বিস্ময়
____সুমেরা জামান
খুব ফ্রেশ আর ফুরফুরা ভাব নিয়ে স্কুলে আসলাম। একদিন ছুটির পর বেশ ভালো লাগে ক্লাসে যেতে।
সাত দিনের নাম বোর্ডে লিখে বাহিরে তাকাতেই একজন বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়ল।
সে আমার অফিস রুমের দিকে এগিয়ে আসছে। যেহেতু স্কুলে আমি একমাত্র শিক্ষক আজ তাই চোখ কান খোলা রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হচ্ছে।
দুটো ক্লাস এক সাথে নিচ্ছি।
তিনি কাছাকাছি এসে বলল
মা আমি তোমার কাছে মাত্র দুই মিনিট সময় নিব।
আমি বললাম চলুন ভেতরে
বসে কথা বলা যাক।
আলাপচারিতায় জানতে পারলাম
তিনি আব্দুল জব্বার,
পেশাতে একজন শিক্ষক।
বিএ. বিএড।
১৯৮১ সালে নওগা জেলাতে
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
একটা গার্লস স্কুল যা পরে
এমপিও ভুক্তও হয়।
বেশ ভালই চলছিল সবকিছু।
১টি পুত্র আর একটি কন্যা নিয়ে সুখের জীবন।
তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান।
থমকে দাঁড়ায় সবকিছু। সামান্য কদিন স্কুলে যেতে পারেননি। তার অনুপস্থিতির সুযোগে স্কুল সভাপতি তাকে না জানিয়ে নিয়োগ দেবার চেষ্টা করে অন্য প্রধান শিক্ষক। বাধ্য হন চাকুরিতে রিজাইন দিতে।
ভীষণ কষ্টে ইঞ্জিনিয়ার পুত্রের পড়াটা কমপ্লিট করান। ঢাকা গিয়ে চাকুরীর পর ছেলে আর কোন যোগাযোগ করেনি। চেস্টা করে জেনেছেন পুত্রের জীবনসংসারে নতুন বউ বাচ্চা এসেছে।
এসেছে মোবাইল নাম্বরে পরিবর্তন।
মোবাইল নাম্বারটা নাকি চেঞ্জ করেছে সেই পুত্র তিনবার। বাবা মার সাথে সম্পর্কে রাখবেনা তাই।
আহা জীবন বোধ!
কথাগুলো বলতে বলতে ভীষণ অভিমানে তার চোখ গুলো ভিজে গেল জলে। সেই জল গড়িয়ে কতদুরে যাবে জানিনা তবে জাহান্নামে যে তার পুত্রের জন্য জ্বালানী হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
স্ত্রী বর্তমানে অন্ধ।
ভুল চিকিৎসাতে। তিনি রান্না করে তার স্ত্রীকে খাওয়ান। বেশ কষ্টেয় তাদের জীবন। খেয়ে না খেয়ে, চিকিৎসার অভাবে রুগ্ন দুটো জীবন। মেয়েটাও অসুখী। ড্রাগ এডিকটেড তার স্বামী।
আমার বাবার বয়সী এই মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো।
খুব মায়া হলো। নিত্যান্তই সহজ সরল আর নিরীহ মানুষ। পোশাক আর আচরণ সেটাই বলছে।
জব্বার সাহেবেকে বললাম, চাচা দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যাবেন। আমি লাঞ্চবক্সটা বের করতে যাব তখন তিনি বললেন আমি খাবনা।
তোমার খাবার আমি খেয়ে নিব!
চোখেমুখে বিস্ময়।
আমার অনেক অনুরোধে পর তিনি খেতে রাজি হলেন।
এরপর দু কাপ চা বানালাম।
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে তিনি বলে উঠলেন গতকাল বিকালের পর এখন খেলেন।
আমার চোখ ভিজে গেছে।
এরপর তিনি বলতেই থাকলেন…..
“জানিনা মা তুমি কেমন করে বুঝলে আমি ক্ষুধার্ত তবে আমি ক্ষুধার যন্ত্রনাতে চলতে পারছিলাম না। আর আমার সেই পয়সাও নেই যে আমি কিছু কিনে খাব।
আমার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি মনে রাখবো আজকের ক্ষুধা শেষে এই পরিতৃপ্তির কথা।।
তোমার অনেক………………….”
দু হাত তুলে অনেক দোয়া করলেন।
তখন আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠলো!
আহা কি আমাদের রাস্ট্র!
আহারে কি সমাজ!
এই সংসার!
তার কোলে বেড়ে ওঠা কি সন্তান!
একজন সত্তরঊর্ধ্ব মানুষ পেটের জন্য রাস্তায় নামে, চিকিৎসার জন্য হাত পাতে!
কি ভয়ানক জমাটবাঁধা অন্ধকার
উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাকচিক্যের আড়ালে।
নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষিত সন্তান দিয়ে কি করবে এই জাতি?
যে সন্তান নিজের পিতার প্রয়োজনে পাশে থাকেনা তারা কি
জাতির পিতার কথা মনে করবে কখনো?
এই দেশ, এই সমাজ, রাস্ট্র নিয়ে কখনো চিন্তা করতে পারবে?
খুড়িয়ে চলা এই জাতিকে এগিয়ে নিতে পারবে???????
নঁওগা জেলা থেকে আমার এই অজপাঁড়া তে এসেছেন সাহায্যের জন্য।
নিজের এলাকাতে বলতে পারেন না লোকলজ্জার ভয়ে।।
লিখতে গিয়েও চোখ ভিজেছে
হৃদয়ে রক্তেরক্ষরণ বেড়েছে।
আহা! কি বিস্ময়!
Views: 13