তিথিডোর, বুদ্ধদেব বসু – ফারজাহান শাওন
“আর মন খারাপের ভাল লাগাটা বলতে হয়- মানে, বলতে চায় মানুষ, কিন্তু বলতে পারে না। আর পারে না বলেই কি গান বানায়, কবিতা লেখে?”- এই লাইন ক’টি বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস “তিথিডোর” এর মূল চরিত্র স্বাতীর লেখা চিঠি থেকে নেয়া, যে চিঠি সে লিখেছিল সত্যেন বোসের কাছে। তিথিডোর বারবার পড়ার জন্যে আমার এমনি অযুত সব সংলাপ, উদ্ধৃতি আর বর্নণার অজুহাত রয়েছে।
বুদ্ধদেব বসুকে আমার চেনা তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস “জীবনের জলছবি” পডার মধ্য দিয়ে। কবি, ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসুকে ছাপিয়ে ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসুকে চেনার সেই অভিজ্ঞতা ছিল আশ্চর্য রকম। তাঁর কবিতা ভালো লাগে, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে তাঁর গদ্য। কাব্যিক গদ্য লেখায় এক অনায়াস, সাবলীল সুরময়তার সূচনা করেছিলেন তিনি। রাতভোর বৃষ্টি দিয়ে তাঁর গদ্য পডা শুরু আমার, তিথিডোরে গিয়ে আটকে পড়লাম। সে এমনই আটকে যাওয়া যে আজ অবধি প্রিয় বইয়ের নাম জানতে চাইলে এক মুহূর্ত না ভেবে বলতে পারি “তিথিডোর।”
তিথিডোর শব্দের অর্থ হলো “প্রিয় বন্ধন।” এই কাব্যিক উপন্যাসটি প্রিয়তম বন্ধনের মতোই পাঠকে নিমেষে জড়িয়ে নেবে পড়তে শুরু করার প্রথম মুহূর্ত থেকেই। গদ্যেও যে কাব্যিক কোমলতার মায়াজাল তৈরী করা যায়, তার অনুপম উদাহরণ এই বইটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর বিপন্ন সময়ে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসে কোলকাতার নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের পরিবার জীবনের স্নিগ্ধতা, ব্যক্তিজীবনের হাহাকার ও নিঃসঙ্গতার বর্ণনাই কাহিনীর মূল উপজীব্য।
উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।গল্পের শুরু রাজেনবাবু ও শিশিরকণা দম্পতিকে কেন্দ্র করে এবং মূলগল্প বিকশিত হয়েছে তাঁদের পঞ্চকন্যার কনিষ্ঠা স্বাতীকে নিয়েই। স্বাতী এবং প্রফেসর সত্যেনের স্নিগ্ধ প্রেম আখ্যানের অনবদ্য বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসের মাঝ থেকে শেষ অবধি। পুরো উপন্যাসটিকে বলা চলে চল্লিশের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিকতার এক জীবন্ত ছবি। পরম মমতায় সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া বাঙালি জীবনের মাধুর্যময় এক অংশকে চিত্রিত করেছেন বুদ্ধদেব বসু তিথিডোরে।
উপন্যাসটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে লেখক পুরো গল্পটি বলেছেন- ‘প্রথম শাড়ি: প্রথম শ্রাবণ’, ‘করুণ রঙিন পথ’ এবং ‘যবনিকা কম্পমান’।
তিথিডোর আকারে বিশাল, তিনশ পৃষ্ঠার বেশি। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের উপস্থাপনায় লেখকের গভীর মমত্ত্ব টের পাওয়া যায় সহজেই; কোনো রকম আকস্মিক চমক, শ্বাসরুদ্ধকর কোনো উত্তেজনা ছাড়াই অনায়াস এই উপস্থাপন। মনস্তত্ত্ব, অনুভূতি ও চিন্তার ক্ষেত্রের সুনিপুণ, বাহুল্যবর্জিত বর্ণনায় প্রান্জল হয়ে উঠেছে প্রতিটি চরিত্র। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে এক সময় পাঠকের মনে হতে পারে, মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের কর্মময় ব্যস্ত দিন ও ঘুমহীন নিঃসঙ্গ রাত সবটাই হতে পারে অনুভূতিময় আর কাব্যিক।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় তিথিডোর সম্পর্কে বলেছেন, “কলকাতার ছা-পোষা মধ্যবিত্ত জীবনের যা কিছু গৌরব, তার যা কিছু সততা-সমস্তের আশ্চর্য পরিবারকেন্দ্রিক চিত্র ‘তিথিডোর’। এই উপন্যাসকে যে স্নিগ্ধ দিনগুলি আর একটু পরেই বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল, তার শেষ অকৃত্রিম চিহ্ন হিসেবে আমরা মনে রাখব।”
ছোট ছোট বাক্যে সংক্ষিপ্ত অথচ স্বচ্ছ সরস সরল বর্ণনায় লেখা পুরো উপন্যাসটি। উপন্যাসের পাতায় পাতায় ষড়ঋতুর বাংলাদেশ উঠে এসেছে ছোট্ট্ ছোট্ট বাক্যেই। বসন্তের মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস , গ্রীষ্মের প্রখর রোদের তাপ, বর্ষার ভেজা, স্যাঁতস্যাতে মাটির গন্ধ, সুনীল শরত আকাশ কী শীতের মিঠে রোদ- পুরো বাংলাদেশটাই যেন অনুভব করা যায় উপন্যাসের নানান অংশে। এমন সরেস অথচ পরিমিত বর্ণনায় নানান রকম বাঙালি আটপৌরে খাবারের জিভে জল আনা বর্ণনা খুব কম গল্প-উপন্যাসেই পডেছি আমি। বিশেষ করে শ্বেতার আলুসেদ্ধ করার ও আলুর খোসা ছাড়িয়ে লবন মাখিয়ে তা স্বাতীর হাতে দেবার বর্ণনা, কিংবা কাঁকড়ার ঝোল রাঁধার বর্ণনা পড়ে চোখের সামনেই প্রতিবার আমি স্পষ্ট দেখতে পাই সেসব।
উপন্যাসটির সমাপ্তি যদিও আনন্দের, তবুও
যেন পুরো গল্প জুড়ে নিঃসঙ্গতার সুরটি নেপথ্যে বেজে চলেছে। উপন্যাসের সবগুলো চরিত্রই বাস্তব জীবনের চেনা চরিত্রের মতোই মনে হয়েছে; এর কারণ লেখক কাউকেই কেবল ভালো বা কেবল খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করেননি। প্রতিটা চরিত্রের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের প্রায় সমান বর্ণনা দিয়েছেন। এই বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
লেখকের সার্থকতা এখানেই, যখন চরিত্রগুলো আমার মতো পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে ক্রমশঃ কাহিনীর অগ্রগতির সাথে। অন্তঃসারশূন্য মরিয়া বিজন, বোকা শ্বাশ্বতী , চিরন্তন মাতৃমূর্তি শ্বেতা, নিঃসঙ্গ স্বাতী আর সত্যেন, আপাতঃ বুদ্ধিমান হারীত, দিল দরিয়া জামাইবাবু, পাঁচ কণ্যার গর্বিত বাবা স্নেহময়, নীতিবান রাজেনবাবুর গল্প এই তিথিডোর।
সব মিলিয়ে একটি বিশেষ কালকে ধারণ করে ‘তিথিডোর’ এক মহাকাব্যিক এবং অপূর্ব কোমল এক উপন্যাস।যারা পড়েননি এখনো, তাদের বলতে পারি, সময় বিফলে কাটানো হবে না একেবারেই। বারবার ফিরে আসবেন আ্মার মতো তিথিডোরের বন্ধনে, এ বলতে পারি জোর দিয়ে।
Views: 65