কোয়েলের কাছে
লেখক – বুদ্ধদেব গুহ
রিভিউঃ-তাসলিমা খানম
“কোয়েলের কাছে ” বইটি পড়েছিলাম অনেক দিন আগে। এবারে আবার বইটি পড়তে যেয়ে দেখি আমার সংগ্রহে নেই।তারপর কিভাবে যেন প্রিয়জনের হাত ধরে বইটি পেয়ে গেলাম। বইটি হাতে পেয়ে আনন্দ বেড়ে গেল বহুগুণ। কিন্তু কিছুতেই পড়ার সময় করে উঠতে পারছিলাম না।
কেননা বইটির লেখক যে বুদ্ধদেব গুহ। যার বই পড়তে হয় নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে। এবারে একান্ত কিছু সময় পেয়ে ডুব দিলাম প্রিয় বইয়ে। যারা বুদ্ধদেব গুহ নিয়মিত পড়েন , তারা জানেন উনার বই মানেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর নির্জনতায় অবগাহন করা। একটা বদ্ধ রুমে বসে কী করে পাঠককে মহুয়ার গন্ধে মাতাল করা যায়, শালবনে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা যায়, তার সব কৌশল জানা আছে প্রিয় লেখকের। পাশাপাশি আছে মানব চরিত্রের নানাবিধ বৈচিত্র্যময়তার উপস্থিতি যা পাঠক পড়ার আগে কল্পনাও করেননি। সেইসব রসদ নিয়েই উনি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। বইটি পড়ার পর পাঠকের বাস্তব জীবনের ব্যস্ততায় অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগে বৈকি।
“কোয়েলের কাছে ” বইটির পটভূমি রচিত হয়েছে আরেক গুণী লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের “পালামৌকে” ঘিরে। সেই “পালামৌ ” আবার নতুনরূপে ফিরে এসেছে বুদ্ধদেবের হাত ধরে। আর তাকে ঘিরে রেখেছে স্রোতস্বীনী “কোয়েল “!
কাহিনী সংক্ষেপ
———————–
স্যান্ডারসন কাগজ কোম্পানির ফরেস্ট অফিসারের চাকরি নিয়ে কলকাতার ছেলে এলো রুমান্ডিতে। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রজেন ঘোষ পৌঁছে দিয়ে গেলেন ওর বাংলোতে।
সারাজীবন কলকাতার কোলাহলে অভ্যস্ত ছেলেটির এই নির্জন বাংলোতে রাতটা কেমন কাটল, তা বোঝাই যায়।
রাতটা কাটতে না কাটতেই আরও এক বিস্ময় এসে হাজির হলো কলকাতার বাবুর নির্জন বাংলোর দোরগোড়ায়। ঘুম ভেঙে বাইরে এসে দেখে একটা কুচকুচে কালো ঘোড়া উঠোনে বাঁধা, পাশে দাঁড়িয়ে তার সওয়ার দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে সুপুরুষ যশোয়ন্তবাবু। এ বনের রেঞ্জার। “পালামৌ ” যার ধমনিতে বিরাজ করে, মহুয়ায় মাতাল করা এই জংগলের প্রতিটি গাছ, বুনো ফুল, আদিম মানুষ আর প্রাণীদের সাথে যার নিবিড় সখ্যতা। “যশোয়ন্ত ” এ বনের আদিম পুরুষ। যার পুরোটা জুড়েই আছে বন্যতা। তার মাঝে যেন কী এক অমোঘ আকর্ষণ আছে! কেউ চাইলেও তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না! আড়ালে ওর বদনামের অন্ত নেই, তথাপি এই জংগলের সবার খুব কাছের মানুষও সে।
এই “যশোয়ন্তই “কলকাতার লালবাবুকে মহুয়ার গন্ধে মাতাল হতে শিখিয়েছিল।কিভাবে জঙ্গলকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে এদের ভাষা বুঝতে হয় সব শিখিয়েছিল যশোয়ন্ত। কী করে বাতাসে ভেসে বেড়ানো বুনো ফুলের গন্ধের মধ্যে একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করা যায় সেটাও একসময় আয়ত্বে এসে যায় কলকাতার বাবুর।
যশোয়ন্ত পুরোদস্তুর শিকারী। সেই যশোয়ন্তই নির্বিচারে প্রাণী হত্যার বিরোধী। এর জের ধরে ওর শত্রুও জুটে যায় অনেক। যশোয়ন্তের হাত ধরে কলকাতার নির্বিরোধী ছেলেটিও সাচ্চা শিকারী হয়ে উঠে।
গল্পের ধারাবাহিকতায় ঘোষ বাবু আর তার স্ত্রী শর্মিলা দেবীর চারিত্রিক বৈপরীত্যও উঠে আসে।
গল্পের মাঝখানে হঠাৎ স্নিগ্ধ, সুরুচি সম্পন্ন, দীঘির টলটলে জলের মতো চোখের চাহনি নিয়ে হাজির হয় ” মারিয়ানা ” নাম্নী এক নারী। নির্জন পাহাড়ের এক গাঁয়ের বুকে দোতলা কাঠের বাংলোতে যার বসবাস। ওরই সুত্র ধরে সুগত নামক এক লেখকের আবির্ভাব ঘটে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে সুগতের মর্মান্তিক মৃত্যু দিয়ে।
আর পুরো গল্প জুড়ে ছিল “পালামৌ ” আর “কোয়েল” নদীকে ঘিরে আদিম মানুষ গুলোর জীবনাচরণ। ওদের সহজ সরল জীবন,ওদের ঐতিহ্য, ওদের কত রকম পালা পার্বণের গল্পগাথা!
শেষাংশে এসে আবারও চমক দেখায় যশোয়ন্ত। সুমিতা বৌদির কোল জুড়ে আসতে চলেছে এক নতুন অতিথি ! সুমিতাদের সমস্যাটা এটাই! এরা ভালোবাসবে যশোয়ন্তের মতো বন্য, আদিমতাকে। কিন্তু ঘোষ বাবুর মতো নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস পায় না। আজীবন এরা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলে।
শেষ পর্যন্ত কলকাতার ছেলেটিকেও হার মানতে হয়।সেটা নাহয় পাঠক নিজেই পড়ে নিবেন।
তবে আমার কাছে এই বইটির সার্থকতা এই যে, এখনও আমার এ বন্ধ ঘর মহুয়ার গন্ধ আর নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধে ছেঁয়ে আছে! চোখ বুঁজলেই আমি “কোয়েল” নদীর স্বচ্ছ জলে ডুব সাঁতার কাটতে পারছি!
Views: 34