“লজ্জা শরম যেন কিচ্ছুটি নেই,ছ্যাহ! ছ্যাহ! পেট দেখলে মনে অয় সাত মাসের পোয়াতি, অথচ একমাসও পেটে রাখবার মুরোধ নেই।”
কথাগুলো স্পষ্ট আমার কানে এসেছে। কী সৌভাগ্য দরজার চৌকাঠের সাথে ধাক্কা লেগে জুতোজোড়া ছিড়ে না গেলে তো আমি উর্ধশ্বাসে দৌড়ে রুমে চলে যেতাম। এমন কঠিন সত্যের মুখোমুখি কখনোই হতে হতো না আমাকে। আমি যন্ত্রচালিত রোবটের মতো ছেঁড়া জুতোজোড়া বাম হাতে নিয়ে সেই নিচু অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে ডান হাত দিয়ে দরজার পর্দা ফাঁক করে গেস্টরুমে অাধ-শোয়া অবস্থায় পান চিবানো মানুষ সদৃশ সরীসৃপ প্রাণির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম। যাকে কিছুক্ষণ আগে চুলে তেল লাগিয়ে আমি মাথা আঁচড়ে দিয়েছি। সেই তিনি আমি বের হওয়ার সাথে সাথে ফোনে কার কাছে যেন আমার নামে বিষাদ ঢালছেন।
আমাকে দেখে যেন তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। আমি এক মহাসমুদ্র ঘৃণা বর্ষণ করে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে এলাম সোজা রুমে।
এই মানুষ সদৃশ সরীসৃপটা আমার চাচী শাশুড়ি। তিনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন। সময় সুযোগ পেলেই সপ্তাহখানেকের জন্য হলেও এসে আমাদের গেষ্টরুমে অস্থায়ী নিবাস গড়েন শুধুমাত্র আমার জন্য। আসলে তিনি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই পছন্দ করেন। তার মেয়ে রাহেলার সাথে আবিরের বিয়ে দিতে চেয়েছেন। রাহেলার তখন বয়স কম ছিল। আর সৌভাগ্যক্রমে বিয়েটা আমার সাথে হয়েছে। সেজন্য তিনি এবাড়িতে আসলে আমাকে রাহেলার মতো ভালোবাসেন। গত সপ্তাহে আমার বিপদের কথা শুনে কোমড় ব্যাথা নিয়েও তিনি ছুটে এসেছেন। এটা তার ভাষ্যমতে। আর আমিও এতদিন বিশ্বাস করে এসেছি। তাই তিনি আসলেই আমি গরম পানি, চা, নাস্তা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত হয়ে থাকি। আসলে কখনো মায়ের ভালোবাসা পাইনি তো!
আমার বিপদ কিন্তু ছোটখাট নয়। গতমাসে ওয়াশরুমে পিছলে পড়ে এই তৃতীয় বারের মতো আমার বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে গেল। তারা তো ভেবেই নিয়েছেন আমি বুঝি কখনো সন্তান ধারন করতেই পারব না।
আচ্ছা সুস্থ হোক বা অসুস্থ হোক, আমি কি সত্যি কখনো কোনো সন্তানেরর জন্ম দিতে পারব না। সব বুঝি নিজেদের অবহেলায় শেষ হয়ে গেল!
আমি সাদিয়া শারমিন লোপা। ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকাবার আগেই আমার বিয়ে হয়েছে। আবির আহমেদ আমার স্বামী। একই ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটার সাথে এক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ছাতা ভাগাভাগি করে রিকশায় উঠতে গিয়ে কখন যে মনের অজান্তে মনটারও আদান- প্রদান করে ফেলেছি টেরই পাইনি। পরের দিন কলেজে এসে আমার চঞ্চল হরিণির মতো চোখ দু’টো যখন লাইব্রেরির শেষ বেঞ্চে অধ্যায়নরত ছেলেটার কাছে এসে স্থির হয়েছে, তখনই বুঝতে পেরেছি যা সর্বনাশ হওয়ার গতকালই হয়েছে।
এরপর একসাথে হাতে হাত রেখে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেছি। আবিব যেহেতু আমার তিন বছরের সিনিয়ার ছিল, সে হিসাবে সে তিন বছর আগেই বের হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ আবিরের ভাগ্যটা ভালো ছিল। প্রথমবার আবেদন করার সাথে সাথে চাকরি হয়ে গেছে ইসলামী ব্যাংকে অফিসার পদে।
নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে আমি। আমার জন্মের সাত বছর বয়সে পুনরায় মা হতে গিয়ে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তারপর বাবা আর বিয়েই করেননি। আমাকে নিয়েই তিনি জীবন সমুদ্র একা পাড়ি দিয়েছেন। ঘরে মা না থাকায় জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা আমার হয়নি। যেমন কিশোরি একটা মেয়েকে মা মাথায় কাপড় দেয়া, গায়ে কাপড় দেয়া, পরপুরুষ এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাতে কলমে যে শিক্ষাটা দেয়ার কথা সেটা আমাকে কেউ দেয়নি। বাবা পুরুষ মানুষ। হয়তো বিষয়গুলো জানতেন না, না হয় লজ্জায় দেননি। ফলাফল চলতে চলতে একসময় বিয়ের আগেই আবিরের সাথে আমার জীবনের চরম সর্বনাশটা ঘটে গেছে। সেদিন ছিল শনিবার আবির সদ্য চাকরি পেয়েছে। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কল না দিয়ে সরাসরি বাসায় চলে এসেছে। আমাদের বাপ মেয়ের সংসারে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকে না। সেদিন বাবাও ছিলেন না। দুজনের সম্মতিতে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছি।
অথচ আমরা নিজেদের কাছে সৎ থাকতে চেয়েছিলাম। সেদিন জানি না কী থেকে কী হয়ে গেল। এরপর আমি চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এমন ঘটনার পর অন্য আট -দশটা ছেলের মতো সে বদলে যায় না -কি!
না, আবির অন্য সবার মতো নয়, আমি খোঁজ নেয়ার আগেই সে পরের দিন থেকে আমার খোঁজ নেয়া শুরু করেছে। এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। আমি তো নাবালিকা নই, সে জন্য পুরো ঘটনার জন্য তাকে এককভাবে দোষারোপ করিনি। তবে প্রতিশ্রুতি করেছি বিয়ের আগে আর দেখা না করার।
এরই মধ্যে আমি কনসিভ করে ফেলি। বিষয়টা আবিরকে জানাতেই সে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ তখন আমাদের সম্পর্কটা তার পরিবার জানত না। সে মাকে আমার কথা জানিয়েছে, বিয়ে করার জন্য অনুমতি চেয়েছে। অথচ তিনি কোনোভাবেই রাজি হননি আমার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ছেলের বউ করাতে।
এদিকে আমার শরীর জানান দিচ্ছে আমার কতটা যত্নের প্রয়োজন, কতটা নিশ্চিন্ত থাকার প্রয়োজন। অথচ দুশ্চিন্তা করতে করতে আমি তখন পাগল প্রায়।
একদিন কল করতে করতে তাকে না পেয়ে ছুটে গেলাম তার অফিস। অফিসটা ছিল ছয়তলায়। কারেন্ট ছিল না, সেজন্য লিফট কাজ করেনি। আমি উর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পা পিছলে হুড়হুড় করে পড়ে গেলাম নিচে। সাথে সাথে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেল।
কী আশ্চর্য এক মুহূর্তের ভুলে আমরা কনসিভ করে ফেললাম। অথচ সেই আমরা দুজন মানুষই লতার মতো জড়িয়ে আছি আজ সাতটা বছর অথচ মা হতে পারছি না। ডাক্তার বলছে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু শ্বাশুড়ি মা অপেক্ষা করতে নারাজ। তিনি বংশধর চান। প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করাবেন। সেই জন্যই তার কাছে এই কন্সিভ করার নাটক। এই নাটকটা বেশিদিন চালিয়ে নিতে পারি না আমি হাঁপিয়ে যাই, সেজন্য আমি বাথরুমে পা পিছলে পড়ার অভিনয় করি।
উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে আবির রুমে আসল। অন্যদিন হলে তাকে সরাসরি রুম পর্যন্ত আসতে হতো না। তার আসার সময় হলেই আমি দরজার পাশে ঘুরঘুর করতাম। কলিংবেলের শব্দে সবার আগেই দরজা খুলে দিতাম। আজ ইচ্ছে করেনি।
” কী ব্যাপার লোপা! লাইট অফ করে শুয়ে আছো কেন?”
আমি ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে আছি। যেন মনে করে ঘুমিয়ে পড়েছি। না ফাজিলটার চোখ এড়িতে পারিনি। কাপড় পাল্টিয়ে এসে পাশে বসে কপালে হাত রাখল।
” শরীর খারাপ করেনি তো! না-কি রাগ করেছে? চোখ পিটপিট করতে হবে না। উঠ!”
আমি চোখ খুলে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবির আৎকে উঠল,
” লোপা তোমার চোখ ফুলা কেন? তুমি কি কান্না করেছ?”
এবার আমার বুক ফেটে সত্যি সত্যি কান্না চলে এলো। আমি আবিরের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কান্না করলাম। কতক্ষণ সময় কেটে গেল টের পাইনি। এবার আবির আমার মাথা তুলে বলল,
” আর কাঁদতে হবে না। আমরা ইন্ডিয়া যাব। ভালো চিকিৎসা করাব। আমার মন বলছে আর কোনো অভিনয় করতে হবে না। তুমি কিন্তু এবার সত্যি সত্যি মা হতে পারবে। ”
” আমাকে দেখতে সাত মাসের পোয়াতির মতো মনে হয়। অথচ একমাসের জন্যও মা হতে পারছি না কেন আবির?”
” কী বিশ্রি কথা! কে বলেছে তোমাকে এমন জঘন্য কথা? নিশ্চয়ই মা! কতবার তোমাকে বলছি ছোট মায়ের পাশে পাশে থাকবে, তাহলে মা আর কিছু বলবে না। ”
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
“চাচী আম্মা!”
” ছোট মা তোমাকে মেয়ের চোখে দেখেন, আম্মা বড় বউ হলেও ছোট মাকে সম্মান করেন। সেজন্য ছোট মায়ের সামনে তোমাকে কিছুই বলবে না।”
আমার এ প্রসঙ্গে কথা বলতেই ইচ্ছে করেনি। তাই উঠে চলে গেলাম রান্নাঘরে। আবিরকে চা দিতে হবে।
রান্নাঘরে চা বানাত বানাতে হঠাৎ করে শাশুড়ি মায়ের প্রতি আমার মনে যে বিষাদ ছিল সেটা নিমিষে উধাও হয়ে গেল।
তিনি আমাকে অপছন্দ করেন, আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, আমার কোনো সন্তান নেই, আমার ওজন বেশি সেটা তিনি কথায় কাজে সবসময় বুঝিয়ে দেন। তার ভেতরের বাইরের স্বচ্ছতা বা কুটিলতা সব আমি বুঝতে পারি।
আবার আমার একটু অসুখ হলে তিনি অস্থির হয়ে যান। শপিং করতে গেলে বেছে বেছে আমার পছন্দের পোশাক কিনে আনেন। আমি এটাও বুঝতে পারি এসব ভালোবাসা।
কিন্তু এসব মামী শাশুড়ি, চাচী শাশুড়ি, যাদের মুখ দিয়ে সারাক্ষণ অমৃত ঝরে পড়ে, তাদের ভেতরাটা এমন পচা, দুর্গন্ধযুক্ত।
পাঁচ বছর পর আমি বসে আছে ড্রয়িংরুমে, দুই বছরের অণু বল দিয়ে খেলছে আমার সাথে। তার খেলার সাথী হয় মাকে হতে হয় নয় বাবাকে। অথচ বাবা অফিসের কাছের ঝামেলায় অণুকে সময় দিতে পারে না ঠিক মতো। সে জন্য বাধ্য হয়ে আমাকেই তার সাথে খেলতে হয়।
এমন সময় আমার চাচী শাশুড়ি চেয়ার টেনে আমার পাশে এসে বসলেন। তিনি কিন্তু কিছুদিন পরপরই আমার ভালোবাসা টানে এবাসায় চলে আসনে। কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে আমি কিন্তু আর তার ভালোবাসা উত্তাপ নেইনি।
” লোপা একটা কথা বলব ভাবছি!”
” জি, বলুন।”
” তোমার কত বন্ধু-বান্ধব আছে, দেখ না একটা ভালো ছেলে রাহেলার জন্য।”
” কেন চাচী আম্মা ও তো যথেষ্ট সুন্দুরী, ওর জন্য আমার পছন্দের ছেলে কি আপনার পছন্দ হবে? ”
” সুন্দর তো ঠিক আছে, কিন্তু ওজনটা এত বেড়ে গেছে, কেমন যেন বয়সের চেয়ে একটু বেশি বড় মনে হয়।”
” কোথায় ওজন বেড়েছে? দেখতে তো আর আমার মতো সাত মাসের পোয়াতি মনে হয় না।”
চাচী আম্মা ড্যাবড্যাব করে আমার পাথরের মত কঠিন চোখের দিকে চেয়ে আছেন। আমি উনার দৃষ্টি উপেক্ষা করে অণুর হাত ধরে গর্বিত ভঙ্গিতে সোজা রুমে চলে এলাম।
কেন চাচী আম্মা এবার মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না কেন? কতবার বলেছি, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সব আল্লাহ তাআলার ইচ্ছে। সাত মাসের পোয়াতির মতো দেখতে আমি কিন্তু ঠিকই সন্তানের মা হয়েছি।
Views: 39