বোধ
____✍সিরাজুম মাহদী
ইউনুস বসে আছেন তার অফিসের একটি কক্ষে। এখন অবশ্য তার অফিস বলাও চলে না, রিটায়ার করেছেন। ছিলেন সিকিউরিটি গার্ড, সবসময় বাইরে হাঁটাহাঁটি, বসে থাকায় অভ্যস্ত। ঝকঝকে ফ্লোরে একটা চেয়ারে বসে থাকতে তার মোটেই স্বস্তি লাগছে না। অনেকক্ষণ পর একাউন্টস সেকশনের পিয়নকে দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো।
“রফিক ভাই! ও রফিক ভাই!”
” কি? কও”
“ঐ যে আমার পাওনা চেক টা আইজ দেওয়ার কথা”
“কোন চেক?”
” ঐ যে স্যারের সাইন লাগবো গতবার কইলেন না!”
” ও আইচ্ছা!বসো স্যার কাজ শেষ হইলে ডাকবো নে”
দুই ঘণ্টা পরে অবশেষে ডাক পড়ে তার। এসি রুমের ভেতর ভীষণ মনোযোগী আনিস সাহেব। সালাম দিতেই হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
” কি চাও! কি কাজ আমার কাছে ?”
“স্যার আমার চেকের টাকাটা যদি আজকেই দিতেন”
“রিটায়ার করছো নাকি?”
“জ্বি স্যার , ছয় মাস হইল।”
“হুম,
তো রফিক তোমারে কিছু বলে নাই?”
“বলছে আপনের একটা সাইন লাগবো”
” আরে মিয়া সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে। টাকা তো বইসা নাই। হিসাব নিকাশ করা লাগে। রফিক বুঝায়া দেয় নাই?”
” দিছে স্যার, টাকাটা কি এখনই দিমু”
” যেদিন চেক নিবা সেদিনই দিবা।”
” আইজই নিয়া আসছি স্যার, স্যার একটু কম করা যায়না খরচটা?”
” অফিসের একটা সিস্টেম আছে বুঝলা! সারাজীবন করছো দারোয়ানি, এসবের কি বুঝবা!”
” আইচ্ছা ঠিক আছে স্যার”
” এখন যাও। বাইরে বসো আমি চেক রফিকরে দিয়া দিবো”
রুমের বাইরে রফিককে পাওয়া গেল না। লাঞ্চের টাইম, তেমন কেউ অফিসে নেই। তিরিশ মিনিটের লাঞ্চ টাইম এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে। পড়ন্ত দুপুরবেলায় ইউনুস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন ঘড়ির দিকে। ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় তার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে না একেবারেই।অনেকক্ষণ পর রফিক অফিসে আসল। মুখে পান, আচার আচরণে তৃপ্তির ছাপ।
” রফিক ভাই!
স্যার আপনের লগে কথা বলতে বলছে।”
“কি বিষয়?”
” খরচাপাতির ব্যাপারে আপনারে বলতে বলছে?”
” পুরা টাকা আনছো? না আনলে হইবো না”
” না, না। পুরাটাই আনছি”
“হুম, দেও”
অফিস থেকে বের হয়ে ইউনূস চেকটা আবার হাতে নিয়ে দেখলেন। সারাজীবনের আয়ের শেষ অংশ। এই টাকার প্রায় পুরোটাই বড় মেয়ের বিয়েতে খরচ হবে। শার্টের ভেতরের পকেটে চেকটা রেখে অফিস থেকে বের হলেন। প্রচন্ড গরম, গ্রীষ্মকাল। মনে পড়ল, বড় মেয়েটা ছোটবেলায় দুধভাত ছাড়া আর কিছু খেতে চাইতো না। আমের দিনে আম দিয়ে মেখে নিজেই খাইয়ে দিতেন। আজকেও ভেবেছিলছেন কিছু টাকা বাঁচবে, সেটা দিয়ে আম কিনবেন কিছু।
ফলের দোকানে দোকানে নানা জাতের আম রোদে চকচক করছে।
এই দৃশ্যে খুব চোখ জ্বালা করছে।
শ্রেণীবৈষম্য এমন একটা সামাজিক বোধ, যা একসময় প্রত্যেকটা পণ্যে পর্যন্ত ধরা দেয়। দোকানের বাইরে একটা কোনায় ঝুড়িতে পঁচন ধরা আম রাখা। ইউনুস নিচু হয়ে বসে দেখলেন, একবারে খারাপ না। খুচরা কিছু টাকায় একরকম পুষিয়েই যাবে তার। একটা পলিথিনে আমগুলো নিতে নিতেই দেখলেন অফিসের সেই স্যার!
” আসসালামু আলাইকুম স্যার!”
কার্টুনভর্তি আম নিয়ে আনিস সাহেব দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লেন।
মানুষ অধিকার খাটাতে পছন্দ করে। অনেক অর্থ, বিত্ত থাকার পরও যখন আমরা প্রিয়জনের মৃত্যু দেখি তখন মনে হয়, পৃথিবী তার বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। স্রষ্টার কাছে প্রশ্ন করি, কেন? কেন এই অবিচার। কেন অযথাই বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো ?
খুব কম মানুষেরই নিজেকে প্রশ্ন করার বোধটুকু হয়। ইহকালে যখন আমরা দুঃখ পাই, হারাই অনেক কিছু তখন মনে পড়া উচিত- আমরা কি দুঃখ দিয়েছি কাউকে? নিজের ভেতরে বোধটুকু জন্মানো উচিত- পৃথিবী আমাকে অবিচার ফেরত দিলো না তো?
আনিস সাহেবের মেয়েটা হঠাতই অসুস্থ হয়ে পড়ল। আট বছরের ছোট্ট মেয়েটা কখনো এমন অসুস্থ হয়নি। অথচ ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে শরীর জুড়ে।
তবুও আনিস সাহেবের বোধ জন্মায় নি। নিজের ভুলের কথা, অন্যায় অবিচারের কথা তার একেবারেই মনে পড়ছে না। তবে এই সৃষ্টির ওপর তার অনেক অভিমান। এতো উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিলো মেয়েটার, তবুও কেড়ে নিলো সব!কেন?
Views: 10