মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে নারীর অন্তর্চারিত্রিক এবং আন্তর্চারিত্রিক বৈচিত্র্য : প্রসঙ্গ ‘দিবারাত্রির কাব্য’
‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নারী চরিত্রায়ণের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বলেই প্রতিভাত। এতে যদিও প্রধান তিন পুরুষ চরিত্রের পাশাপাশি তিন নারী চরিত্র রয়েছে, তবু পরীক্ষানিরীক্ষার মানস থেকেই বোধকরি মিলনান্তক উপন্যাস সৃষ্টি করা থেকে বিরত থেকেছেন ঔপন্যাসিক। স্বভাবসুলভ উন্মুক্ত পরিসমাপ্তি এ উপন্যাসেও রেখেছেন— বলাবাহুল্য। শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের তিন নারী সুপ্রিয়া, মালতী, আনন্দ— কারোরই হয়ে উঠতে পারল না। তা না পারুক, মানিক কিন্তু ঠিক পেরেছেন এদেরকে নিয়ে অন্তর্চারিত্রিক এবং আন্তর্চারিত্রিক— উভয় প্রকার বৈচিত্র্যের ফুলঝুরি ছুটিয়ে একটা প্রেমের উপন্যাস দাঁড় করাতে। বাঙলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গেছে নারীর মধ্যে আন্তর্চারিত্রিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটাতে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী চরিত্রনির্মাণে অন্তর্চারিত্রিক বৈচিত্র্য নিয়ে একাধিক কাজ লক্ষণীয়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে কপিলা যেমন। নিজের বাড়িতে আর বোনের বাড়িতে কুবেরের সাথে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেমন, স্বামীর বাড়িতে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আবার শশীর কাছে একাধিকবার সূক্ষ্মভাবে অবহেলিত হবার আগের কুসুম এবং পরের কুসুম ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে সম্পূর্ণ বিপরীত। বলতে চাচ্ছি, ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন সূক্ষ্ম কিছু কিছু অন্তর্দৃষ্টিগত মুনশিয়ানা তাঁর নারী চরিত্রায়ণের বিশেষ হাতযশ দিয়েছে। এ লেখা শুধু ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসে এ হাতযশ খুঁজে দেখবার প্রয়াস।
এ পর্যন্ত আমার পাওয়া মানিকের সবচেয়ে স্নিগ্ধ নারীচরিত্র সুপ্রিয়া। তার ভেতরে এরকম বৈচিত্র্য রাখবেন, সেটা শুরুতে বুঝে উঠিনি। তাকে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র কুসুমের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে একদিক থেকে। কাহিনিবিচারে হেরম্ব-সুপ্রিয়ার রসায়ন শশী-কুসুমের রসায়নের সাথে মিলে যেতে চায়। কিন্তু কুসুম যেখানে শশীকে প্রত্যাখ্যান করে, সে বাস্তবতায় মানিক হেরম্ব-সুপ্রিয়াকে দাঁড় করাননি।
মানিক যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছিলেন সুপ্রিয়াকে, তার ভেতর এতোটা গোছানো পতিশাসনপ্রবৃত্তি থাকবে, সেটা বোঝা যায়নি সেভাবে। পাঁচবছর বাদে দেখা হওয়া পরিচিতের প্রতি পুরোনো প্রেমজনিত টান থাকতেও সে সাধারণ বাঙালি পতিব্রতা। দারোগার স্ত্রী হয়ে সে যে সুখী মনে বেঁচে থাকছে, এমনটা বলার উপায় নেই।
তবু,
বাইরের ঘরের ভিতর দিয়ে অন্দরের বারান্দা হয়ে হেরম্বকে সে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে হেরম্ব লক্ষ করে দেখল, চারিদিকে একটা অতিরিক্ত ঘষামাজা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ভাব। ঘর ও রোয়াকে ধোয়া মেঝে সবে শুকিয়ে উঠেছে, সাদাকালো দেয়ালে কোথাও একটু দাগ পর্যন্ত নেই। জলের বালতি, ঘটি-বাটি, বসবার আসন প্রভৃতি টুকিটাকি জিনিসগুলি পর্যন্ত কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে স্বস্থানে অবস্থান করছে। স্থানভ্রষ্ট একটি চামচও বোধহয় এ বাড়ির কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না।
এসবই প্রমাণ করে প্রাথমিকভাবে, সে একজন সংসারী নারী। তিথিজন কিংবা অতিথি উভয়ক্ষেত্রেই। অতিথির পথের ক্লান্তি মুছতে যে সদাসচেতন, তাকে স্বামীসেবায় অসচেতন বলা দূর, ভাবারই সুযোগ নেই। স্বামীর সাথে তার একধরণের মানিয়ে-নেওয়া বন্ধুত্ব হলেও তৈরি হয়েছে। এ কারণেই বোধকরি একসঙ্গে বসে ব্র্যান্ডি খেতে অসুবিধে হয় না তেমন।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় শশীর বোন বিন্দু যেমন পতিমনোরঞ্জনে মাতাল হয়েছে সুপ্রিয়ার ব্যাপারটি তার থেকে একটু হলেও বৈচিত্র্যে ভাস্বর। আরও একটু বেশি বিচিত্র বোধকরি মালতীর মদসেবন। তান্ত্রিকতার স্পর্শ আছে তাতে।
কাহিনির বিস্তারে মালতীর প্রবেশ সাজানো-গোছানো প্লট ভেঙে এলোমেলো করতেই যেন। এখানেই বোধকরি ‘দিবারাত্রির কাব্য’-এর দুর্বোধ্যতা। পাঠককে স্থির চিন্তা করতে দিতে ঔপন্যাসিকের এত অনাগ্রহ এর আগে দেখিনি এভাবে। সুপ্রিয়ার মতো মালতীর মধ্যে পতিভক্তি প্রদর্শনের বালাই নেই, নেই সংসারব্রতের সচেতনতা। অন্তরালে আছে অসুখী দাম্পত্য। অপূর্ণ যৌন-আকুতি। মানিক লিখেছেন—
‘চুপ! একটি কথা নয়।’— মালতী টেনে টেনে হাসল, ‘তুমি বোঝ ছাই, বলবেও ছাই। দেড় যুগ আঙুল দিয়ে ছোঁয় না, তাই বলে আমি কি মরে আছি? বুড়ো হয়ে গেলাম, শখ-টখ আমার আর নেই বাপু, এখন ধম্মোকম্মো সার। ঠাট্টা-তামাশা করি একটু, মিনসে তাও বোঝে না।’
তবে মালতী-আনন্দের মধ্যকার মা-মেয়ে রসায়নটা বেশ গোছানো হয়েছে দেখা যায়—
‘তোমাদের দুটিতে দেখছি দিব্যি ভাব হয়ে গেছে।’
আনন্দ বলল, ‘আমার বন্ধু, মা।’
‘বন্ধু!’ মালতীর স্বরে অসন্তোষ প্রকাশ পেল। ‘বন্ধু কি লো ছুঁড়ি। হেরম্ব যে তোর গুরুজন, শ্রদ্ধার পাত্র।
আবার,
আনন্দ উদ্ধত সাহসের সঙ্গে বলল, ‘লজ্জা পাচ্ছে কে? আমি? জগতে এমন কথা নেই আমি যা বলতে লজ্জা পাই। নাচার পর আমার ঘুম দেখে মা বলে, তোর আর বিয়ের দরকার নেই আনন্দ।’
এই দুক্ষেত্রে মালতী-আনন্দের মা-মেয়ে সম্পর্কের বৈচিত্র্য ও গভীরতা গভীর পাঠকের চোখে সহজেই ধরা পড়ার কথা।
আনন্দের মধ্যে অস্পষ্টব্যক্তিত্ব স্পষ্ট। অচেনা লোকের সাথে নিজে থেকে সহজ হয় না সে, অথচ একবার সহজ হলে অনেকখানিই সহজ হয়ে যায়। বাস্তবজীবনে চারিত্রিক অস্পষ্টতাসম্পন্ন মানুষ অনেক পাওয়া যায়। সাহিত্যে এমন চরিত্রনির্মাণ কম দেখা যায়। আনন্দের খেয়ালি ব্যক্তিত্বের ঠিক বিপরীত সুপ্রিয়া। হেরম্বের প্রতি ভালোবাসাটা তার সে কারণেই বোধকরি বৈচিত্র্যহীন। সুপ্রিয়া যেমন বিকিয়ে থাকা প্রেমী, আনন্দ তেমনই সিকি পয়সা ধারে না— এমন। অথচ হঠাৎই আকাশের চাঁদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হেরম্বের। ওদিকে সুপ্রিয়া সান্ধ্যভ্রমণে অথবা অলস গল্প করার ছলে হেরম্বের সঙ্গ পেতে মরিয়া। আবার হেরম্বের প্রেমে নিমজ্জিতপ্রায় আনন্দকে দেখি ভয়ে জড়োসড়ো—
আনন্দ হতাশার সুরে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারি না। সব হেঁয়ালির মতো লাগে। তুমি, আমি, আমাদের ভালবাসা, সব মিথ্যে মনে হয়। আচ্ছা, আমাদের ভালবাসাকে অনেকদিন, খুব অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না?’
আনন্দ-হেরম্বের সম্পর্কের ব্যাপারে টের পেতেই সুপ্রিয়ার মধ্যে যে পরিবর্তন, তা গুরুত্বসহকারে লক্ষণীয়—
… আনন্দ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে জানে না। টাকা নিয়ে সে চলে গেলে হেরম্ব চেয়ে দেখল সুপ্রিয়া খুব সরলভাবে অত্যন্ত কুটিল হাসি হাসছে। আনন্দের সঙ্গে হেরম্বের আর্থিক সম্পর্কটি আবিষ্কার করামাত্র তার যেন আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। … সুপ্রিয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘না আর একদণ্ড বসব না। কি করে বসতে বলছেন?’
এখানে আমরা একজন ঈর্ষান্বিতা প্রেমিকাকে দেখি। সুপ্রিয়া চরিত্রের নির্মাণের ধরণের ফলশ্রুতিই বুঝি এ ঈর্ষা।
এমন ঈর্ষা আনন্দের মধ্যেও এসেছে বটে—
… হেরম্ব অনুরাগ নিয়ে বলল, ‘কেন তুমি কেবলি দিনের হিসাব করছ আনন্দ?’
কথাগুলি হঠাৎ আক্রমণ করার মতো শোনাল। আনন্দ থতমত খেয়ে বলল, ‘ না, তা করি নি। এমনি কথার কথা বললাম।’
হেরম্ব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল। ‘কথার কথা কেউ বলে না, আনন্দ, আজ পর্যন্ত কারো মুখে আমি অর্থহীন কথা শুনি নি। তোমার ঈর্ষা হয়েছে।’
যা কিছুই ঔপন্যাসিকের মানসে থাকুক বা না থাকুক, এ ব্যাপারটি পরিষ্কার যে আনন্দের ঈর্ষা উপন্যাসের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে— আনন্দের আত্মাহুতির পেছনের কারণ কী? ভাঙা পরিবারের একটা মেয়ে যার কোনো ভরসা নেই বেঁচে থাকবার, অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো (যেমন – ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্প) মানিক তার জন্য আত্মাহুতিতেই সমাধান লিখেছেন। যে হেরম্ব একবার সুপ্রিয়ার কাছে ছুটে গেছে, সে বারবার যাবে। এ ব্যথা আনন্দ সইতে পারবে না। এদিক থেকে সে সুপ্রিয়া থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ। সুপ্রিয়ার মতো শুধু ভালোবাসা পেলে তুষ্ট নয় সে। বরং হেরম্বের সার্বক্ষণিক অস্তিত্ব বোধকরি তার একটু বেশিই প্রার্থিত।
©রেজওয়ান আহমেদ
১৭ আগস্ট ২০২২, পটুয়াখালী।
ছবিঋণ – অন্তর্জাল।
Views: 38