অবচেতন মন
____সিরাজুম মাহদী
সৃষ্টি তখনই সার্থক যখন তা মানুষের অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করে। মানুষ নিজের জীবনের সাথে সেসবের মিল খোঁজে। কখনো মিলে যায়, কখনো না। মিলে গেলে তখন খুব অন্যরকম ভালো লাগে। নিজেকে সেই গান , কবিতা অথবা গল্পের চরিত্র হিসেবে আমরা কল্পনা করা শুরু করি। না মিললে অবশ্য ব্যাপারটা খুব কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আমরা লেখক, গীতিকার তথা কোনো সৃষ্টির স্রষ্টাকেই খুব একটা কাছে পাইনা। জিজ্ঞেস করতে পারি না, যেমনটা লিখলেন তেমনটা আমার সাথে হলো না কেন?
“যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই,
কেন মনে রাখো তারে?
ভুলে যাও মোরে , ভুলে যাও একেবারে”
– কবি নজরুলের গানটি রোজ শুনছি বেশ কয়দিন হলো। অপ্রাপ্তি ,শূণ্যতা কি নিষ্ঠুর ভাবে গ্রাস করে মানুষকে, তাই না? এই হাহাকার একসময় মানুষকেও নিষ্ঠুর করে তোলে। দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে পারে ভুলে যেতে। অথচ জানি, এত বছর পরেও যারে মনে পড়ে তারে ভোলা যায় না। তবুও দুঃখের বিনিময়ে দুঃখ দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা মানুষেরা।
একসময় তীব্র মুগ্ধতায় ডুবে থাকা দুজনে যখন দূরত্ব বাড়ে, এতটাই বাড়ে যেখান থেকে আর ফেরত আসা যায়না। তবুও সসীম সময়ের পরিক্রমায় একসময় শূণ্যতা অনুভব হয়, কোনো এক জন হয়ত ফিরে আসতে চেষ্টা করে।
দীর্ঘ ষোলো বছরে এমন দূরত্বের পরই হঠাত নজরূলকে চিঠি লিখেন নার্গিস। ১০৬ আপাচিতপুর রোড়ের বিষ্ণু ভবনে অবস্থিত গ্রামোফোন স্টুডিওতে বসে চিঠির উত্তরে “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই” গানটি লিখেন কবি নজরুল। খুব ভোরে যখন গানের এই কথাগুলো কানে বাজে ,তখন মনে হয় তাকে যদি সামনা সামনি জিজ্ঞেস করা যেতো! গানের কথায় কবি লিখছেন -” আমি কি ভুলেও কোনো দিনও এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে!”
আসলেই কি তাই? কখনোই কি কবির মনে হয় নি পুরনো মানুষকে নতুন করে ফিরে পেতে?
অবচেতন মনে ভাবছি এই প্রশ্নের উত্তরে নজরূল কি বলতে পারেন। অভিমানের খেয়া, আত্মসম্মান, নাকি বাস্তবতার পরিক্রমা?
একসময় মনে হলো মধ্য নিশুতি রাতে জানলার পাশের চেয়ারটায় স্বয়ং নজরুল বসে আছেন। তার দৃষ্টি জানলার বাইরের গাঢ় অন্ধকারে। আমি বিছানা থেকে নেমে তার পাশে দাঁড়ালাম। তিনি খুব শান্ত , মৃদু স্বরে বললেন ” আলেয়া অর্থ জানো?”
” আলেয়া অর্থ আলো”
” কেমন আলো, দেখি বলো তো?”
আমি চুপ করে থাকলাম। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
” আলেয়া আলোর চেয়েও অধিক কিছু।এক ধরণের মায়া, ভ্রম। ঐ যে বাইরে তাকিয়ে দেখো এই নিশিতে আকাশ কেমন দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার দেখবার জন্য অন্য এক আলো!”
বাইরে তাকিয়ে দেখলাম। এক বিস্তৃত ধাঁধা, অসীম শূণ্যতার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ। মনে হচ্ছে অনন্তকাল এই অন্ধকার দেখি।
তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার গ্রিল ধরে আমার সাথেই দেখছেন অন্ধকার,আলেয়া। বললেন,
” মানুষকেও আমরা এভাবেই চাই, যেভাবে এখন মুগ্ধতায় অনুভব করছি অন্ধকার। কিন্তু একসময় অন্ধকার কেটে যাবে, কেউ কেউ আলোর ঔজ্জ্বল্যে মুগ্ধ হবে। কেউ আবার অন্ধকারের প্রতীক্ষায় থাকবে।”
” এখন কি মানুষ আর প্রতীক্ষায় থাকে!”
” তা অবশ্য ঠিক। এখন হয়তো সবার অনুভব অনুভূতির প্রয়োজন পড়ে না”
তখনও আঁধারের তীব্রতা কেটে যায় নি। অনেকক্ষণ কেটে গেছে নিশ্চুপ। ভোরের প্রস্তুতি শুরু হবে হয়ত কিছুক্ষণ পর। ঐ একটা প্রশ্ন তখনও ভাবছি।
“আচ্ছা,
আমি কি ভুলেও কোনো দিনও এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে!,
সত্যিই কি তাই?”
নজরুল হাসলেন। জানালার বাইরে থেকে তার মনোযোগ সরে গেছে অতীতে। এক তীব্র নৈঃশব্দের সুরে বললেন, মানুষ খুব অভিমানী প্রাণী…………..
Views: 13