অন্তর্জ্বালা
_____মোঃ মশিউর রহমান ভূঁইয়া
ফিল্ডে যোগদানের পর থেকেই লোকটাকে বিভিন্ন জায়গায় দেখতাম। কখনো অফিসে। কখনো প্ল্যান্টে। কখনো গেটের বাইরে রেস্টুরেন্টে। আবার কখনোবা কর্মচারীদের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসনিক অফিসের সামনে জড়ো হওয়া জটলায়। মুখোমুখি হতেই একটা মুচকি হাসি মতো দিত। এই মুচকি হাসিটাকেই ছিলো আমার যতো ভয়। ভয়ের কারণ হলো আমার সাথে এখনো তার পরিচয় হলোনা কথা হলোনা অথচ সে আমাকে দেখলেই হাসে। এমনিতেই ফিল্ডে আসার আগে এখানকার ছোটো ভাইদের সম্বন্ধে নানা জনের কাছ থেকে বিভিন্নধরনের উল্টাপাল্টা কথাবার্তা শুনে শুনে একটু ভয়ে ভয়েই ছিলাম।
সপ্তাখানেক পর একদিন সেই লোক স্ব শরীরে অফিসে আমার রুমে এসে হাজির। এসেই একেবারে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে বসে পড়লো। আমি তখন কিছু জরূরী কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ তার আগমনে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সোজা কথা আমি তাকে ঠিক ঐ মুহূর্তে আশা করি নাই। লম্বাচওড়া দেহের গড়ন। গায়ের রঙ একেবারে কালো। গালে একটা লম্বা কাটা দাগ। দেখলেই মনে হবে বুঝি কোথাও মারামারি করে এই চিহ্ণ অর্জন করেছে। গায়ে রঙ্গিন একটা শার্ট আর জিন্স জাতীয় প্যান্ট। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটা কাষ্ঠ হাসি দিয়ে তার আগমনের কারণ জানতে চাইলাম। সে অত্যন্ত সুন্দর সাবলিলভাবে আমার কথার উত্তর দিতে থাকলো।
-আমার একটা ওভারটাইম বিল ছিলো। বললাম
-তাই নাকি। আচ্ছা আমি দেখে দিচ্ছি।
ইত্যবসরে সে তার নাম জানালো। রহিম মিয়া। পদবী টেকনিশিয়ান।
এরপর সে আমাকে কোন জেলার মানুষ। কোথায় বড়ো হয়েছি। কেনো এই অজপাড়াগাঁয়ের ফিল্ডে পোস্টিং নিলাম। এজাতীয় নানা প্রশ্ন করলো। প্রত্যেকটা কথাই সে অত্যন্ত ভদ্র এবং শালীনভাবেই বলে যাচ্ছিলো। সে তার পদ পদবী এবং আমার পদ পদবীর প্রতি সম্মান রেখেই আলাপ করছিলো। তার কথায় আমি কিছুটা আস্বস্ত হয়ে ধীরেধীরে সব কথার উত্তর দিলাম। তার সাথে আলাপচারিতায় তাকে আমার একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করলো। এরপর অনেক কথা শেষে সেদিনের মতো রহিম মিয়া বিদায় নিলেন।
তারপর থেকে ফিল্ডের এখানে ওখানে দেখা হয়ে গেলে সেই আগের মতো সালাম দিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। তার এখনকার মুচকি হাসিতে আর আমার কোনো সমস্যা হয়না। মাঝে মাঝেই রহিম মিয়া আমার অফিস রুমে আসে। এটা সেটা নিয়ে দুজনে কথা বলি। বেশিরভাগই কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় নিয়েই কথা হতো। সত্যি কথা বলতে কী এই আসা যাওয়ায় টুকটাক কথা বার্তায় তার সাথে আমার একটা সুসম্পর্ক হয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। এরই মধ্যে একদিন কিছুটা উস্কুখুস্কু চেহারায় এসে হাজির। তাকে দেখেই আমি ডেকে বসাই৷ কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা হতাশার সুরেই বললো-
-ভালো নেই স্যার!
ভালো না থাকার কারণ জানতে চাইলে এবার মনে হলো আরো একটু যেনো সংকুচিত হয়ে এলো। এরপর প্রায় ছলছল চোখে তার একান্ত কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে শুরু করলো। আমি থামাতে চাইলে উল্টো আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো-
-না স্যার আমাকে থামাবেন না। আমাকে বলতে দিন। আমি আপনার কাছে আমার কষ্টের কথাগুলো বলে একটু হালকা হতে চাই। আমি আর থামালাম না। রহিম মিয়া বলতে থাকেন। মূলতঃ স্ত্রীকে নিয়ে উনার যতো কষ্ট। স্ত্রীর নীরব অত্যাচারে রহিম মিয়ার জীবন অতিষ্ঠ। সবাই জানলেও কষ্ট ভাগ করার মতো বা দুঃখের কথা বলার মতো কাউকে না পেয়ে আমার সাথেই একটু ভাগ করতে চান বলেও জানান৷ তাই আমি উনাকে একটু হালকা করার জন্যই অনুমতি দিলাম। রহিম মিয়া বলতে থাকে-
-ভালো ফেমিলেতেই বিয়ে করেছিলাম স্যার। কিন্তু কে জানতো ভালো ফেমিলির খারাপ মেয়েটাকেই যে তারা আমার কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। বিয়ের প্রথম প্রথম কিছুদিন ভালোই ছিলো। কিন্তু কিছুদিন পর এই ফিল্ডে বাসা নিয়ে তাকে উঠার পর থেকেই শুরু হলো তার অত্যাচার।
-জানতে চাইলাম কেমন অত্যাচার। জানালো-
-ঠিকমতো কবে সকালে নাস্তা খেয়ে কাজে এসেছি মনে করতে পারবোনা। দুপুরে খেতে গেলে দেখা যায় ভাত হয়েছে তরকারি হয়নি৷ জিজ্ঞেস করলেই শুরু হয়ে যায় চিৎকার চেঁচামেচি। কোনো কথাই শুনবেনা। যখন যেদিকে খুশি সেদিকে চলে যাবে। চিৎকার চেঁচামেচি কখনো কখনো এমন পর্যায়ে চলে যেতো প্রথম প্রথম আশেপাশের লোকেরাও ছুটে আসতো। এখন আর আসেনা। সোজা কথা সে আমার কোনো কথাই শুনেনা। শুনতে চায়না।
আমি চা নাস্তা আনালাম। রহিম মিয়া খেলো। আবার বলতে শুরু করলো।
-ইতোমধ্যে আমার দুই ছেলে জন্ম নিলো। ভাবলাম ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী। কিছুই হলোনা। আর না স্যার! অনেক হয়েছে। এবার একটা এসপার উসপার করেই ছাড়বো। রহিম মিয়ার এই কথায় আমি চমকে উঠে পাল্টা প্রশ্ন করলাম। এসপার উসপার মানে? উত্তরে সে জানালো বিবাহ বিচ্ছেদ। এসব কথা বলতে বলতে সে প্রায় কেঁদে ফেললো। আমি মনে মনে ভাবলাম হায়রে! কালা পাহাড়ের মতো কি দশাশই রহিম মিয়া যাকে দেখলে মানুষ ভয় পায় অথচ এই মানুষটি ই ভেতরে ভেতরে কতটা ভাঙ্গাচোরা! তার সাথে আলাপ না করলে কেউ কোনোদিনও বুঝতে পারবেনা এই ভয়ংকর চেহারার মানুষটি কতো কষ্টই না সহ্য করে চলেছে। কী নিদারুণ অন্তর্জ্বালাই না বয়ে বেড়ায়!
তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পরদিন আবার আসতে বলে সেদিনের মতো বিদায় দিলাম।
রহিম মিয়া চলে যাবার পর পাশের রুমের আরেক অফিসার আমার রুমে প্রবেশ করেই চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন-
-কি ব্যপার রহিম মিয়ার সাথে তো দেখছি বেশ ভালোই আড্ডা জমিয়ে ফেলেছেন! একটু সাবধানে থাকবেন ! রহিম মিয়া কিন্তু বেশি সুবিধার মানুষ না। সুবিধার মানুষ নয় শুনে আমি জানতে চাইলাম কেমন অসুবিধার মানুষ? উনি বলতে থাকলেন-
-জানেন সে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রঙিন পানি খায়। পানি খেয়ে বউকে মারধর করে। আরো অনেক কথা বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন। উনি চলে যাবার পর আমি মনেমনে ভাবলাম রঙিন পানি খায় এটা একটা বদভ্যাস হতে পারে। কিন্তু তার এই পানি খাওয়ায় অন্য কারো তো কোনো অসুবিধা হয়না। কিন্তু এমনো তো আছে রঙিন পানি খায়না। অথচ ভেজা বিড়ালের মতো ভদ্রলোকটি সেজে অবৈধ উপায়ে কোম্পানির অর্থ লোপাট করে! তাহলে কে ভালো? আর বউকে মারে! এটা তার আশেপাশের মানুষেরাই ভালো বলতে পারবে৷ আসলে কী সে বউকে মারে না বউ তাকে মারে! আমি নিজেও খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি আসলেই সে একটু আধটু পান করে। হয়তো পারিবারিক ঝামেলা থেকে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু স্বস্তি দেয়ার জন্য এই পান করা। তবে এও জেনেছি তার দ্বারা আজ পর্যন্ত ফিল্ডের কোনো এমপ্লয়ির কোনো ক্ষতি হয়েছে কেউ বলতে পারবেনা।
পরদিন রহিম মিয়া সকাল দশটা নাগাদ আমার রুমে আসলো। এসেই বললো –
-স্যার আমাকে একটা উপায় বলে দিন৷ আমি এই অবস্থায় আর বাঁচতে পারবোনা।
রহিম মিয়ার কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আমি তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে এটেন্ডেন্টকে দিয়ে চা সিংগাড়া আনিয়ে খেতে বললাম। তার উদ্দেশ্যে বললাম-
-আমি যা বলবো মনযোগ দিয়ে আপনাকে শুনতে হবে। আমার বলা শেষ হলে আপনি বলবেন। এর আগে কোনো কথা বলতে পারবেননা। রহিম মিয়া রাজি হলো। আমি বললাম-
-আপনার অর্ধেক জীবন তো দুঃখে কষ্টে যেভাবে হোক শেষ হতে চললো। বাকি আছে অর্ধেক জীবন। আপনার কী সুন্দর দুটি ছেলে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অন্ততঃ এই দুটি বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও না হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিন। দেখবেন একদিন যখন তারা মাবুষের মতো মানুষ হবে তখন আপনার আজকের এই দুঃখ কষ্ট আর থাকবেনা।
রহিম মিয়া নিবিষ্ট মনে আমার কথা শুনছিলো। আমি বলতে থাকলাম-
-বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে হয়তো আপনারা দুজন ভাববেন যাক বাবা বাঁচা গেলো। এমনও হতে পারে আপনারা আবার বিয়ে করে সংসারি হলেন৷ একজন বৌ পাবেন অন্যজন স্বামী। কিন্তু বাচ্চা দুটো কী পেলো? যদি আপনার কাছে থাকে তাহলে তারা সৎমা পাবে। আমাদের সমাজে সৎমাদের অবস্থা নিজেই জানেন। অর্থাৎ তাদের আর দুঃখ কষ্টের অবধি থাকবেনা। আর মায়ের সাথে যাওয়াটা তো এক প্রকার অসম্ভব ই বটে। তাহলে বুঝুন! আপনাদের একটা সিদ্ধান্তে তাদের জীবনে কী দুর্ভোগটাই না নেমে আসবে। কী দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখিই না তাদেরকে হতে হবে। মানুষ হওয়া তো দূরের কথা পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে দাঁড়াবে। এতো আদরের সন্তানের এই হাল হলে আপনি বাবা হয়ে কেমন করে সহ্য করবেন?
আমার কথা শুনে রহিম মিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কান্না জড়িত কন্ঠেই বললো স্যার আমি এখন কী করবো! কোনোরকমে তার কান্না থামিয়ে বললাম-
– মাথা থেকে বিচ্ছেদের চিন্তা বাদ দিয়ে বাচ্চা দুটোকে কী করে মানুষ করা যায় সেদিকে মনযোগী হোন। তাদের লেখাপড়ার প্রতি খেয়াল দিন। বউকে তার জায়গায় থাকতে দিন। রহিম মিয়া আমার কথায় একমত পোষণ করে সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
তারপরও আমার রূমে তার যাতায়াত ছিলো। সাংসারিক নানা বিষয়ে আলাপ হতো। বউয়ের সুমতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলেই সেই মুচকি হাসিটি দিয়ে বলতো-
-এইডা আর ঠিক হইবোনা স্যার!
একদিন আমি ফিল্ড থেকে বদলি হয়ে হেড অফিসে চলে এলাম। রহিম মিয়াও কদিন পর বদলি হয়ে অন্য স্থাপনায় চলে গেলো। তারপর একেবারে অবসর নেয়া পর্যন্ত আর আমার সাথে তার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। জীবনের টানে নিষ্ঠুর সময়ের কঠিন বাস্তবতার কাছে হার মেনে আমরা প্রায় একে অপরকে ভুলেই গিয়েছিলাম।
অবসরের পর ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। টুকটাক গল্প কবিতা ইত্যাদি লেখালেখি করে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। এই যখন অবস্থা তখন অবসরের বছরখানেকের মাথায় হঠাৎ করেই একদিন এক ভদ্রলোক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন। সফেদ একমুখ চাপদাড়িওয়ালা টাইমলাইন ছবি। ভালো করে জানার জন্য টাইমলাইনে ঢুকে দেখি আরে এ তো রহিম মিয়া! রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করলাম। দুদিন পরেই মেসেঞ্জারে কল করলেন।
-স্যার কেমন আছেন।
-ভালো বলেই তার সম্বন্ধে জানতে চাইলে জানালো-
-ভালো আছি। গতো বৎসর অবসরে গিয়েছি। সেই বছরই হজ্ব আদায় করলাম। বড়ো ছেলেটা ডাক্তার। একটা হসপিটালে আছে৷ ছোটো ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আছে। দুজনকেই বিয়ে করিয়েছি৷ বড়োটার ঘরে আল্লাহ্ ‘র রহমতে নাতিও আছে। নাতি নিয়ে আপনাদের দোয়ায় ভালই সময় কেটে যায়৷
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাওয়াতেই বুঝলাম রহিম মিয়া ভালো আছে৷ মানুষ যখন সুখে থাকে তখন আবেগের আতিশয্যে কথা বলে। রহিম মিয়ার আজকের এই পরিবর্তন এবং খুশি হবার কথা শুনে আমার ভালো লাগলো।
কথার ফাঁকে বললো-
-স্যার সেদিন যদি আপনার সাথে ফিল্ডে দেখা না হতো হয়তো আজকের এই দিনগুলো নাও দেখতে পেতাম।
জবাবে আমি বললাম সব আল্লাহ্ ‘র ইচ্ছা। এবার বলেন ঐ দিকের খবর কি?
হেসে উঠে সেই আগের মতোই শুধু বললো-
-এইডা আর ঠিক হইবোনা স্যার!
Views: 11