গল্প নয়, সত্যি।
______নাহিদ ফারজানা সোমা
আমার শ্বশুর আব্বা বড্ড পুত্রভক্ত মানুষ ছিলেন। শাশুড়ি মা যখন প্রথম গর্ভবতী হলেন,বাবা নিশ্চিৎ ছিলেন, তাঁর ছোটখাটো জমিদারির উত্তরাধিকার আসতে চলেছে। মা একটি ফুটফুটে কন্যার জন্ম দিলেন। একটু হতাশ হলেও বাবা তাঁর মেয়ের আদরের কমতি রাখেন নি। ছেলেভক্ত বাবার একে একে পাঁচ কন্যার জন্ম হল। কিন্তু বাবা জানতেন রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় ও সাফল্যের কথা। তাই তিনি উদ্যম হারান নি। পঞ্চকন্যার জন্মের পরে এবারে শুরু হল পুত্রদের জন্মানোর পালা। শাশুড়িও সন্তান জন্ম দেন,একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কন্যাও ছেলে-মেয়ের জননী হন।জামাইরা নতুন শ্যালক-শ্যালিকা দেখতে আসেন মিষ্টি হাতে করে। বাবা-মা ফিনিশিং টাচ দিলেন কনিষ্ঠা কন্যার জন্মের মধ্য দিয়ে।এ নিয়ে আমি বাবা-মা’র সাথে বহু ঠাট্টা করতাম। উনারা হাসতেন, রাগ করতেন না।
মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে উঠার পরে আমার বিয়ে হয়।তখন বাবা-মা’র মাত্র ছাব্বিশ জন নাতি-নাত্নি। তবে পারিবারিক প্রথা মতে উত্তরাধিকার নেই। একমাত্র ভাশুরের তখন দুই কন্যা। ওরা দাদা-দাদীর বড় আদরের, কিন্তু উত্তরাধিকার তো নয়।
ইন্টার্ণশিপ চলাকালে আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি।
শ্বশুর-শাশুড়ির ঊনত্রিশ নং (আমার বিয়ের পর আরও দুটি ভাগনে-ভাগনি হয়েছে) আর আমার আব্বু-আম্মার প্রথম নাতি বা নাত্নি হবে। দুই বাড়িতেই আনন্দের জোয়ার। আমি বমি-মাথাব্যথায় অস্থির, তারপরও কন্যাশিশুর চেহারা কল্পনা করি, নানা ডিজাইনের বেবি ফ্রকের কথা ভাবি, আমি আর একমাত্র বোন মিলে মেয়ের নাম ঠিক করি।
আসাদকে বললাম,”ছেলে হলে খুশি হবে না মেয়ে?”
_” অভিয়াসলি মেয়ে।”
আম্মা বললেন,নাত্নি হলে সেলাই মেশিনে নিত্য নানা ডিজাইনের জামা বানাবেন,নাতি হলে মেশিন ই বিক্রি করে দিবেন।
এদিকে শ্বশুর বাড়ি বলছেন,ইনশাআল্লাহ ছেলে হবে।
বাবা বললেন, “আমার নাতি ই হবে।”
ইন্টার্ণশিপের বেতন দিয়ে শাশুড়ি মা’র জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছি, তিনি আহ্লাদ করে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তুমি আনলে কেন?আর কদিন পরে আমার দাদুভাই ই নিয়ে আসবে।”
“দাদুভাই না হলে?”
“হবে,হবে।”
কিন্তু আমি জানি আমার মেয়ে হবে। একটা ছেলেবাচ্চাকে মানুষ করার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। শিশুপুত্র পালন আর বাঁদর পালনে পার্থক্য নেই।
অদেখা হবু কন্যার নাম রাখলাম টুপুর। টুপুর বলে ডাক দিই,পেটে কষে একটা লাথি খাই।
আট মাসের মাথায় আলট্রাসনো করতে গেছি। ম্যাডামকে বললাম,”ছেলে না মেয়ে?”
_”এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া এথিক্সের মধ্যে পড়েনা বাবু, তাও তোমাকে বলছি, মেয়ে। ”
আমি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম। ম্যাডাম আক্ষেপের সুরে বললেন,” এখনও ছেলেবাবু হবে শুনলে বেশির ভাগ মানুষই যে কি খুশি হয়! তুমিও দেখি সেই দলে।”
আমি হতভম্ব। ম্যাডাম কি বলছেন এসব!
_”ম্যাডাম,আপনি না বললেন মেয়ে।”
_” না সোনা, আমি বলেছি মেল (male)”।
আমার জোম্বি অবস্থা দেখে ম্যাডাম হাত ধরে টেনে তুললেন। সান্ত্বনা দিলেন অনেক।
পয়লা এপ্রিল,২০০৩ এ জন্ম নিল আমার প্রথম সন্তান আরিন। পুত্র। বাড়িয়ে বলছি না, অসম্ভব সুন্দর বাচ্চা, নবজাতক হলেও খুব সুন্দর, টুকটুকে,ফুটফুটে, বড় বড় চোখ,মাথা ভরা চুল। আমার মনে হল, এই বাবু ছাড়া আর অন্য কোন বাবু হলে আমার মোটেও ভাল লাগত না।
তারপর প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। আমি সন্তানসম্ভবা হলাম। আবার কন্যাশিশুর স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম । আলট্রাসনোলজিষ্ট পরীক্ষা করতে করতে বললেন,”আপনার মেয়ে হবে।”
ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “মেয়ে বললেন নাকি মেল?”
“মেয়ে,মেয়ে, ফিমেল বেবি। আপনি নিজেই দেখেন।”
তিনি আমার দিকে মনিটর ঘুরিয়ে দিলেন। আমি কি আলট্রাসনো বুঝি? শুধু মনে হল, বেবিটা একটা পা খুব দাপাচ্ছে।
হৃষ্ট চিত্তে বাসায় ফিরলাম। দুই বাড়িতেই আনন্দের জোয়ার। আমার ছেলে অদেখা বোনের নাম রাখল “পরীবানু।” বোনের নামে অংক করতে দিলে সে খুব দ্রুত অংক বুঝে ফেলত। যেমন,”আরিন আর পরীবানুর একত্রে ৩৬ টি মার্বেল আছে। পরীর তুলনায় আরিনের ৮ টি মার্বেল বেশি আছে। কার কয়টি মার্বেল আছে?”
আরিনের অনেক বন্ধুর মায়েরা উনাদের ছেলেদের জন্য পরীবানুকে বুক করে রাখলেন। আমিও এক মেয়ের জন্য সবাইকেই প্রতিশ্রুতি দিলাম অকাতরে।
আরেকদিন দল বেঁধে আলট্রাসনো করতে গেলাম পরীবানুর হাল-হকিকত দেখতে। একই সনোলজিস্ট পরীক্ষা করতে করতে একই সুরে বললেন,”আপনার তো ছেলে হবে।”
আমার ভাল-মন্দ কোন অনুভূতি হচ্ছিল না। শুধু কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব। শিশুকন্ঠের ডুকরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আরিন কাঁদছে,”পরী রে, ওরে আমার পরীবানু।” সনোলজিষ্ট অপরাধী গলায় বললেন,”আমার ভুল হয়েছে আরলি কমেন্ট করে।”
২০১০ সালের ১৯ অক্টোবর পৃথিবী আলো করে জন্ম নিল আমার ছোট রাজকুমার। আয়ান। আয়ানের মুখের দিকে চেয়ে আমার মনে হল,ও মা, এতো ক্ষীরের পুতুল। কি মিষ্টি! কি সুন্দর ! আয়ান ছাড়া অন্য বেবি জন্মালে মোটেও এত ভাল লাগত না।
শত বছরের বেশি বেঁচে থাকো আরিন সোনা ।
শত বছরের বেশি বেঁচে থাকো আয়ান সোনা।
Views: 23