দায়
____সিরাজুম মাহদী
এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে আশেপাশের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পথে তুমুল ব্যস্ততা। ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে সামাল দিতে। বেলা বারোটা, কোরবানির ঈদের আগের দিন।
রাস্তা পার হবার সময় খেয়াল হলো স্যান্ডেলের অবস্থা ভালো না। তাকিয়ে দেখলাম দুই পরত আলাদা হতে শুরু করেছে।
বের হয়েছিলাম ব্যাক্তিগত একটা কাজে। একটা ফটোগ্রাফি কনটেস্টে হঠাত ছবি দিতে ইচ্ছে করল। দিয়েও দিলাম। তবে নিজের ছবি নিজেরই পছন্দ হয়না, বিশেষ কিছু ক্যাপচার হয়নি। তাই ভাবলাম একটু ঘোরাঘুরি করি। দেখি তেমন কোনো বিষয়বস্তু পাই কিনা। অনেকেই দেখি ভিক্ষুক, শ্রমজীবী মানুষের ছবি পোষ্ট করেন। বেশ ভালো রেজুলিউশন প্রায় সবগুলো ছবির। কিন্তু তাদের ছবি যে তোলা হয়েছে এবং পাবলিক শেয়ার করা হয়েছে সেটা কি তারা জানেন?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাত চোখে পড়ল, বেশ নাদুশ নুদুশ একজন রাস্তার পাশে বসে জুতা মেরামতের কাজ করছেন। তার মাথায় পুরান আমলের ছাতা, কাঠের ডাঁট ওয়ালা। ছাতায় অবশ্য মাঝারি আকৃতির একটা ছিদ্র আছে।সেই ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলো গিয়ে পড়ছে তার পেটের ওপর। মনে হচ্ছে ছাতার গায়ে তার নিজস্ব একটা সূর্য। এই দৃশ্য দেখে মনে হলো একটা ছবি তুলে নেই দূর থেকেই। যদিও এধরণের ছবি তোলায় আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
পরে ভাবলাম অনুমতি নিয়েই তুলি। কারন এমন অনেকে আছেন যারা ছবি খুব আগ্রহ নিয়ে তুলতে চান। তাছাড়া তাকে ব্যবহার করব অথচ তিনি জানবেন না সেটা কতটুকু নৈতিক?
আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম।
” কেমন আছেন কারিগর ভাই?”
কারিগর বলায় খানিকটা অবাক হলেন। স্বভাবতই মুচি ডাক শুনতে অভ্যস্ত।
“ভালো, কি কাম?”
“এই যে দেখেন অবস্থা, সেলাই দেন”
” সেলাই দেওয়া যাইবো না, ফোমের জিনিস। পেরাক দেওয়া লাগব”
” পেরাক দিলে তো পায়ে বাজবো!”
” বাজবো না আমি ঠিকমতো দিমু। এগুলা পইরা নেন।”
” আপনার স্যান্ডেলের অবস্থা তো দেখি আমার চেয়েও ভালো, হাহা হা!”
” হয়, এগুলা পিওর চামড়া। একজনে দিয়া গেছিলো।
আপনে এইখানে বসেন।”
” না দরকার নাই থাক।”
” আরে বসেন!”
কারিগর সাহেব তার পাশ থেকে নিয়ে চওড়া একটা শোলার টুকরায় আমাকে বসতে দিলেন। বসার পর তার হাতের দিকে চোখ পড়ল। হাতের বড় বড় লোমের আগায় ফোঁটা ফোঁটা কালি সমস্ত। মনে হলো ঘাসের উপর শিশির পড়েছে। হয়তো তার চেয়েও অধিক কিছু। আমি ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
“ভাই আপনার একটা ছবি তুলি?”
” কিরম ছবি? কাজ করতেছি এরম?”
“হ্যাঁ”
তিনি ইতস্তত হয়ে বললেন
“না ভাই তুইলেন না, আমার সমস্যা আছে”
আমিও একটু অবাক হলাম। আশা করিনাই এমনটা।
“কারণটা জানতে পারি?”
” আমার পরিবার জানে না তো আমি জুতার কাম করি, ছবি তুললে তো ফেসবুকে দিবেন, সবাই দেখবো।”
” হুম, ছবি তো অনেকেই দেয় এরকম। আপনার কারণটা জানলাম।”
ভদ্রলোক এক রকম মন খারাপ করে ফেললেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে কাজ থেকে মনযোগ সরে গেছে, কিছু ভাবছেন।
” পরিবার জানলে অনেক ঝামিলা ভাইজান। একবার হইছেও।”
” কি হয়েছে বলেন শুনি।”
” আমার চাচতো ভাই বিদেশে কাম করে।কোনসময় দেশে আসছে জানিও না। আমার সামনে দিয়া হাঁইটা গিয়া কথা কয় নাই। দূরে গিয়া ফোন দিছে। ফোন দিয়া কয়, কিরে তুই কই? আমি কইলাম, যেইখানে যেমন দেখছোস সেইখানে। আমার সেই ভাই গেরামে গিয়া সবাইরে কইছে আমি জুতার কাম করি, দোকানে চাকরি না।
আমি মনে কিছু করি নাই। যাই করি চুরি তো আর করিনা।”
” তো আপনার সেই ভাই কিসের কাজ করে?”
” বিদেশে গাড়ীর গ্যারেজে কাম করে, আমার মতো তো আর জুতা ছাপ করে না।”
তার গল্পটা এমন হবে আন্দাজ ছিল না। সমাজে অর্থ বিত্ত এখন খুব সংবেদনশীল। সামান্য অর্থের পার্থক্যেও এখন মানুষ অহংকার করে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এই তিন শ্রেণীর ভেতরে এখন আরও অসংখ্য শ্রেণী তৈরি হয়েছে। সেখানে সকল পেশা মূল্যহীন, মূখ্য কেবলই অর্থ। কারিগরের বাক্সের উপর জুতা তুলে দিতে দেখেছি অনেক মানুষকে, দেখেছি জুতা পায়ে রেখে পালিশ করতে হবে এমন আবদার করা লোক। অথচ চকচকে জুতায় হয়তো আমাদের চেহারা কিংবা অহংকার প্রতিফলিত হয় আয়নার মতো, এত ঔজ্জ্বল্য অবশ্য বেশিদিন থাকে না।
” ভাই নেন। অনেকদিন টিকবো।”
” আচ্ছা,
কতো হইলো আপনার?”
” তিরিশ টাকা দেন।
“ভাই আপনারে যে ছবি তুলতাম দিইনাই কিছু মনে নিয়েননা”
” না না মনে করবো কেন! আপনি পথে বসে কাজ করেন বলেই যে ছবি তুলে ফেলতে হবে এমন তো কোনো কথা নাই।”
” এগুলা আসলে কিছুই না, আমরা তো আগের মতোই কষ্ট করি। উনিশ বিশও নাই।”
” হুম। আপনার নামটা জানা হলো না যে!”
” জ্বি আমার নাম জহির, জহিরুল ইসলাম।”
” ঠিক আছে, আজকে আসি তাহলে জহির ভাই।”
দুই কদম যেতেই তিনি ডাক দিলেন,
” ভাই, আমার মোবাইলে নিজের একটা ভালো ছবি আছে, শুধু চেহারা। আপনি চাইলে নিতে পারেন।”
তার মমতা মাখানো কথায় আমি হেসে ফেললাম।
” ছবির প্রয়োজন হবে না। আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে, প্রায়ই দেখা হবে।”
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে, সবচেয়ে সুন্দর করুণ – জীবনানন্দ দাশের লেখা এই লাইনটি বেশ উপলব্ধি করা যায়, যখন সমাজের আপামর জনসাধারণের সাথে কথা বলি। খেটে খাওয়া মানুষের মন নানা গল্পে বিষাদগ্রস্থ প্রাচীরে ঘেরা। আমরা অনেকেই হয়ত না বলে তাদের ছবি তুলি, সেই ছবি হয়ত অনেক প্রসংশিত হয় তবে সেই মানুষের কোনো উপকার হয়না ।আমরা আরেকবার তাদেরকে অভাবী মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেই মাত্র। কে জানে? হয়ত তার পরিবারে এসব জানাজানি হয়, কতো অপমানের শিকার হতে হয়।
জীবনে চলতে গিয়ে আমরা কতজন নানা দোষে এসব দরিদ্র মানুষের কাছে দায়গ্রস্থ। এত দায়ের ভার আমরা সামলাবো কি করে?
বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে রচিত
Views: 15