উপন্যাস: স্বপ্নচূড়া
লেখক: মৌলী আখন্দ
“মৌলী আখন্দের ‘স্বপ্নচূড়া’ যেই স্বপ্ন দেখায়
“যুগে যুগে সব যক্ষপুরীতে শুধু লোভ আর সঞ্চয়। এর বিপরীতে মানুষের সত্যিকারের প্রাণ অসীম। আমাদের প্রত্যেকের জীবন ভরা পাপে ও পুণ্যে। কেউ নিষ্কলঙ্ক নই, কেউ নই কলঙ্কের একচ্ছত্র দাবিদার।”
সোজাসাপটা কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করার বয়সে এখন আর নেই তবু কথাশিল্পী মৌলী আখন্দের উপন্যাস “স্বপ্নচূড়া” র ব্যাককভারে উদ্ধৃত বাক্যগুলো আমাকে নতুনভাবে আক্রান্ত করে। তাই বৃষ্টিসজল সন্ধ্যায় আবেগঘন কৌতূহল নিয়ে স্বপ্নচূড়ার এক একটি পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে পরিচিত হই কনক, কাঁকন, কাঞ্চন, ইমরান, হাসান, শাওন, রূপা, রেইনি, হিমেলের সঙ্গে। আর দেখি এক ঝাঁক স্বপ্নাক্রান্ত তরুণ-তরুণীর জীবন কীভাবে নানাদিকে বাঁক নেয়।
“স্বপ্নচূড়া” একটি নাট্যদল। এই নাট্যদলের কর্মীরা মূলত দুইটি জীবন যাপন করে। একটি “রক্তকরবী” নাটকের জন্য নির্মিত স্ক্রিপ্টের ভেতরে, আরেকটি রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে এই কঠিন পৃথিবীর বুকে। নাটক মঞ্চস্থ করার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রিহার্সালের একটা খণ্ডিত সময়কে ঘিরে উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়।ধীরে ধীরে বিভিন্ন চরিত্রের কোলাহলে এই রূঢ় পৃথিবীর সঙ্গে রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরীর সাদৃশ্য প্রকট হতে থাকে।
স্বপ্নচূড়ার প্রতিটি চরিত্রের স্বপ্নপূরণের কাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নভঙ্গের শংকা, উভয়ের পারদ যেন পাশাপাশি ওঠানামা করে। সেই সঙ্গে বিপর্যস্ত করে পাঠককেও। রেইনির জীবনে উদ্ভূত সংকট আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওকে চূড়া থেকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে দেয়। আসলে স্বপ্ন তো দেখে সকলেই, স্বপ্নের চূড়ায় তো সবাই পৌঁছাতে পারে না। কেউ কেউ মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে, কেউ বা তাল সামলাতে না পেরে চূড়ার নিকটবর্তী হতে না হতেই ভারসাম্য হারিয়ে অস্তিত্বশূন্য হয়ে যায়।
স্বপ্নচূড়া উপন্যাসের রেইনি, পিংকি এমনই দুই চরিত্র। যারা স্বপ্নচূড়ায় পৌঁছানোর বাজিতে জয়ী হতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। বাস্তবতার এমন নির্মমতার পূর্ণাঙ্গ রেখাপাত দুই মলাটের ভেতরে তুলে আনা সহজ কাজ নয়। তবু বলতে দ্বিধা নেই এই কাজে হাত দিয়ে ভালোভাবেই উৎরে গেছেন এই আখ্যানকার।
ঔপন্যাসিক মৌলী আখন্দ নিজে তরুণ বলেই হয়তো তারুণ্যের সংকট, শংকা, সম্ভাবনা আর স্বপ্ন সবই তার নখদর্পনে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের কম-বেশি দৃশ্যমান উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। ছোট ছোট সরল বাক্যে উপন্যাসের গাঁথুনি মজবুত করার প্রয়াসে তিনি সফলও হয়েছেন। প্রায় প্রতি পর্বের শেষে রক্তকরবী নাটকের বিভিন্ন সংলাপের যৌক্তিক ব্যবহার আখ্যানের কাঠামোকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
“আমি প্রকাণ্ড মরুভূমি-তোমার মতো একটি ছোট্ট ঘাসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত” সংলাপটি আওড়াতে আওড়াতে হাসান যখন নিজের সংকটের কথা কনককে না বলতে পারার যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটায় তখন পাঠকের মনে নিভৃতে হাহাকার জেগে ওঠে। আবার “বিধাতার সেই বদ্ধ মুঠো আমাকে খুলতেই হবে” সংলাপের সঙ্গে রেইনির নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা দেখে মনে হয়, এই আত্মপ্রত্যয়টুকু না থাকলে পৃথিবীটা সত্যি সত্যি বাসের অযোগ্য হয়ে উঠতো।
উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্রকে নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যেমন বহু পথ হাঁটিয়েছেন লেখক, তেমনি মাঝেমধ্যে সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখিয়েছেন।
যদিও পাঠশেষে মনে হয়েছে স্বপ্নচূড়ার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কনক বা শাওনের জীবনের গল্প যতোটা আসতে পারতো ঠিক ততোটা আসেনি।
তবে লেখক মৌলী আখন্দের কলম স্বপ্ন আর কল্পনার ফারাকের কথা বলছে, সম্ভাবনার কথা বলছে এ কথা দৃঢ় স্বরেই উচ্চারণ করা যায়। এমন কলম কালে কালে আরও সৃষ্টি করবে, আরও শাণিত হবে-এমন স্বপ্ন দেখার সাহস করা বাহুল্য হবে না বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই।
Views: 24