রঙন ও নন্দিনীর প্রণয় উপাখ্যান
________নাজনীন নাহার
আমি বরাবরই সাধারণ মানুষ।
—-তুমি সাধারণ হলে আমি তো অতি সাধারণ ও নিরীহ।
তুমি কি জানো রঙ্গন!
তুমি অসাধারণ বলেই বেশ টিকে আছো এখনো।
—-হা হা হা হা
হাসালে আমায়।
আমার অবস্থান তো বাঙালি জাতির বস্তু জগতে। তোমার নিশ্চয়ই জানার কথা,
বাঙালি পরিশ্রমী জাতি বাট অধিকাংশই পরশ্রীকাতর। বাঙালি যেমন জেলাস তেমন মেধাহীন জাতি।
—–বিষয়টি খুবই দুঃখ জনক!
তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু প্রহসনে আমিও থমকে যাই রঙ্গন!
তবে হেরে কিন্তু আমিও যাই না। আসলে জিতে যাওয়া এবং টিকে থাকার স্বাদ কিন্তু এক একজনের কাছে এক এক রকম।
—-যারা বড় তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আর যারা গড়হরিবোল তারাই স্বাভাবিক ও সামাজিক।
—-বড়রা বেশি হয়তো পায়। যার নাম স্বীকৃতি, যার নাম ভোগ।
তবে কি জানো!
প্রাপ্তির মধ্যেও অধিকাংশের পরিতৃপ্তি থাকে না।
—-এটা না পাওয়াদের শান্তনা বই কিছুই নয় নন্দিনী।
—-আমি তো দেখছি যারা অতিরিক্ত পায়। তারা বেশির ভাগই ভুলভালও পায়। তাইতো যারা বেশি পায় তারা কেবল আরও চায়, আরও চায়। এখানে পরিতৃপ্তি কোথায়! হয়তো ভুল করে চায় তাই হয়তো ভুল ভাল পায়। যারা বেশি চায় তারা ভুলে ভুলেও চায়। যারা পায় তারা তাই ভুলে ভুলে যায়।
সহজেরে জটিল সমীকরণে বেঁধে নিয়ে কেবল দৌড়ায়, দৌড়ায় আর দৌড়ায়!
আর কেউ কেউ আবার বসে বসে সেই তামাশা দেখে।
তুমি কী জানো!
তামাশা দেখাতেও কিন্তু ভীষণ আনন্দ!
আহা আনন্দ! আনন্দ! আনন্দ!
কিছু আনন্দের কী ভীষণ সুখ রঙ্গন!
—এটা অশিক্ষিত ও নৃশংসতা নন্দিনী। এ আনন্দ বড্ড বীভৎস!
—–কিছু আনন্দ কিন্তু বাধ্যতামূলকও!
—-তুমি আর যাই বলো! আমি বলব এটা বন্যতা।
—-বদলে যাওয়া হাওয়ার পালে রঙো উড়ে যায়,
তাই না দেখে ভণ্ড সাধু প্রভু পানে চায়!
ওহে প্রভু পানে চায়।
আচ্ছা বন্যতার তামাশাটাকে তুমি কী বলবে রঙ্গন?
—-আমি বলব অসভ্যতা। এবং একধরনের প্রতিশোধ পরায়নতা।
—-আর আমি বলব।
যারা বন্যতায় ডুবে সাময়িক সুখ ভোগ করে। তারাই তামাশা করে বেশি। আর যারা এই তামাশার রঙো দেখে আনন্দ পায় এবং মনে মন দুঃখ খেয়ে হাসে তারাই প্রকৃত সাধু!
তবে বন্যতায় ডোবা তামাশা ভোগীরা সত্যিকারের ভোগের মাহাত্ম্যটাই জানে না!
—–না জানুক। তবুও আমি বলব অন্যের ভোগে তামাশা দেখার এই আনন্দ উদযাপনও এক ধরণের অসভ্যতা!
—–হা হা হা হা!
তুমি রেগে যাচ্ছ রঙ্গন।
এ আনন্দ কেবল দেখার তামাশায় নয় প্রিয়!
ভোগের নিমিত্তে বন্যতা, নগ্নতা, স্থুলতা এবং অস্থিরতায় ডোবার নামই প্রকৃত অর্থে অসভ্যতা আর তথাকথিত ভোগবাদ। না চাইলেও যা দেখতে হয়। আর দেখে দেখে চোখে জল আসে। তাকে আনন্দ করে নেয়ায় যে পরীক্ষা পাশ। তার নামই তো অধিকাংশের জীবন। আর তুমি ভোগী হয়েও তাকেই অসভ্যতায় মাপছ!
—ভোগবাদীতাই জীবনের সব নয়।
পৃথিবী এবং সভ্যতা শুধু ভোগের ফসল নয় নন্দিনী।
ত্যাগেরও বটে।
—-ভালো লাগল। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগল রঙ্গন। দিল খুশ হুয়া। হা হা হা হা। তোমার মতো ভোগীর মুখে ভোগ ও ত্যাগের নতুন উপন্যাসটা আমার ভীষণ ভালো লাগল।
কী মনে হচ্ছে জানো!
মনে হচ্ছে ভূতের মুখে রাম নাম শুনছি।
—–প্রতিশোধ নিচ্ছ দেবী!
—–প্রতিশোধ!
প্রতিশোধ নিতে সবাই পারেও না।
জানেও না হে বৎস!
আমরা যে কেবলই ভুক্ত এবং ভোগী! যুক্ত বা বিচ্ছেদে ঘুরে ফিরে পরিনতি একই।
সে তুমি কিংবা আমি। সে ভোগে বা ত্যাগে!
তবে আমি আমার উপলব্ধিতে দেখেছি,
চমৎকার গুছিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারেন কেবল একজনই।
আর তিনিই হচ্ছেন ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি।
—-আর প্রেম!
সত্যিকারের প্রেমে কী প্রতিশোধ আসে! আর ভোগ ছাড়া কী প্রেম পরিপূর্ণতা পায় নন্দিনী!
—প্রেম যেমন ভোগের তেমনি ত্যাগেরও।
বিতণ্ডা নয় প্রেম।
প্রেম এক বিশুদ্ধ বোধ।
সকলে প্রেম বুঝতে পারে না। আর বুঝতে পারে না বলেই ভোগেও সুখ নয়, কেবল অসুখ বাঁধিয়ে ফেলে অনেকেই।
—–আমাকে বলছ নন্দিনী!
এই যেমন আমিও বুঝতে পারি না ঠিকঠাক। তাইতো পেয়েও হারাই অবহেলে!
——অতি চাওয়া এবং অস্থিরতায় যে সুখ নেই একেবারেই।
তবুও অস্থির হয়ে যারা সুখ, কাম, প্রেম ভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমি তাদেরকে দেখি আর তাদের জন্য করুণা হয় আমার।
কী অদ্ভুত!
প্রিয় মানুষ ও প্রিয় ভালোবাসার শরীরে পরিপূর্ণ শরীর যাপন করেও।
পরমুহূর্তেই তাদের মনে হয়। এ প্রেম মিথ্যে। এ স্পর্শ মিথ্যে! এ সুখ মিথ্যে! কিংবা অপূর্ণ! আরও চাই। অন্য কিছু চাই। অন্য কোনো জনে!
আহ্! কী করুণ আর্তি তাদের চোখে, মুখে এবং অস্তিত্বে!
আমি তাদেরকে দেখি,
আমি তাদেরকে দেখি আর আমার মায়া হয় খুব!
মনে হয় একবার যদি পারতাম। যদি পারতাম তাহলে আমি এমন অধমজনদের সত্যিকারের প্রেম শেখাতাম!
কিন্তু তা যে হবার নয় রঙ্গন!
কেন জানো!
—কেন!
—তারা তো প্রেম-ই বুঝে না। প্রেম-ই চিনে না ঠিকঠাক!
কী অদ্ভুত তাই না!
—-প্রেমটা মূলত মানুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতির।
—এটা ক’জন বুঝে বলো!
ক’জন জেনেও মানে বলো!
যদি সবসময় স্থুল কিছু ভোগেই পরিতৃপ্তি আসত!
তাহলে সেখানটাতেই এ পৃথিবী থমকে যেত!
ভোগ এক অমিয় সুধা রঙ্গন।
আহা ভোগ!
সে এক তীব্র নেশা!
সে এক পিনপতন নিরবতা।
এক লীনতার আবেশ!
ক’জন তা উপলব্ধিতে বাঁধতে পারে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময়ে!
পারে না।
জানেই না।
জানেই না ভোগের চুড়ান্ত বোধ মস্তিষ্কের কোন বলয়ে রোপিত আছে ঠিকঠাক!
তাইতো কেবল ছোটে।
কেবল ছোটে।
কেবল ছোটে। কেবল ছুটে বেড়ায়।
ছোটে সময়ে, স্বজনে আর পাওয়ার তীব্রতায় এক মন থেকে অন্য মনে। এক জন থেকে অন্য জনে।
আসলে একটা ঘোর তৈরি করে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা মানব মস্তিষ্কের নিউরনে। নিজেই জানে না মানুষ কি সুখের নেশায় সে ভাসে!
—-বুঝেছি। এ তুমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকেই বললে তো! ঠিক বলেছ নন্দিনী। আমি কেবলই ছুটলাম।
—-শোনো তুমি এতো প্রেম প্রেম না খুঁজে না বিলিয়ে।
পৃথিবীর জন্য সত্যি কিছু রেখে যাও।
আমিও যেন পারি কিছু রেখে যেতে পৃথিবীতে।
অবশ্য এতো ক্ষুদ্র আমি এই মস্ত পৃথিবীর তুলনায়!
তবুও কী ভীষণ চেষ্টা আমার এবং আমার আর তোমার মতো কিয়দাংশের!
এ হয়তো বোকামি , নয়তো সত্য ঠিক এটাই!
—এতো পেয়ে এতো নিয়েও আমাকে মাঝে মাঝে অপূর্ণতা পেয়ে বসে জানো!
তথাপি ভালো থাকার জন্য চেষ্টা করছি।
—-আশীর্বাদ ভব।
ভালো থাকো।
ভালো থাকো রঙ্গন।
—তুমিও বেঁচে থাকো দেবী।
সৌর্যে, বীর্যে, সৃষ্টিতে ও কল্যাণে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকো নন্দিনী।
—সে আমি থাকব রঙ্গন। থাকব ধারণে কিংবা উপলব্ধিতে নিশ্চয়ই। আমি চাই তুমিও থাকো।
— আমি যে তোমার মতো স্থির নই নন্দিনী। আমি যে বারংবার থিতু হতে হতে পূণরায় ভোগের নেশায় উত্তাল। আচ্ছা নন্দিনী আমার কি আদৌ মুক্তি হবে!
—- হবে।
সকলেরই মুক্তি হয়, সকলেই মুক্তি পায় রঙ্গন।
সময় কিংবা মৃত্যু। এদের হাতেই মূলত মুক্তির পয়গাম লেখা থাকে।
—-নন্দিনী!
আমি যে তোমাতেই আমার মুক্তি খুঁজেছিলাম।
—-হা হা হা হা। আবারও তুমি আমায় হাসালে রঙ্গন!
ফের তোমার উপভোগের বাসনা!
তোমার মুক্তি দিবে স্বয়ং লুক্রেতিউসের ” On the nature of the universe ” অথবা ঈশ্বর!
Views: 20