ক’দিন ধরে বুকের ভেতর ভীষণ ভারী হয়ে আছে। এই ভারী হওয়ার ব্যাপারটা ঠিক যেন কুড়কুড় করে কিছু খুঁচিয়ে খেয়ে ফেলছে মনের ভেতরে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সেই কুড়কুড় যন্ত্রণা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে একখন্ড মেঘ ভেদ করে যেমন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয় অনেকটা তেমন। খুব অস্বস্তি লাগে এই সময়টাতে। বিষাদে ছেঁয়ে থাকে সমস্ত পৃথিবী। প্রিয় মানুষদের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। যারা হৃদয়ের মিলিসেকেন্ড কাছে থেকেও রয়েছে এক আলোকবর্ষ দূরত্বে! আদিম শহরের সমস্ত ঘটনাও এই হৃদয় ভারী ব্যাপারটাকে ছেঁয়ে যেতে পারেনা।
এই সময়টাতে একজনের লেখা টোটকার মত কাজ করে। বলা যায় বিষে বিষক্ষয়। যার নামের এই বয়ানখাতা খুলছি, তিনি আজন্ম জ্যোৎস্নাহত করে রেখে গেছেন একটি প্রজন্মকে। আমার উদ্ধারের পথও তাঁর হাত ধরেই। বুকের জমাটবাঁধা ব্যাথাকে উপড়ানোর জন্য হাতে তুলে নেয় ইস্টিশন। আর যার কথা বলছি; তিনি লিখে গেছেন,
“পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়… ”
না লেখক কোনো মানেই হয়না। জীবনের অনেক কিছুর মানে না হওয়ার অপ্রাপ্তিতে মেলে ধরি উপন্যাস ‘ইস্টিশন’। সেই ইস্টিশনে কারো কারো ট্রেন সত্যি সত্যি এসে থাকে। কারো কারো ইস্টিশনে ট্রেন আসে ঠিকই, কিন্তু মেলট্রেন বলে থামে না। ঝড়ের মতো উড়ে চলে যায়! রেখে যায় একগুচ্ছ স্মৃতিগন্ধা ক্ষত।
কিছুক্ষনের মধ্যে চলে গেলাম নান্দাইলের ইস্টিশনে। এই ইস্টিশনের ইস্টিশন মাস্টার আজহার উদ্দিন। বয়স পঞ্চাশের ওপর। কালো আর লম্বা গড়নের রসিক একজন মানুষ। আমাদের গল্পের শুরুও এখানে। আজহার উদ্দিন থাকেন পরিবার নিয়ে রেলের কোয়াটারে। ভরা সংসারে আছে স্ত্রী, দুই ছেলে, দূরসম্পর্কের বোন এবং বোনের মেয়ে।
আজহার উদ্দিনের বড় ছেলে রঞ্জু পরপর দুবার মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল। সে আবার পরীক্ষা দিবে বলে ভাবে। অন্যদিকে, এই গল্পের কথক যে তার নাম টগর। সে পড়ে ক্লাস সিক্সে। টগরের ফুফাতো বোন কুসুম অতি রূপবতীদের একজন। সে পড়ালেখায়ও যথেষ্ট বিদূষী। রঞ্জুর সাথে সারাক্ষণ চলে কুসুমের তর্ক আর খুনসুটির বাণ। এবার দুইজনেই মেট্রিক দেওয়ার কথা। কিন্ত, পরীক্ষার আগে রঞ্জু হুট করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
এদিকে, নান্দাইল রোড ইস্টিশনের পাশেই বিশাল মগরা ব্রীজ। বর্ষায় বৃষ্টি বেশি হওয়ায় নদীর পানি বেড়ে যায়। ব্রিজ ঠিক রাখার জন্য লোক আসে। ছোট দল তাদের আর দলের প্রধান একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার। সবার কাছে তিনি জাপানি ইঞ্জিনিয়ার নামে পরিচিত। যদিও পুরোদস্তুর বাংলাদেশী তরুণ এই ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একদিন টগরদের বাড়িতে আসে, কুসুমের সাথে পরিচয় হয় তার। এরপর, টগরদের বাড়িতে প্রায় ঘনঘন আসা যাওয়া চলতে থাকে তার। গল্পের কাহিনী এভাবে এগোতে থাকে।
কিছুদিন পরে রঞ্জু বাড়ি ফিরে আসে বিরাট দাঁড়ি গোফ নিয়ে। এনজিওতে চাকরিও জুটিয়ে নেয়। এদিকে, ব্রীজের কাজ ব্যাহত হতে থাকে, ক্রেনম্যান থেকে সকলেই কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যায় মগরা ব্রীজ থেকে। খাওয়ার অসুবিধার কারণে ইঞ্জিনিয়ার টগরদের বাড়িতেই থাকা শুরু করে।
কিছুদিন পরে আবার শুরু হয় মগরা ব্রীজের কাজ। এবার সাথে আসে এক চীনা ইঞ্জিনিয়ার। ক্রেনম্যান জামশেদ থেকে শুরু করে জাপানী ইঞ্জিনিয়ার সবাই ক্ষানিকটা চটে থাকে চীনা ইঞ্জিনিয়ারের কার্যকলাপে।
ঘটনার এক পর্যায়ে চীনা ইঞ্জিনিয়ারের নিয়তিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার প্রভাব ফেলে যায় নান্দাইলের প্রতিটি কোণাতে। বিপদের সম্মুখীন হয় জাপানী ইঞ্জিনিয়ারও। এই নিয়ে এগিয়ে যাবে ইস্টিশনের গল্প।
এই উপন্যাসের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র হচ্ছে রঞ্জু আর টগরের মা। সবার ধারণা তার মাথা খারাপ। আধাকপালী রোগে তিনি ঘরবন্দী হয়ে থাকে। কাউকে চিনতেও পারেনা। মাঝেমধ্যে এটা ওটা ছুঁড়েও মারে সকলের গায়ে। এই ভয়ে কেউ তার পাশে যেতেও সাহস পায়না। কিন্তু এই সংসারের মায়াবতী চরিত্র তার।
আরেকটি প্রিয় চরিত্র ধলা সামছু। যে রাতভর বসে থাকে স্ত্রী ফিরে আসার অপেক্ষায়। খারাপ মেয়েমানুষ হওয়াতে রাতের ট্রেনেই যে তাকে ফিরতে হবে। লম্বা ঘোমটা টানা কাউকে দেখলেই ধলা সামছু ছুটে যায়।
লেখার শুরুতে যে ভারী কষ্ট কুড়কুড়ে খেয়ে নিচ্ছিল ভেতরটা, খেয়াল করলাম সেটা একদম কমে এসেছে। কখন যে উপন্যাসের চরিত্রগুলো কথা বলতে শুরু করেছে আমার চারপাশে খেয়ালই করিনি। মনে হচ্ছে চরিত্রগুলোর মাঝেই বসে আছি মগরা ব্রীজের পাশে। প্রতিটি চরিত্রের সাথে খিলখিলিয়ে হাসছি ব্রীজে বসে। যেকোন মুহুর্তে বাঁকের আড়াল থেকে ট্রেন বের হয়ে আসবে। আমরা সবাই মিলে ঝপাং খেলব ব্রীজ থেকে ছিটকে পড়ে!
আর সেই খেলা ঘোরলাগা চোখে চেয়ে দেখবেন গল্পের কারিগর। যার গল্প আর সাহিত্যে ডুবে মাতাল হয়ে আছে এখনো নব্বই দশকের প্রজন্ম। যিনি প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছিল শনপাপড়ির মতো একগুচ্ছ জোছনা। আমরা যারা বিস্বাদে ডুবতে ডুবতেও ভেসে উঠি হুমায়ূন আহমেদ নামে। যে প্রজন্ম জীবন ইস্টিশনে বসে থাকে কোনো এক চান্দিপসর রাতের অপেক্ষায়।
মহাকালের ট্রেন থেকে নেমে আসবে লেখক। ট্রেন আসলে আমরা ছুটে যায় সামনে। জ্যোৎস্নাহত চোখের কাউকে দেখলেই ধলা সামছুর মতো আমাদের বুক ধকধক করতে থাকে। এগিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বলে উঠি,”আপনার নাম? আপনার পরিচয়?
Views: 44