মনে পড়ে
____জয়ন্ত প্রসাদ গুপ্ত
এখন কী হয় জানি না। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় কলকাতায় এত ঘুড়ি উড়ত যে, একটু অতিশয়োক্তি করে বলা যায় যে আকাশ দেখা যেত না। ঘুড়ি ওড়ানোতে আমি যে খুব ওস্তাদ ছিলাম তা নয় । কিন্তু অন্যদিন যাই হোক না বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তো পিছিয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।। যে যার ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আমিও। তবে অন্যান্যদের থেকে আমার ব্যাপারটা একটু আলাদা । একটা ৫ ফুট বাই ৫ ফুট এ রকম-ই হয় তো হবে সে রকম চিলে কোঠার ছাদ। সে ছাদে আবার ওঠার সিঁড়ি নেই । লম্বা ধরণের বাড়িতে পর পর ব্লক । G ব্লক ও H ব্লকের মাঝে অনুচ্চ দেয়ালের পার্টিশন —এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত ১ ইঞ্চি পরিমাণ চেপ্টা লোহার রেলিং । শরীরটাকে ভেতরের দিকে বাঁকিয়ে ঐ রেলিং-এ পা দিয়ে হাতের জোরে দেহটাকে তুলে দিতে হ’ত ঐ পার্টিশনের পাঁচিলে। তারপর সেখান থেকে চিলে কোঠার ছাদে । সূর্যের আলো ফুটি ফুটি করতে না করতে ” রাজকার্য ” শুরু । তারপর সারাদিন অতিক্রম করে সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন আর চোখ চলে না তখন নেমে আসা । মাঝখানে কোনক্রমে গোগ্রাসে একটু টিফিন এবং দ্বিপ্রাহরিক ভোজন। এমনিতে অভিভাবকদের কড়াকড়ি থাকলে হবে কি—–এইদিন একেবারে ছাড়া গোরু । সারাদিন কীভাবে কাটল তার বিবরণে আর যাচ্ছি না । ” ভো কাট্টা— ভো কাট্টা—– আর উল্লাস ধ্বনিতে সারাদিন কলকাতার ছাদ্গুলি সরগরম। ঐ ন্যাড়া , স্বল্প পরিসর ছাদ—-চোখ আকাশে ঘুড়ির দিকে—– একটু বেখেয়ালে পদচারণায় মাত্রা হারালে পপাত ধরণীতল হয়ে ঐ আকাশের ঘুড়ি নয় একেবারে তারা হয়ে যাবার কথা । এখন ভাবতে গেলেই বুক কাঁপে । বয়েসের তফাতে এমনটাই হয়।
যাই হোক, সন্ধ্যা ঘনাতে ঘুড়ি -লাটাই নিয়ে নেমে আসছি । হয় তো শরীরের ক্লান্তি, সারাদিন ধরে অত্যাচারিত চোখের ভ্রান্তি—–সেই রেলিং-এ পা রাখতেই কেমন করে ফস্কে গিয়ে পড়ে গেলাম ছাদের ভেতরের দিকে। ঊরুর পেছন দিকটাতে কেমন একটা অনুভূতি ! তাকিয়ে দেখি প্রায় এক বিঘত জায়গায় সাদা পর্দার মতো কী দেখা দিয়েছে , মুহূর্তে রক্তে ভেসে যেতে লাগল । জানি , এখানে অসহায়ের মতো পড়ে কান্না -কাটি করলে লাভ কিছুই হবে না –বরং প্রচণ্ড ক্ষতি । তাই কোন ক্রমে নিজেকে টেনে টেনে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি দেহটাকে এনে ফেললাম দো-তলায় নিজেদের বসবাসের জায়গায়। বাবা অফিসে ।অন্যদিন ছোটখাটো আঘাত পেলে মাকে লুকিয়ে যেতাম আরো বকুনি খাবার ভয়ে বরং অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি মনোযোগী ছাত্র হয়ে পড়াশুনায় লেগে যেতাম । কিন্তু মাকে ফাঁকি দেওয়া ছিল বড় মুস্কিল। বেশি ভক্তি চোরের লক্ষণ—সেই রকম কোন ফর্মুলা ব্যবহার করে ঠিক তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন ” ” এ্ই কী হয়েছে রে, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটিয়ে এসছিস—- নইলে পড়ায় এতো মতি তো তোর কোন দিন দেখি না । ”—– আমি সেদিন আর এদিক ওদিক নয় সরাসরি ”দিদি ” বলে চীৎকার করে ডেকে তার কাছে নিজেকে surrender করে দিলাম— আমার চেয়ে সাড়ে চার বছরের বড় দিদি ।
[ সামান্য একটু এদিক ওদিক হয়ে যদি সেদিন ভেতরের দিকে পা পিছলে না পড়ে বাইরের দিকে পতন ঘটত চারতলা থেকে একতলায় তা হলে সে কাহিনী আমার কাছ থেকে জানবার সাধ আপনাদের অপূর্ণই থেকে যেত। ]
Views: 12