‘দত্তা’ উপন্যাসের সহজপাচ্য বিশ্লেষণ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দত্তা’ উপন্যাস বিজয়াকে কেন্দ্র করে লেখা। তার বাবা বনমালীর লেখা একটি চিঠিতেই নিহিত তার দত্তা হবার রহস্য। নরেনের হাতে কন্যাকে চিঠিতেই সম্প্রদান করে যান তিনি। পিতৃবাসনা এবং প্রেম দুটোই বিজয়ার একবিন্দুতে মিলে যাওয়ায় বলতে পারি চরিত্রনামও তার সার্থক। চরিত্রনামের অন্য একটা ব্যাপারও বিবেচ্য। সকল স্বার্থবাদী কূটনীতির বিপক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে তার মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের। আমরা দেখি ধর্মরক্ষায় ভিন্নমতাবলম্বীদের পায়ে ঠেলছে রাসবিহারী আর তার ছেলে বিলাসবিহারী। বিজয়া তার সৌম্য প্রজাবাৎসল্যের গুণে ধর্মান্ধ স্বার্থলোলুপ পিতা-পুত্রের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেয়। ফলে ‘দত্তা’ উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে যে ‘বিজয়া’ নামে নাটক মঞ্চস্থ হয় শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায়, তার নামকরণের করণকৌশলও সার্থক বলে প্রতীয়মান।
মানুষের মনের আবেগ দুধরণের— ইতিবাচক এবং নেতিবাচক। বিজয়াকে দেখি নেতিবাচক ত বটেই, মনের ইতিবাচক আবেগকেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সে দেয়নি। এটা তার বিচক্ষণ চরিত্ররেখার পরিচায়ক। নরেনের প্রতি তার যে টান তা সে সহজে তার মানসপটের বাইরে নিয়ে আসতে চায়নি। যেখানে সে অপারগ ছিল সেখানে প্রকাশিত হয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে তাকে দিয়ে প্রেম প্রকাশ করিয়েছেন শরৎ। সে আলোচনা পরে।
মানবমন সদা রিপুর বশবর্তী। তবে যারা বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাদের রিপু দমনকৌশল অত্যন্ত শক্তিশালী। ‘দত্তা’ উপন্যাসে বিজয়াকে বিচক্ষণ হিসেবেই দেখা যায়। যে সমস্ত জায়গায় অপরাপর মানুষ রাগ-ক্রোধের বশবর্তী হয়, উপন্যাসে চিত্রিত সে সমস্ত জায়গায় বিজয়াকে দেখা যায় ধীশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে নিজের নেতিবাচক আবেগকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যেতে। অথচ বিলাস এবং নরেনের মধ্যে রাগ এবং ক্রোধের অস্তিত্ব একটু খেয়াল করলেই লক্ষ করা যায়। বিলাসের চরিত্রবিস্তৃতিতে ত ক্রোধান্ধতা খুবই স্পষ্ট। এক্ষেত্রে বিজয়ার সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেওয়া চরিত্র রাসবিহারী।
রাসবিহারী তার বিচক্ষণ কূটনীতির জোরে বোধকরি উপন্যাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্রের মর্যাদাই পাবেন। যেখানেই পুত্র বিলাসবিহারী অবিমৃশ্যকারিতায় জটিলতা সৃষ্টি করেছে, সেখানেই পিতা রাসবিহারীর আগমন। জটিলতা প্রশমিত করে অতিবিচক্ষণ কূটনীতি আর শঠতায় নিজের অবস্থান সমুন্নত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বুঝি রাসবিহারী। পিতা-পুত্র উভয়েরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবার প্রবণতা লক্ষণীয়। আত্মরতিপরায়ণ চিরায়ত চরিত্র হিসেবে বিশেষ করে টিকে যাবেন রাসবিহারী।
বিজয়ার চরিত্রঅধ্যয়নে যা প্রতীয়মান, তা হচ্ছে একজন বাঙালি নারী পুরুষের কাছে স্বৈরাচারী প্রেমিকা হয়েই থাকতে চায়। ক্ষেত্রবিশেষে তাই দুর্বল ব্যক্তিত্বের প্রেমিকই তার পরম প্রার্থিত। বিজয়া বিলাসের নাকি নরেনের?— উপন্যাসের একপর্যায়ে এ প্রশ্নের মুখে পাঠক পড়বেন। এর দায় বোধকরি নলিনী চরিত্রের সাময়িক প্রভাবের। কিন্তু শরতের কৌশলের অংশ বটে তা।
বলেছিলাম জ্বরের ঘোরে প্রেমের প্রকাশ প্রসঙ্গে। শরতের ব্যক্তিগত যে ধ্যানধারণা বিশ্বাস, আমরা দেখি তার বাস্তবায়নে তাঁর নানান রকমের আরোপিত কৌশল রয়েছে। যে বিজয়া স্বাভাবিক অবস্থায় একান্তেও নরেনকে ভালোবাসার কথা বলতে দ্বিধাবিভক্ত হয়, সে-ই সকলের সামনে নরেনকে প্রেমের বাঁধনে বাঁধবার ইঙ্গিত দেয়। কারণ তখন তার জ্বরে আক্রান্ত ভগ্নদশা। কিন্তু মুখ দিয়ে একবার যা বলা হয়ে যায়, তাকে কী করে ফেরায় মানুষ?
একইভাবে যে বিজয়াকে বিলাসের সঙ্গে ব্রাহ্মমতে বিয়ে দেওয়ার সকল প্রস্তুতি সারা হয়ে গেছে, তাকেই ছলেকৌশলে ডেকে নিয়ে বিয়ের আসরে বসাচ্ছেন দয়াল। হিন্দুমতে হোক, বিয়ে ত বিয়েই। কৌশলের কী নিদারুণ প্রয়োগ!
আমরা শরতের শ্রীকান্ত উপন্যাসে দেখি অভয়াকে। সে সমাজের সকল চোখরাঙানিকে কি উপেক্ষা করতে পেরেছিলো? বাঙলার সমাজে তাকে দিয়ে উপেক্ষা করানো সম্ভব নয় বলেই হয়তো শরৎ তাকে নিয়ে গেলেন বার্মা মুলুকে।
বাঙলা ভাষায় মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলি কিংবা ত্রিভুজপ্রেমের উপন্যাস— ‘দত্তা’ নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। জমিদারিপ্রথায় সুশাসন ও দুঃশাসন, উগ্র ধর্মচেতনা ও স্নিগ্ধ মানবতার একত্রবাস ঘটেছে এ উপন্যাসে। সকলের জন্য অবশ্যপাঠ্য চিরায়ত উপন্যাস। পড়েছেন?
© রেজওয়ান আহমেদ
Views: 34