রাজবন্দীর জবানবন্দী
লেখকঃ কাজী নজরুল ইসলাম
বই রিভিউ – রাজদীপ মজুমদার
🔹ছোট শিশুর হাতে মা বাবা খেলনা তুলে দিলে শিশুটি স্বাধীন ভাবে খেলনাটির সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে। কথা হলো স্বাধীন ভাবে মানে? মা বাবা কি সন্তান কে পরাধীন করে রাখে?
উত্তরে আমরা সকলেই বলবো “না”। তবে এমন পাগল প্রশ্ন কেন? কি মাথার কোষে আঘাত হচ্ছে। একটু আঘাত না হলে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা যে পড়া যায়না।
সন্তান যখন অবুঝ,মাথার কোষ গুলি বোঝার চেতনা আসেনি,তখন মা বাবা তার সন্তান কে বাইরের কোনো কিছু থেকে রক্ষার জন্য কিছু সময় বকে। সন্তান তো সেটা বোঝেনা তখন সে ভাবে তার স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলো,তারপর কাঁদতে বসে যায়।
কি হলো কি ভাবছেন এই বইয়ের সাথে এটার মিলসূত্র কি? আহা!পড়তে থাকুন,লেখায় ঠিক উত্তর পাবেন।
🔲এখানে এই বইয়ের রিভিউ যাওয়ার আগে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো যে, আমি রিভিউ লিখতে একদম পারিনা। তবু ওই একটা জেদ বলে পদার্থ আছে, সেটা মাঝে মাঝে টুকি দিলে লিখি। সেটা ঠিক রিভিউ হয় না বরং সেটা একটা ছোট বই হয়ে যায়। তাই কাউকে জোর করবো না পড়ার জন্য –
“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি
যেটা ছিলো না ছিলো না
সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন।”
🔴অমৃতস্য পুত্রাঃ মানে আগে একটু জানি?
” জাগো অমৃতের সন্তান, জাগো বেদ-ভাষিণীর দল! সেই ঊর্ধ্বের দিব্য শক্তি শান্তি অমৃত রাজে।” এটা কবি কাজী নজরুল ইসলামের “অমৃতের সন্তান” কবিতার অংশ।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে একটু উঁকি দিলে দেখা যাবে মনুষ্য কে ‘অমৃতের সন্তান’ বলা হয়েছে। মনে করা হয়েছে মনুষ্য ওই ঈশ্বরের সন্তান।ঈশ্বরের প্রার্থনায় কেউ দেখেছে তাঁর অবয়ব রূপ আবার কেউ শুনেছে তাঁর বাণী। সে যাই হোক মধ্যা কথা হলো তুই,আমি,তুমি, আপনি সব কিন্তু তাঁর।
তাই তো খুব সহজে বলা যায় ‘অমৃতের সন্তান’ অমর। সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু এরা থাকে।
একটু পুরাতন ইতিহাসে উঁকি দিলে আমরা দেখতে পাবো প্রাচীন গ্রীক ও ভারতীয় ইতিহাসে ঈশ্বর-ঈশ্বরী, দেবদেবীরা দেখতে ঠিক মানুষের মতো। এমনকি ঈশ্বর মানুষের মত কথা বলেছেন আবার সিংহাসনে বসে বিচারকার্য সম্পন্ন করছেন, ঠিক আমাদের মতো।
🔴“রাজবন্দীর জবানবন্দী” কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত একটি প্রবন্ধ।
নজরুল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে” ও নিষিদ্ধ হয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তখন কলিকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁর সাজা হয়। সেই সময় ১৯২৩ সালের ৭ ই জানুয়ারি, জেলে বসে তিনি এই চার পৃষ্ঠার জবানবন্দী রচনা করেন। পরে তা বিভিন্ন পত্র পত্রিকা যেমন, ধুমকেতু, প্রবর্তক, উপাসনা ইত্যাদি তে ১৯২৩ সালেই তা প্রকাশিত হয়।
🔴 এই বই চার পাতার কিন্তু প্রত্যেকটি লাইন নিজের মনকে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন খেলাতে মাথার কোষকে বারবার আঘাত করে যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা ভাবার জগতের পথটা বিশাল বড় করে দেয়। তখন ওই চার পাতা লেখা নিজের মনের চেতনার জগতে হয়ে হয়ে যায় ৪০০ পাতা, কিংবা ৪০০০, কিংবা কোনো শেষ না হওয়া পাতা।
এই বই পড়তে গিয়ে আমার “হীরক রাজার দেশে” সিনেমার কথা মনে এসেছে, আবার মনে এসেছে কলেজে পড়ার সময় হিন্দি সিনেমা “রঙ দে বাসন্তী” কথা, আবার কোনো সময় পড়তে পড়তে মনে এসেছে স্কুল জীবনে সেই ইংলিশ সিনেমার কথা, যা আমার জীবনে প্রথম স্মরণীয় সিনেমা।
সেই “সেভিং প্রাইভেট রায়ান” কথা।
আচ্ছা! মাথায় তো আমরা সবাই কম বেশি তেল দিয়ে থাকি তাই না! আচ্ছা!সেটা কি মাথায় শুধু থাকে? ওই আমাদের চরিত্রের মধ্যে চলে আসে। যাদের মধ্যে এটি বিদ্যমান তাদের ঠিক এই বইটি ভালো লাগবেনা। হয়তো পড়েছে কিংবা পড়বে কিন্তু শিখতে কি পারবে? কি শিখবে?
“রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে – রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।”
এই শেখার কথা বলছিলাম।
🔴 “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামকরণ মানে?
রাজবন্দী মানে কি?
সরকারের বিরোধিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে আটক রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী।
অন্যদিকে জবানবন্দি মানে কি?
বিচারকের নিকট উক্তি বা লিখিত বিবৃতি বা এজাহার।
একত্রিত করলে আমরা পাচ্ছি,
সরকারের বিরোধিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে আটক রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী কে বিচারকের নিকট যে উক্তি বা লিখিত বিবৃতি দিতে হয় তাকেই রাজবন্দীর জবানবন্দী বলে।
বিবেকের বন্ধী কি? (এই বিষয়ের জন্য আমাকে গুগলর সাহায্য নিতে হয়)। বিবেকের বন্ধী জানতে হলে আগে দুটি জিনিস জানতে হবে।
যথা ⬇️
🔆প্রথমে জানি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কি?
এটি একটি মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার বিষয়ের রক্ষা আর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র।
🔆দ্বিতীয় জানতে হবে ইউরোপ কাউন্সিল কি?
১৯৬১ সালে সর্বপ্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের (পরবর্তীতে ইউরোপীয় কাউন্সিল) সকল সরকার প্রধানগণ একটি অনানুষ্ঠানিক সভায় মিলিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম অনুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তখন ফরাসি রাষ্ট্রপতি ভ্যালেরি গিসকারড দেস্তাই একে “ইউরোপীয় কাউন্সিল” হিসেবে নামকরণ করেন।
এবার ব্যাখ্যা তে আসা যাক, —-
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল “রাজনৈতিক বন্দী” শব্দটি কে ভিন্ন পথে ব্যবহার করে। এটি অন্য কারও মতো ব্যবহার করে না। এই জাতীয় সমস্ত বন্দীদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে বা তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত। এই শব্দটি কেবলমাত্র এমন এক শ্রেণির বন্দীদের সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করে যাদের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সুষ্ঠু ও তাত্ক্ষণিক বিচার দাবি করে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যবহারের ফলে শব্দটিতে এমন কোনও বন্দী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উপাদান রয়েছে:
বন্দীর কাজকর্মের অনুপ্রেরণা কিনা, নিজেদের মধ্যে কাজ, বা কর্তৃপক্ষের অনুপ্রেরণা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল “রাজনীতি” সম্পর্কিত মানব সম্পর্কের দিকগুলি উল্লেখ করতে “রাজনৈতিক” শব্দটি ব্যবহার করে। সমাজ এবং নাগরিক শৃঙ্খলা সম্পর্কিত নীতি,সংস্থা বা সরকার বা জনসাধারণের বিষয় পরিচালনা এবং ভাষা, নৃতাত্ত্বিক উৎস, লিঙ্গ বা ধর্ম, অবস্থান বা প্রভাব (অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে) সম্পর্কিত প্রশ্নের সাথে এগুলির সমস্ত সম্পর্ক।
রাজনৈতিক বন্দীদের শ্রেনীতে বিবেকের বন্দীদের শ্রেনীটি গ্রহণ করা হয়েছে,দাবি করে এমন বিবেক বন্ধিদের সাথে সাথে মুক্তি দিতে হবে এবং নিঃশর্ত ভাবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে, এখানে রাজনৈতিক বন্দীদের কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে:
▪️ বিরোধী দলের উদ্দেশ্যগুলি সমর্থন করার জন্য হত্যা বা ডাকাতির মতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলির জন্য পরিচালিত কোনও সাধারণ অপরাধে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি;
▪️ রাজনৈতিক প্রসঙ্গে একটি সাধারণ অপরাধে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি, যেমন কোনও ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষকদের সংগঠনের দ্বারা বিক্ষোভের সময়;
▪️সশস্ত্র বিরোধী দলের একজন সদস্য বা সন্দেহভাজন সদস্য যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা “বিদ্রোহ” এর অভিযোগ আনা হয়েছে.
যেখানে এটি আরও বজায় রেখেছে যে বন্দী বিবেকের বন্দী, বা বিচারের নিন্দা করেছে ব্যতীত, এবং যেখানে এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এটি অন্যায় ছিল।
ইউরোপ কাউন্সিলের সংসদীয় সংসদের আরো অনেক কঠিন সংজ্ঞা আছে:
” ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিকে একজন ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়:
▪️মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশন এবং এর প্রোটোকলগুলিতে নির্ধারিত মৌলিক নিশ্চয়তাগুলির একটি লঙ্ঘন করে যদি এই আটক করা হয়, বিশেষত চিন্তা-চেতনা, বিবেক ও ধর্ম, মত প্রকাশের এবং তথ্যের স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে;
🔹যদি কোনও অপরাধের সাথে সংযোগ না থাকা সত্বেও নিখুঁত রাজনৈতিক কারণে আটক কার্যকর করা হয়;
🔹যদি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য, আটকের দৈর্ঘ্য বা এর শর্তগুলি অপরাধের অনুপাতে স্পষ্টতই এই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়েছে বা সন্দেহ করা হয়েছে;
🔹যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, অন্য ব্যক্তির তুলনায় তাকে বৈষম্যমূলকভাবে আটক করা হয়;
🔹যদি আটকটি হয় বিচারকার্যের ফলাফল যা পরিষ্কারভাবে অন্যায় ছিল এবং এটি কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলির সাথে সংযুক্ত বলে মনে হয়।”
ভাবুন,একটা জবাব বন্ধনীর মধ্যে কত কিছুই জানার আছে।
🔴 এবার আলোচনা করি ‘ধূমকেতু’ ও ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’সম্পর্ক_•••••••
নজরুল ইসলামের জীবনে ১৯২১ সাল এবং ১৯২২ সাল খুবি গুরুত্বপূর্ণ দুটি অধ্যায়।
‘ধূমকেতু’ নামটি নজরুল ইসলাম দেওয়া। ধূমকেতু পত্রিকাটি প্রকাশিত পর সত্যি সত্যি সবার সামনে নজরুল ইসলাম এবং পত্রিকাটি সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত হতে থাকে। সেই সময়কার তরুণ দের কাছে এই পত্রিকাটি এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ও নজরুল ইসলাম দুইজনে একসাথে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের লক্ষ্যে এই অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অর্থ। সেই সময় হাফিজ মাসুদ এগিয়ে আসেন।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১১ আগস্ট ১৯২২। এই পত্রিকার সম্পাদকছিলেন স্বয়ং নজরুল নিজেই। তিনি নিজেকে ‘সারথি’ (সম্পাদক) বলে উল্লেখ করতেন।ম্যানেজার ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। ধূমকেতুর ঠিকানা ছিল ৩২ কলেজ স্কয়ার।
এই পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন!’
অন্যদিকে ধূমকেতুর গদ্য, সম্পাদক লিখেছিলেন,
‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে “জয় প্রলয়ংকর” বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল।
আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য।… ধূমকেতু কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানে মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।’
সম্পাদকের আরেকটি নমুনা:
‘…সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজটরাজ মানি না।… ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে।’
‘আগমনী’ প্রকাশ হতেই ব্রিটিশ সম্রাজ্য রীতিমতো এক অজানা ঝরে কেঁপে উঠলো। মনে প্রশ্ন আসছে তো কি লেখা ছিল?
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার
মূর্তি-আড়াল
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী
শক্তি-চাড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের
দিচ্ছে ফাঁসি
ভূভারত আজ কসাইখানা—আসবি কখন
সর্বনাশী?’
ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের বিপ্লব ও বিদ্রোহের ইঙ্গিত পেয়ে ধূমকেতুর এই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে এবং রাজদ্রোহের ‘অপরাধ’–এ কুমিল্লা থেকে নজরুল ইসলাম কে গ্রেপ্তার করলেন। এরপর কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে শুরু হলো তাঁর বিচার। বিচারাধীন অবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নজরুল লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত আত্মপক্ষীয় বয়ান ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।
🔴‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ কিছু উক্তি—–
‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে—রাজার মুকুট, আরধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড, আরজন সত্য, হাতে ন্যায় দণ্ড।…
আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়।…
আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস না বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে, এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যায়, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো—এ কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত আত্মামাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায়-শাসন-ক্লিষ্ট বন্দী-সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি আজ রাজদ্রোহী?…
আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। আর যা অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,…আমি সত্য-রক্ষার, ন্যায় উদ্ধারের বিশ্বপ্রলয়-বাহিনীর লালসৈনিক।’
🔴‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ কেন পড়বো???
পরাধীনতার অবসান ঘটানো, মানবিক অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অত্যাচারীর মুখোশ উন্মোচন, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো, যাবতীয় কাজের জন্য এই বইয়ের পাতা নিজের বুকে অঙ্কন করা উচিত। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ ইত্যাদির জন্য রুখে দাঁড়াবার জন্য —এই বই পড়া উচিৎ। স্বাধীন দেশের ছবি দেখার জন্য এই বই পড়া উচিৎ।
এখানে বলতে ইচ্ছা করে হীরক রাজার দেশে’র সেই সেই বিখ্যাত ডায়লগ এর কথা
“দড়ি ধরে মার টান, রাজা হবে খানখান”।
২০২২ সালে ভারতবর্ষের রাজনীতি যে ভাবে উল্টো পথে হাটছে তাতে এই বই আবার পড়া উচিৎ। শুধু কি রাজনীতি,সাথে আছে রাম-রহিম কে বিচ্ছেদ করার রাজনীতি। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশের অধিকাংশ লোক আছে ওই রাম-রহিমের আগুনের মধ্যে ঘি’র রসদ দিয়ে দেবার জন্য। তাই নিজের ভূমি কে ভালোবেসে শক্ত করে নতুন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখার জন্য এই বই পড়া উচিত। শুধু ভারতবর্ষ না সব দেশের উচিৎ নতুন সুপ্রভাতের জন্য এই বই পড়া।
শেষ করার আগে বলি,
বাংলা সাহিত্যকে ধর্মের চাদরে ভগ্ন না করে বরং সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার স্রোতে বাংলা সাহিত্যকে সবার সামনে উপস্থিত করাই হোক আমাদের কাজ। মনে ধর্ম, আর উপরে মিথ্যা সাহিত্যের আবরণ থাকলে বিকাশ নয় বরং ধ্বংস নেমে আসবে। এবং সেই ধ্বংসে সে একা থাকবে না তার সাথে থাকবে একটা গোটা সমাজ।
Note – সন্তান হলো দেশ আর মা বাবা হলো প্রকৃতি।
Views: 102