কুমিল্লা থেকে অনেক দূরের গ্রাম দৌলতপুর। গ্রামের মধ্যে মুন্সি বাড়ি বেশ নামকরা। আর সেই বাড়ির মুন্সি আবদুল খালেকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল এক রক্তজবা! বাবা নাম রেখেছিলেন দুবরাজ, সবাই ডাকত দুবি; মামারা ডাকত যুবরাজ আর যুবি। রূপ আর জৌলুসে সে ছিল স্বয়ংম্ভরা। মুন্সিবাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরে দুবির মামাবাড়ি। বিখ্যাত খান মঞ্জিল। মামা বাড়ির কাছেই একটা স্কুল, সেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সৈয়দা আসার খানম মানে দুবি।
কিন্তু বেশি দিন যাওয়া হয়নি, একটু বড় হয়ে উঠতে না উঠতেই নানা রকম কথা উঠে বাড়িতে আর বাইরে। শেষে ছোট মামা আলী আকবরের হস্তক্ষেপে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় দুবির জন্য। যদিও পাঠ্য বই পড়ার চাইতে গল্পের বইয়ের মধ্যে আনন্দটা বেশি ছিল তার। আর দুবির এই ছোট মামা ছিল মুলত দুই বাড়ি মিলিয়ে উচ্চশিক্ষিত লোক বলতে যা বোঝায় তা!
ছোট মামা থাকতেন কলকাতায়। মাঝে মধ্যে দৌলতপুর আসে। আর নিস্তরঙ্গ দৌলতপুরে দুবির জীবন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। এরই মাঝে এই নিস্তরঙ্গের মাঝে একদিন ছোট মামা নিয়ে আসেন এক খন্ড উচ্ছল আবরণ। কলকাতা থেকে এক কবিকে নিয়ে আসেন ছোট মামা। বয়সে তরুণ, নাম কাজী নজরুল ইসলাম। ছোট মামার নির্দেশে খুব ধুমধাম করে কবিকে বরণ করে নেওয়া হয় খান মঞ্জিলে। মুহুর্তে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেল তরুণ এই কবির কলকাকলিতে।
মুন্সিবাড়িতে বসেই দুবিরা কবির কথা শুনতে পায়। পুরো খানমঞ্জিল মাতিয়ে রেখেছে কবি। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে, আমতলায় বসে বাঁশি বাজায়, বিরাট গাবগাছের নিচে জমিয়েছে গানের আসর, সাঁতার কেটে এপার-ওপার করে মামাবাড়ির বড় পুকুর আর বুকপানিতে ভেসে থেকে গান করে গলা ছেড়ে!
এদিকে, বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা মামাতো বোন মানিকের। এই নিয়ে দুই বাড়িতে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি। একদিন মামাতো বোন মানিক এসে জানায়, আরেক মামাতো বোন হেনার জন্য নাকি কবিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ছোট মামা, কিন্তু কবি রাজি হয়নি। শুনেই ছোটমামার প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত হয় দুবি। মামা কোথাকার এক ছন্নছাড়া মানুষের সাথে নিজের বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিয়ে খেপলেন ভেবে পায়না দুবি!
আস্তে আস্তে দুবির বড় ভাইয়ের সাথে মানিকের বিয়ের দিনও সন্নিকটে চলে আসে। বিয়ের দিন রাতের মেলা গানের মজলিস বসে বাড়িতে। সেই মজলিসে দুবিও গান গায়। খুব প্রশংসাও করল সবাই। বিয়ে বাড়ির হই-চইয়ের মধ্যে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল দুবি। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখে এক লোক দুবিকে গানের প্রশংসা করছে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, গাঢ় গভীর দুটি চোখ, টিকালো নাক, তামাটে ফর্সা দীর্ঘদেহী যুবক। ইনি সেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম যাকে নিয়ে খান মঞ্জিলে উৎসবের আমেজ এতদিন।
রাতে বিছানায় শুয়ে কেমন এক অস্বস্তি লাগলো দুবির। মনে হল প্রচ্ছন্নভাবে নজরুল যেন তার বুকে চেপে রয়েছে। ভোরবেলায় পুকুরঘাটে দেখা হয় নজরুলের সাথে দুবির। নজরুল দুবির নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তরে বলে, সৈয়দা আসার খানম। নজরুল তখন বলে উঠে যার রূপের বাহার ফুলের মতো এমন বেরসিক নাম কি তাকে মানায়! দুলিকে তখন নজরুল নার্গিস নামে ডেকে উঠে! নার্গিস পারস্য দেশের লতাগাছের ফুল। পারস্যের হাফিসের লেখায়ও নার্গিস ফুলের নাম আছে।
নজরুল তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল করুণ সুরে। দুলি জিজ্ঞেস করতেই নজরুল বলে উঠে, রাধার বিরহে কৃষ্ণের বাঁশিতে বেদনার সুরই তো বাজবে! আর বাংলা সাহিত্যে সূচনা হয় এক অমর অপ্রাপ্তি প্রেম গাঁথার! বাসররাতে গিয়েও অর্ধেক জীবন যে প্রেমের বেদনাতে দগ্ধ হয়েছে এক জীবনের। আর আধুনিক সাহিত্য পেয়েছিল অগ্নিবীণার মতো দৈবসাক্ষাতের!
নার্গিসকে নিয়ে নজরুল লিখে,
“আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি— তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি “অগ্নিবীণা” বাজাতে পারতাম না— “ধূমকেতু”র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।”
নার্গিস নজরুলের প্রথম প্রেম, যে প্রেম পায়নি মিলনের পূর্ণতা। বিয়ের রাত ফুরোবার আগেই ঘটে গিয়েছিল অঘটন! কি সেই অঘটন? পাঠককে সেই রহস্যের সামনে দাঁড় করাবে এই উপন্যাস। গবেষকের নিষ্ঠা ও ঐতিহাসিকের সততা নিয়ে লেখক এই উপন্যাসে একটি মানবিক সম্পর্ককে উন্মোচন করেছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন নার্গিস নামের এক গ্রাম্য মেয়ের রূপান্তরের কাহিনি, ভালবাসা যাকে আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা করে তুলেছিল। এখানে পাঠক খুঁজে পাবে চিরন্তন এক আটপৌরে নার্গিসকে। নজরুল এখানে শুধু ছাঁয়া মাত্র। তাই পুরো নজরুলকে খুঁজতে গিয়ে বৃথা দ্বন্দ্ব পাঠক মননে না আসাই যুক্তিসঙ্গত উত্তর।
২০১৪ সালে প্রকাশিত নার্গিসের এটা সপ্তম মুদ্রণ। বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর হাত ধরে নার্গিস এসেছে এই উপন্যাসে রূপান্তরের কাহিনিতে। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
বইটি সম্পর্কে লেখক বলেন,
“২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘নার্গিস’ এর সাতটি মুদ্রণ এবং ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘কবি ও রহস্যময়ী’র দুটি মুদ্রণ এ যাবত প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া এই আনুকূল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হয়, নজরুলের কবিতা এখনো যেমন সমান আগ্রহে পাঠ করেন পাঠক, তেমনি তাঁর বর্ণময় ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে অনুসন্ধিৎসাও কমেনি। সেক্ষেত্রে নিরেট ইতিহাস পাঠের চেয়ে আখ্যান পাঠের আনন্দ যে বেশি তা তো বলাই বাহুল্য।”
লেখকের চমৎকার সাহিত্যের আবরণে নার্গিস এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট। যার দগ্ধ হৃদয় চিড়ে পাঠক পৌঁছে যাবে এক গ্রাম্য কিশোরী থেকে ‘তাহমিনা’ হাতে এক তরুণ লেখিকার চূড়ান্ত প্রকাশকে!
Views: 36