তোমাকে ভালবাসি
_______শাহানা মাওলা
{মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কিশোরী জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা অবলম্বনে গল্প}
প্রথম পর্ব
পরীক্ষার পর লম্বা ছুটি।
তখনকার সময়ে এমন লম্বা ছুটিতেও কেউ বেড়াতে যাওয়ার বায়না ধরতো না। প্রায় সবারই আত্মীয় স্বজনের বাড়ী গ্রামে ছিল। অতদূর যাওয়া আসার খরচ কম নয়। ‘মা বাবার অনুমতি মিলতো না।
তাই অবসরে নিশ্চিন্তে সব রকম বই পড়া অনুমোদিত। গল্পের বই,দর্শন, ইতিহাস, কাব্য, ভ্রমণ কাহিনী সব উন্মুক্ত।
আমি বাবার দেয়া গল্পগুচ্ছ হাতে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হলাম।
যদিও গল্প উপন্যাসে মন বসাতে পারছি না আজকাল। আন্দোলন ফুঁসে উঠছে। প্রতিদিন মিছিলে যাওয়ার ডাক আসে। আমি প্রস্তুত থাকি। পাড়ার বড় ভাইরা ডেকে নেয়। সমবয়সী ছেলেমেয়েরা থাকে। মেয়েরা কম হলেও আমার সমস্যা হয় না। আমি শ্লোগান দিতে শিখে গেছি।
‘মা আমার উপর কখনো নিষেধাজ্ঞা জারী করেননি। পারিবারিক আলোচনায় তিনি সবসময় আন্দোলনের পক্ষে কথা বলতেন। আমাদের অনেক কিছু বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চাইতেন কি হতে পারে না পারে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজেও দুর্ভাবনায় পড়ে যেতেন। কখনো ফুঁসে উঠতেন কখনো হতাশ হয়ে পড়তেন। প্রত্যাশা করতেন অনেক বেশী। আমিও আন্দোলিত হতাম।
আমার দূরদর্শী মাতা মনে হয় অনেক দূর দেখতে পেয়েছিলেন।
বাবা সরকারী কর্মচারী। তিনিও আন্দোলনে সহমত পোষণ করতে শুরু করেছেন।
পাড়া প্রতিবেশী সবাই একে একে আন্দোলনের পক্ষে চলে এসেছেন। যারা কোনো দিন রাজনীতি নিয়ে আলাপ করেননি তারাও কথা বলছেন। শহর নগর বন্দর একাকার। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর যেন দেশটা পাল্টে গেছে। মুসলিম লীগের কিছু সমর্থক দু’দিন আগেও আলাপ আলোচনায় সমঝোতার কথা বলতো। ইদানীং আর বলছে না। স্বৈরশাসকের অদমনীয় নীতি এবং কুটিল মনোভাবের কারণে সবাই এখন নিজের দেশের কথা ভাবছে। তাই তো হওয়ার কথা। দেশকে ভালবাসে না এমন কেউ হয় নাকি।
প্রতিবেশী পুত্র পাড়ার শ্রেষ্ঠ ছাত্র রনি ভাই ব্যতিক্রম। কোনো মন্তব্য নেই। সবাই বলে পণ্ডিত ছেলে কথা কম বলে। আমিও তাই ভাবি। গর্জায় না বলে কি বর্ষাবে না? সময় মত হয়তো সবার আগে ঢল নামিয়ে দেবেন। স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। পরিবারের কেউ আন্দোলন মুখী নয়। স্বচ্ছলতা বোধহয় মানুষকে অন্তর্মুখী করে তোলে। কিন্তু নগরের আগুন লাগলে দেবালয় রেহাই পায় না। রনি ভাই তা ভালোই বোঝেন। দু’বন্ধু যখন দেশ নিয়ে কথা বলেন তখন বুঝতে পারি।
আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন বড় ভাইয়ের কাছে। দু’জন দুই মেরুর হলেও বন্ধুত্বে ঘাটতি নেই।
সেদিন সন্ধ্যার আগে রনি ভাই এলেন। হাতে একটা বই। আমি খুব খুশী হলাম। যদিও তিনি বড় ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন। তাতে কি। এমন মেধাবী ছাত্র দেখলে মন খুশী খুশী লাগে। তাছাড়া এমন পড়ুয়া ছাত্র কোথাও যাওয়ার সময় তেমন পান না। বড় ভাইয়ের খোঁজে আমাদের বাসাতেই আসেন। তাই বা কম কি। দুর্লভ সৌভাগ্য!
বিনীত ভাবে বসতে বললাম। বড় ভাই ঘরে নেই তাই মনে হয় একটু ইতস্ততঃ করেও বসলেন।
গভীর দৃষ্টি মেলে দেখলেন আমাকে।
আমি অত গভীরতা বুঝি না। স্কলার ছাত্রের চোখের ভাষা বোঝার দায়ীত্ব আমার নয়।
তবু অবাক হতে হল। হাতের বই খানা এগিয়ে দিয়ে কেমন মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এটা তোমার জন্য।‘
আমি হাত বাড়িয়ে বইটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলাম। শরৎচন্দ্রের দত্তা । পরিচিত নাম। ঘরে অনেক আলাপ আলোচনা শুনেছি। পড়া হয়নি। এবার আমিও পড়বো।
আমার অফুরন্ত সময় কাটানোর পছন্দসই খানিকটা দায়িত্ব উনিও নিয়েছেন ভেবে বেশ লাগলো।
ইতিমধ্যে ‘মা এসে রনি ভাইকে দেখে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করলেন। আমার প্রতি হুকুম হল চা বানিয়ে আনার। আমি চায়ের উদ্দশ্যে রান্না ঘরে চলে গেলাম।
চা বিস্কুট সামনে দিতেই ‘মা ‘চা খাও, বাবা‘ বলে চলে গেলেন নিজের কাজে।
আমি সামনে বসে আপ্যায়নে মনোনিবেশ করলাম।
তখনকার সময়ে ছোট বড় ভাই বা বোনেরা সবাই সবার বাসায় যাওয়া আসা করতো। কোন বিধি নিষেধ ছিল না। বাবা ‘মা খারাপ কিছু ভাবতেন না। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পাঁচ রকম বন্ধু বান্ধবী আসতো। কখনো গল্প কখনো প্রয়োজন আবার কখনো গান বাজনা বা কাব্য সাহিত্য নিয়ে সবাই মুখর হতাম। ঝঞ্ঝার মত উদ্যম/ঝর্ণার মত চঞ্চল। মুক্ত বিহঙ্গ যেন।
কলোনির বাসা। একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া। ছোটখাটো রোমান্স ছাড়া কোনো অশ্লীলতা ছিল না কোনদিন।
দিনগুলো বড় সহজ সুন্দর ছিল।
রনি ভাই চায়ের চুমুক শেষ করে ফেলেছেন। উঠি উঠি করেও একটু দেরী করলেন।
হঠাৎ আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘এই অবসরে একটু ঘুরতে তো পারো।‘
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কোথায় ঘুরবো?
‘কেন বান্ধবীদের বাসায় যাও না?’
‘যাই তো। বেশ ঘোরা হয়।‘
‘আমার সাথে যাবে?’
কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছি না। ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। বেশ বুঝতে পারলাম আমার প্রথম বসন্তের নব কিশলয়ে ঝড় উঠেছে। তরতাজা নতুন পাতাগুলো ঝরে যাবে নাকি!
স্বর প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কি বলবো না বলবো খুঁজে না পেয়ে সরাসরি ‘মায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দিলাম। বললাম, ‘মা দেবে না।‘
‘মা জানবেন কি করে?বলবে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছ।‘
বাহ! শ্রেষ্ঠ ছাত্র এসবও জানে? কি চমৎকার শিখিয়ে দিচ্ছেন! আমি তো জানতাম ভাল ছাত্ররা প্রেম করে না। রোমান্টিক হাসতেও জানে না।
সব জানাজানি ভুল হয়ে যাচ্ছে কেন?
নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয় পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে। শরৎ বাবুর দত্তা বুকে চেপে ধরেছি শক্ত করে।
ধরনী কি দ্বিধা হবে! সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে এত ভয় লাগছে কেন!
উনি আবার কিছু বলতে উদ্যত হওয়ার আগেই ‘মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন । হাসি মুখে কি সব বলাবলি করলেন। আমার কানে কিছুই গেল না। ততোক্ষণে পাশের রুমে গিয়ে শ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি।
রনি ভাইয়ের কণ্ঠ কানে এলো, ‘আজ তাহলে যাই, খালাম্মা।‘
উফ! বাঁচা গেল।
আমার রেজাল্ট নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ‘মা মিষ্টি বিতরণ করলেন প্রতিবেশীদের বাসায়। কত লোক আমাকে দেখতে এলেন।
সে সময়ে খুব কম মেয়েই এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পাশ করতো। তাই আমার দামই অন্যরকম।
রনি ভাই বড়ভাইয়ের সাথে বোর্ড অফিসে গিয়েছিলেন। এসে অবধি আমাদের বাসাতেই আছেন। তখনকার সময়ে পরের দিন ক্রমিক অনুযায়ী পত্রিকায় রেজাল্ট প্রকাশিত হত। পরের দিন পর্যন্ত দেরী করার ধৈর্য্য কারো থাকতো না। ঘোষনা আসার পরপর সবাই বোর্ড অফিসে গিয়ে জেনে আসতো। রনি ভাই খুব খুশী হয়ে আমার ভবিষ্যৎ কলেজ এবং বিষয় সমূহ সম্পর্কে জ্ঞান দান করলেন। হেসে বললেন, ‘তুমি তো আমাকেও ডিঙিয়ে যাচ্ছ!’
আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো। বড় ভাই অট্ট হেসে বললেন, ‘আরে তুই তো স্ট্যান্ড করা ছাত্র! কাকে কি বলিস!’
‘ও-ই বা কম কিসে? সবাইকে স্ট্যান্ড করতে হয় নাকি?’
দুই বন্ধুর আলাপে আর না থেকে আমি আরেক প্রস্থ চায়ের সন্ধানে গেলাম।
ভাল রেজাল্ট করায় নিজের উপর আস্থা অনেক বেড়ে গেছে।
রনি ভাই এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ইশারা ইঙ্গিত করেছেন। হৃৎকম্প বেড়ে চলেছে। মনে মনে নিজেক তৈরী করার চেষ্টা করছি। ‘মা কি আপত্তি করবেন? পড়াশোনা শেষ না করে তো আর বিয়ে হবে না। রনি ভাই কি ততদিন প্রতীক্ষা করবেন? নাকি বিয়ে শাদী করে উনিই পড়ার দায়িত্ব নেবেন?
মনে হয় না ‘মা রাজী হবেন। তিনি আঙুল নাচিয়ে বলে দিয়েছেন পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত বিয়ে হবে না!
আমি আর কতই বা ভাবতে পারি। জীবনের প্রথম ফাল্গুন খরস্রোতা নদীর মত আমাকে কোথায় টেনে নিতে চায় কে জানে!
ইতিমধ্যে রনি ভাই আবারও ফার্স্ট হয়ে উচ্চ চাহিদা সম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছেন। এমন সৌভাগ্য কোনো বাবা ‘মা পায়ে ঠেলে ফেলে কি?
দত্তা পড়ে ঐ বয়সে কতটুকু বুঝলাম না বুঝলাম নির্ধারন করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু কোনো আবৃত প্রেম আমাকে ক্ষণে ক্ষণে অনাবৃত করে ফেলতে উদ্যত, সে বেশ বুঝতে পারছি।
সবই মিলে যাচ্ছে কেন? নাকি আমিই মিলিয়ে নিচ্ছি?
বিকালে আরো একটি বই নিয়ে এলেন। দেশে বিদেশে, সৈয়দ মুজতবা আলী। বুঝতে পারছি বই ছাড়া আর কোনো উপলক্ষ্য নেই। মজা পেলাম! বেশ শাস্তি হচ্ছে বটে।
অবশ্য আমিও আজকাল বিকাল বা সন্ধ্যায় কারো আসার আশায় থাকি। তবে কেন শুধু তাঁকেই দোষ দেবো!
নতমুখে বইটি নিতে গিয়ে হাত কেঁপে গেল। বইটি কি পড়ে যাচ্ছিল? মনে হয় না। হঠাৎ ঘোর লাগলো কেন কে জানে!
রনি ভাই পড়ে যাওয়া বইটি সহ আমার হাত চেপে ধরলেন। উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? শরীর ভাল তো?’
আমি কোনো রকম উচ্চারণ করলাম, ‘না না। ভাল আছি।‘
চোখাচোখি হয়ে গেল। রোমান্টিক হাসির ঝিলিক ঝরানো দু’টি চোখ। কি লজ্জা! আমি কি ধরা পড়ে গেছি?
তপ্ত মধুর স্পর্শ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম।
কি ক্ষতি ছিল আরো কিছুক্ষণ স্পর্শ জড়িয়ে রাখলে!
দুই রুমের খোলামেলা বাসা। এখুনি ‘মা এসে তাঁর দিগ্বিজয়ী প্রতিবেশী পুত্রের জন্য চা অর্ডার করবেন। ধেৎ!
বাবা প্রায়ই বলেন, ‘রনি ছেলেটা জিনিয়াস। শুধু রেজাল্ট নয় রুচিসম্মত চিন্তা চেতনা। কোনো অকেজো বই পড়ে না। বাংলা কাব্য সাহিত্য সংস্কৃতিতে ‘ওর দখল যথেষ্ট।‘
আমি পিট পিট করে চেয়ে বলি ‘অনেক জানে, না?’
‘নিশ্চয়ই। তোকে কত ভাল ভাল বই দিয়েছে পড়তে। নিজেও পড়ে।‘
‘এই জন্যই চোখ দুটো গেছে।‘
বাবা অবাক হতে গিয়ে তেড়ে উঠলেন।
‘বাঁদরামি হচ্ছে? পাড়ার বদ ছেলেরা বলে তাই তুইও বলবি?’
আমি ততোক্ষণে নেই!
রনি ভাইয়ের বাবা অভিজাত এলাকায় বাড়ী নির্মানে ব্যস্ত। সে নাকি মস্ত বাড়ী। নির্মান প্রায় শেষের পথে। বাবা বলেন, ‘ভদ্রলোক ধনী মানুষ। কাস্টমসে চাকরী করেন। মস্ত বাড়ী বানানো তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়।‘
আমার মন খারাপ হয়ে যায়। রনি ভাই যদি আর না আসেন? কি করে দেখা হবে?
বাবা কেন পাশেই একটা বাড়ী বানান না? কেন অমন চাকরী করেন না?
আমি কাস্টমস বুঝিনা। প্রথম বসন্তের বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ কেবল রনি ভাইকে বোঝে।
একহারা লম্বা গড়ন। ঘন কালো চুলগুলো হঠাৎ অবিন্যস্ত হয়ে যায়। কপালে মুখে কেমন খেলা করে! মোটা লেন্সের আড়ালে গভীর বুদ্ধিদীপ্ত দু’টি চোখ। প্রশস্ত বুকে নিবীড় আশ্রয়ের হাতছানি।
রনি ভাইকে না দেখে থাকতে পারবো না। সে আমার পঙ্খীরাজে উড়ে আসা রাজপুত্তর। আমি তার সাথে উড়ে যাবো।
জিনিয়াস ছেলের দেয়া বইয়ের পাতা উল্টে দেখার আগেই একটা টুকরো কাগজের কোনা দেখতে পেলাম। টেনে বের করে মূহুর্তে পড়ে ফেললাম। ‘ দশটায় রমনা পার্কের গেটে এসো। আমি অপেক্ষা করবো।‘
বসন্ত জাগ্রত দ্বারে!
এই কি সেই আমন্ত্রন? যার প্রতীক্ষায় ক্ষণে ক্ষণে চমকিত আমি? কে বলে দেবে! দে পড়ে দে আমায় তোরা কি কথা আজ লিখেছে সে!
কি পরবো! কেমন সাজবো! আমার মেঘ কালো চুলে কলা বেণী কেমন মানাবে? টিপ পরবো কি? দারুণ লাগবে। চোখের কাজল ঈশান কোণের ঝটিকার মত কালো দেখাবে তো?
‘মাকে কি বলবো?
Views: 13