথা হয় কবিতা নিয়ে, গল্প নিয়ে, জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়েও।
ফেসবুকে একদিন তার একটি ছবি দেখি। ইছামতী নদীর পাড়ে (এখন অবশ্য খাল বলে) একটি গাছের ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। একাকী। সুদূর দিগন্তে, ইছামতীর ওপর পাড়ে তার দৃষ্টি। নিঃসঙ্গ তরুণীর ঐ ছবি দেখে মনটা হু হু করে উঠে।
সাহিত্য নিয়ে একদিন আলোচনার এক পর্যায়ে তাকে সেই ছবিটার কথা বলি। সে বলে, “ওখানে গেলে বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে খুব ফিল করতে পারি। এই জনপদকে নিয়ে উপন্যাসটি রচিত।”
সেদিন থেকেই উপন্যাসটি পড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। বইটি উপহার পেলাম সেই তরুণীর থেকেই। অপার মুগ্ধতায় পড়ে ফেললাম এক নিঃশ্বাসে। কে জানতো উপন্যাস শেষ করেই ট্র্যাজেডি জুটবে বাস্তবেও।
বাংলায় নীল চাষের সময় এবং ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শক্তিশালী গল্পের ফাঁদ পেতেছেন উপন্যাস জুড়ে। নীলকুঠির নির্মম ইতিহাস ফুটে উঠেছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
শিপটন মোল্লাহাটি নীলকুঠির বড় সাহেব। তাকে লোকে বাঘের মতো ভয় পায়। নীল চাষের জন্য ইচ্ছে মতো জমি দখলে নেয় কুঠিগুলো। জমি দখলে নিতে ইংরেজ সাহেবরা যতটা না তৎপর, নিষ্ঠুর তারচেয়েও এক কাঠি উপরে ছিলেন এদেশীয় দেওয়ানরা। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাজারাম রায়।
দেওয়ান রাজারাম কূটকৌশলে, লেঠেলের জোরে নীলচাষের উপযোগী জমিগুলো দখল করে। প্রসন্ন চক্কতি আমিনরা ইচ্ছে মতো চেন ফেলে দখল নেয় জমির।
নালু পাল মাথায় মোট বহন করে। তেলের। তার চোখ ভর্তি স্বপ্ন ব্যবসায়ী হওয়ার। কঠোর পরিশ্রম তাকে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে।
তিলু, বিলু, নীলু তিন কুলিন বোনকেই রাজারাম বিয়ে দেন ভবানী বাড়ুয্যের সঙ্গে। পুরো উপন্যাস জুড়ে এই ভবানীর উদারতা, সততা আর সমৃদ্ধ জ্ঞান পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে।
উপন্যাসটি ঐতিহাসিক। ইতিহাসের ছোঁয়া হলেও শিপটনের সাথে ভারতীয় চরিত্র গয়া মেমের সখ্যতা ভীষণ ভালো লাগবে পাঠকের। যশোর এবং নদীয়ার নীল বিদ্রোহের ফলে এক সময় নীলচাষ উঠে যায়। বিদ্রোহের চাইতেও যেটি বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে তা হলো জার্মান দেশের কৃত্রিম নীল রঙ আবিষ্কার। কম মূল্যের কৃত্রিম রঙের সাথে চাষ করা উচ্চ মূল্যের রঙ প্রতিযোগিতায় টেকে না। ফলে নীল চাষ বন্ধ হয়। নীল চাষ বন্ধ হলে শিপটনের মেম এবং বাচ্চা বৃটেন ফিরে যায়। থেকে যায় শিপটন। কেন থাকে সেটা বোঝার জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয় উপন্যাসের একদম শেষ পর্যন্ত।
রামকানাই কবিরাজ একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র “ইছামতী” উপন্যাসে। সমালোচকরা বলে থাকেন রামকানাই চরিত্রটি আসলে বিভূতিভূষণের পিতামহ তারিনী চরণের প্রভাবে প্রভাবিত। ঈশ্বরকে নিয়ে যে গভীর বোধ প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসে ভবানী চরিত্রের মাধ্যমে, তাতে এটি স্পষ্ট যে, ভবানী চরিত্রটি স্বয়ং বিভূতিভূষণ। লেখক নিজেও দেরিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। শেষ বয়সে তার সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়েও সুখের সংসার হয়েছিলো। উপন্যাসেও ভবানীর বেশি বয়সে বিবাহ এবং তিলু এবং খোকনকে নিয়ে যে সংসার দেখা যায়, তা লেখকের জীবনকেই প্রতিফলিত করে।
“ইছামতী” উপন্যাসে তৎকালীন সময় এবং জনপদের দারুণ ছবি এঁকেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাথে সাথে তিনি নিস্তারিনীর চরিত্রের মাধ্যমে আগামীর সংস্কৃতিকেও এঁকেছেন। যে নিস্তারিনী স্বামী-শাশুড়ির ব্যর্থতা আর অত্যাচারকে মেনে না নিয়ে স্বাধীনচেতা হয়েছে।
উপন্যাসে ইছামতী নদী আর তার চারপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা পাঠককে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের মধ্যে নিয়ে যাবে। বইটি শেষ করেই যশোরের ইছামতী নদী পাড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে পাঠকের।
ভালো বই পড়ার পর ঘোর কাটতে সময় লাগে। এই উপন্যাস পড়ে আমারও চরিত্রগুলো থেকে বের হতে সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। বিভূতিভূষণ কী মায়াময় করে খলনায়কগুলোর প্রতিও মায়া সৃষ্টি করে দেন! হলা পেকে কিংবা রাজারামকে ঘৃণা করার চাইতেও বেশি করে মায়া দেখাতে ইচ্ছে করে।
উপন্যাস শেষ হলো। চরিত্রগুলো আপন হয়ে থাকলো।
বাকি জীবন খুব করে মনে থাকবে চরিত্রগুলো। মনে থাকবে বইটিও। সদ্য হারিয়ে যাওয়া সেই ফেসবুকীয় বন্ধুকেও আমৃত্যু মনে থাকবে। ইছামতীর পাড়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকা নিঃসঙ্গ ছবিটি মনে থাকবে আজীবন। আর মনটা হাহাকার করবে তার অনুপস্থিতিকে ফিল করে।
বইয়ের নাম- ইছামতী
লেখক- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ- জাহাঙ্গীর আলম
মূল্য- ২৫০ টাকা
প্রকাশক- শাপলা প্রকাশন
পরিবেশক- কাকলী প্রকাশনী
Views: 23