নীলা তার ৪৫ দিনের বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, অঝোরে নীলার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে,তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্টতম মা বলে মনে হচ্ছে। নীলার কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে বমি পায়। নীলা আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক কতটা সময় খেয়াল নাই তবে রুমে ফিরে দেখে অয়ন আর অরীন দুজনেই গভীর ঘুমে। নীলা মেয়েটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শুষ্ক চোখে তাকিয়ে থাকে সিলিং এর দিকে, অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনা ঠিক কতদিন হল দুটো ঘন্টা একটানা চোখের পাতা এক করেনা। দমবন্ধ হবার মত এই নির্মম পৃথিবীতে তার এক একটা মুহূর্ত যেন কারাগারের মত মনে হয়। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে যাওয়া নীলার এখন রাত যত বাড়ে অয়নের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে এই পৃথিবীর প্রতি তার বিতৃষ্ণাও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে…….
আজ বাড়ীর আবহাওয়া পূর্বের চাইতেও বিরূপ। নীলার বাবা মাকে ভিডিও কলে রেখে সালিশের পরিকল্পনা চলছে। উনারা মেয়ে বিয়ে দিয়ে তো বিদেশে গিয়ে দিব্বি ছেলের সংসারে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন আর এদিকে যত জ্বালা এসব এ বাড়ির লোকেদের হয়েছে।
নীলা অন্যান্য দিনের মত স্বাভাবিকভাবেই অরীনের দেখা শোনা করছে। অরীনের শরীরটা একটু গরম থেকে থেকেই কান্না করছে নীলা বার বার কপালে হাত দিকে দেখে নিচ্ছে মেয়েটার জ্বর এল না তো আবার? নীলা ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্নতা অনুভব করছে। অয়ন সরু চোখে নীলাকে দু একবার দেখে নিয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি রেখে বলল, “এমন ভাব করছ যেন মেয়ে ছাড়া তুমি পৃথীবির কিচ্ছুটি বুঝনা।”
কথাটা নীলার কানে ভীষণ ভাবে লাগল, দু সেকেন্ড ভেবে অরীনকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অয়নের দিকে এগিয়ে এসে বলল,” কি বলতে চাও তুমি? মেয়েকে আমি ভালবাসিনা? তাহলে কে বাসে বল তুমি? তোমরা? মেয়ের জন্য কে রাত জাগে তুমি, মেয়েকে খাওয়ানো,ঘুম পাড়ানো, দিনে ১৫-২০ বার পি করলে কাঁথা কে বদলায় বল তুমি? মেয়েটাকে নয়টা মাস পেটে ধরেছিল কে তুমি?……”
অয়ন এক ধাক্কা দিয়ে নীলাকে সরিয়ে দেয়,নীলা টেবিলে গিয়ে ভুট হয়ে পড়তে গিয়ে দু হাত দিয়ে কোন রকমে সামলে নিয়ে আবার ধেয়ে আসে অয়নের দিকে। অয়ন নীলার মুখ টিপে বলে, ” কাল না বলছিলে যে এই সন্তানের জন্য তোমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তোমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে তাহলে আজ আবার নাটক করছ কেন? লজ্জা করছে না?”
নীলা হু হু করে বাচ্চাদের মত কেঁদে ওঠে, অয়ন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে “এই আবার শুরু হল” বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বেলা গড়িয়ে এগারোটা পয়তাল্লিশ। নীলা প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে ডায়নিং এ। সকাল থেকে মেয়েটার জ্বর ঘ্যান ঘ্যান করছে কোল থেকে নামালেই কান্না, প্রথম টিকা পেয়েছে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। চাইলেও আজকাল আর ঘরের টুকটাক কাজ বৈ খুব একটা কিছু করার সময় হয়ে ওঠেনা। প্লেটে ভাত বেড়ে ভাজির বাটিটা আলগা করতেই না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে গেল নীলার কোন রকমে পানি দিয়ে দু চার গাল গিলে নিল। করলা ভাজিটা কেন জানি সে খেতেই পারেনা চাইলেও। এ বাড়িতে সবাই সেটা জানা সত্ত্বেও এটাই যেন ঘুরে ফিরে চলে বেশী। নীলা খেতে পারেনা এটা একান্তই তার সমস্যা কিন্তু বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই ক্ষুধাটা যেন না চাইতেই বেড়ে গিয়েছে ভেবেছিল ডেলিভারির পর কমে যাবে কিন্তু কই উল্টা বাবু ব্রেস্ট ফিডিং করাতে ক্ষুধা যেন রাক্ষুসে রূপ ধারন করেছে। ফ্রিজটা খুলে দেখল একটা ডিম আছে, সাহস হলনা সেটা হাত বাড়িয়ে তুলে ভেজে নেওয়ার। সেই কবে যেন একমাত্র ডিমটা সেদ্ধ করে খাওয়ায় খাবার টেবিলে শুনতে হয়েছিল অহনা ডিম ছাড়া সকালে ভাত খায়না জানা সত্ত্বেও নীলা কিভাবে অবিবেচক এর মত ডিমটা খেয়ে নিল। ‘অহনা’ নীলার ননদ। সেদিন ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে অহনা বলেছিল,”মা এমন ভাবে বলছ কেন,আজ না হয় ডিম ছাড়াই খাব।”
উত্তরে শুনতে হয়েছিল,”একেই বলে যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর, ফের কোন দিন বলে দেখিস যে তুই ডিম ছাড়া সকালে খেতে পারিসনা।”
সেই থেকে নীলার সাহস হয়না নিজ হাতে মন চাইলেই কিছু একটা মুখে দেয় পাছে কার ভাগে কি কম পড়ে!
অয়ন সবসময় বলে এসেছে সবার সাথে মানিয়ে চল,আমি জানি তুমি পারবে। অয়নের বিশ্বাস ভাঙ্গতে চায়নি তো নীলা। খুব করে চেয়েছে অয়নের মানটা বজায় থাকুক। তার জন্য যেন অয়নকে কখনো ছোট হতে না হয়। কিন্তুু তা আর নীলা পারল কই? মেয়েটাকে কোলে নিয়ে যেদিন এক আকাশ আনন্দ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পা রাখল সেদিন থেকেই যেন সব কিছু বদলে গেল। বাচ্চা অসময়ে ঘুমালো কেন? রাতে কাঁদল কেন? হাত মুষ্টি করেই বা রাখে কেন? পি করল এখনই খাওয়াও না কেন? কাঁদছে কোলে নাওনা কেন? সারাদিন কোলে কেন?……….. এতসব কেন’র ভিড়ে নীলা যেন হারিয়ে যায়। খেতে বসে বাচ্চাটা কাঁদলেই সবাই যেন শোরগোল শুরু করে দেয় আধপেট খেয়েই দৌড়ে আসে মনে হয় কেন যে খেতে বসল। গোসলে গেলেই মনে হয় হায় হায় এখনতো মেয়েটার খাবার সময় এখনই মাত্র খাইয়ে আমাকে গোসলে ঢুকতে হল! সারাটা দিন নীলা মেয়েকে থামাও,নীলা বাথরুম থেকে বের হও,নীলা খাওয়া শেষ হল? নীলা বাবুর কান্না থামাও সকালে অফিস ঘুমাতে পারছিনা.…….আহা কি ভেবে ছিল কি হল। খুব করে স্বপ্ন বুনেছিল মেয়েটাকে বেবী পিংক কাপড় পরিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে পরীর মত সাজিয়ে রাখবে, মা মেয়ে একই কাপড়ের জামা পরবে, অয়ন বাড়িতে ফিরে মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করে বলবে, “দেখ মা এ যেন একটা ছোট্ট নীলা”, মেয়েটা সবার কোলে কোলে থাকবে নীলা বলবে তোমাদের জন্য তো আমিই ওকে কোলে নেওয়ার সুযোগ পাইনা। কিন্তু কই? এ বাসার সবার যেন ভীষণ ব্যস্ততা, শুধু নীলারই যেন কিছু করার নাই সারাটা দিন তো ঐ না একটু বাচ্চা টাকে দেখে রাখে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত নীলা যখন ভাবে এই কেউ মাথায় হাত রেখে বলবে অনেক তো হল মেয়ে মেয়ে করে নিজের অযত্ন করলে চলবে,ও থাকুকনা আমাদের কাছে তুমি যাও গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও তখন নীলাকে শুনতে হয় কই মেয়েটা ঘুমালো আর তুমিও কাৎ হলে কাঁথা কাপড় গুলা এই সুযোগে গুছিয়ে নাও, পাক ঘরের কাজে না হয় হাত না লাগিয়েও দিব্বি কিভাবে চলে যাচ্ছে টের পাচ্ছনা তা বলে কি ঘরের কাজটা গুছিয়ে রাখবেনা। এই তো সুযোগ বাবুটা ঘুমাচ্ছেতো যাও গিয়ে আমার কাপড় গুলা আয়রন দাও সারাদিন তো মেয়েকে নিয়ে আহ্লাদ করো আমার কোন খোঁজ রাখ? অফিসে যাওয়ার সময় একটা জিনিস ও সময় মত হাতের কাছে পাইনা।
নীলা ভেতরে ভেতরে হারিয়ে যেতে থাকে যেন। কি করছে, কার জন্য করছে, কেন করছে, কি করা উচিৎ কোন দিশা পায়না যেন সে।
বিকালে অহনা এসে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেয়। নীলা চমকে উঠে বলে,” কিরে দরজা দিলি কোন? মা বকবে?”
অহনা সবগুলা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে চাদরের নিচ থেকে বাটি বের করে।
নীলা অবাক হয়ে যায় বলে,”কই পেলি?”
অহনা বলে,”ব্যাচ থেকে ফেরার পথে বান্ধবীদের সাথে ফুসকা খেতে গেলাম তখন মনে পড়ল তুমিওতো কত পছন্দ কর, সেই অরীন পেটে আসার পর থেকেতো আর খেতে পারনা। তাই ভাবলাম আজ নিয়ে যাই। মা দেখলে বলবে ওসব খাওয়াসনা বাবুর পেট খারাপ করবে, ঠান্ডা খাওসয়ানা বাবুর ঠান্ডা লাগবে……
বাবু পেটে থাকতে বলত ওরে ডাবের পানিটা তুই খা ও খেলে বাবুর চোখ ঘোলা হবে!
এসব এখন কেউ মানে বল, খামখা তুমি বেচারী সব কিছু থেকে বঞ্চিত হও।
আমিতো খুব একটা তোমার কাছে আসার সুযোগ পাইনা এলেই বলবে কিরে অহনা পাড়া রেখে উঠলি যে….। দাও অরীনকে আমি কোলে নেই তুমি জলদি খেয়ে নাও ফুসকা গুলা এমনিতেই কেমন চুপসে গিয়েছে বল সেই কখন বানিয়েছে না।”
নীলা ঝাপসা চোখে মাথা নিচু করে ফুসকা খায়, অরীন পেটে আসার পর থেকে তা ওপর হাজারটা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে যেন মায়েদের জন্য আলাদা করে খাবার হারাম করা হয়েছে। তবে অয়ন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিবার চেক আপ এর সময় ঠিকই নীলার টুকটাক দাবী দাওয়া মিটিয়ে দিত। সেই যেবার সে খুব বায়না করল আইসক্রিম খাওয়ার অয়ন চোখ বড় করে চেয়েছিল, নীলা ভয় পেয়ে বলেছিল,” থাক লাগবেনা”। অয়ন বলেছিল,”একটা কাশি দিলেনা আর বাঁচিয়ে রাখবনা, এই মামা দুইটা আইসক্রিম দাওতো।”
নীলা সে রাতে সারারাত ওড়নায় মুখ চেপে কাশি দিয়েছিল কই অয়নতো ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেেছিল। তবে আজকাল মনে হয় হয়তবা বাচ্চা পেটে ছিল বলেই খুব একটা কিছু বলত না। যেই না অরীন একটা আলাদা অংশ হল সেই যেন নীলা আসামী হয়ে গেল। প্রতিটা মুহূর্তে অযোগ্য মা প্রমানিত হতে শুরু করল। সবাই বাচ্চাটার জন্য যেন পারলে নীলার প্রাণ নেয়। নীলা সর্বদা কি এক আতঙ্ক বয়ে বেড়ায় নিজের মাঝে মনে হয় বাচ্চাটা একটা বড় ঢেকুর তুললেও সবাই দৌড়ে এসে বলবে কতবার করে বলেছি নীলা একটু বেছে খুটে খাও। কেমন শব্দ করে ঢেকুরটা তুলল বলত, এখন যদি পেটে ব্যাথা হয়? কেমন মা তুমি বুঝে চলতে পারনা?”
নীলার কোন কোন মুহূর্তে মনে হয় এই বাচ্চাটার জন্যই কি সবাই তাকে বিচার করছে,এই বাচ্চাটার জন্যই কি নীলা মন দিয়ে সংসার করে পারছেনা,এই বাচ্চাটার জন্যই কি নীলা আর অয়নের মাঝে প্রতিনিয়ত দূরত্ব বেড়ে চলছে…..
মাঝে মাঝে অরীন কাঁদলেও নীলা বেলকনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে,মনে কাঁদুকনা কেউ এসে একটু ওকে কোলে নিক। সবসময় শুধু নীলাই কেন,অরীনতো আর তার একার নয়।
কি জানি হয়তবা এমন অনেক কারনেই নীলার প্রতি অয়নের বিরক্তি বাড়তে থাকে। ফেসবুকে পরিচিত অনেকের বাচ্চা সহ হাসি খুশী পরিপাটি ছবি দেখে অয়নের মনে হতে থাকে শুধু নীলাই ব্যর্থ মা। না হলে বলবে কেন,”পৃথিবীতে তো তুমি একাই মা হওনি তাইনা?”
আজকাল অয়নের তীর্যক কথা, তাচ্ছিল্যের সুর নীলাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে মন চায় অয়নকে গিয়ে বলে অয়ন আমি না হয় ব্যর্থতাকে মেনে নিলাম। তুমি একটু স্বার্থক বাবা হয়ে দেখাও না। বাচ্চাটা রাতে কাঁদলে বিরক্ত হয়ে বালিশে কান চাপা না দিয়ে বলতে পারনা, “মামনী এসো বাবার কোলে এসো, মা ঘুমাক ওতো সারাদিন তোমাকে কাছে পায় তুমি নাহয় একটু সময় আমার কোলেই রইলে।” অফিস থেকে ফিরে মেয়ের পাশে শুয়ে বলতে পারনা,” আমি বাবুর সাথে খেলা করছি যাওতো চুলটা আচড়ে জলদি দু’কাপ চা নিয়ে এস কতদিন একসাথে দুজন চা খেতে খেতে গল্প করিনা।” বলতে পারনা, “সারাটা দিন মেয়েটাকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে যাও রাতে নায় খাওয়ানোর সময় তুমি উঠো, কাঁথাটা না হয় আমিই বদলে দিব।”
কিন্তু নীলার তা আর অয়নকে বলা হয় কই। না বলতেও কত অশান্তি।
গতকাল যখন নীলার বন্ধুরা ফোন করে জানাল যে নীলার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিয়েছে নীলা বিষয়টা রাতে খাবার টেবিলে সবাইকে জানলা। সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি করল। নীলার শ্বশুর ডালটা পাতে তুলতে তুলতে বললেন,” এবার না হয় থাক পরে দিও।” নীলা অয়নের মুখের দিকে তাকাল। অয়ন নিশ্চুপ।
নীলা বলল,”না বাবা আমার প্রস্তুতি ভাল আমি এবার পরীক্ষাটা দিতে চাই।”
নীলার শ্বাশুড়ি বেশ ঝাঁঝাল গলায় বললেন,”তুমি পরীক্ষা দিয়ে বেড়াবে আর তোমার বাচ্চাটা কে দেখবে শুনি?”
নীলার মাথায় রক্ত চড়ে যায় যেন। খাবার প্লেটটা পাশে ঠেলে রেখে বলে ওঠে,” কেন বাচ্চাটা কি আমার একার,আমি একাই এনেছি তাকে দুনিয়াতে? সমস্ত স্যাক্রিফাইস শুধু আমাকেই করতে হবে? কেন আমি মা তাই? মা হওয়াটাকি আমার অপরাধ? আমিতো বিয়ের আগেই বলেছিলাম যে আমি পড়াশোনা শেষ করে বাচ্চা নিতে চাই। আয়ুতো আমার ফুরিয়ে আসছিলনা, আপনারাইতো চেয়েছিলেন নতুন মুখ দেখতে। তা এখন মুখ দেখেছেন সবার শখ মিটে গিয়েছে?…….”
অয়ন খাবার টেবিলে সবার সামনে চিৎকার করে বলে ওঠে, “বেয়াদবির একটা সীমা আছে নীলা, আর একটা কথা বললে……..”
নীলা আরো ফুঁসে ওঠে,”বললে কি করবে বল মারবে? তিল তিল করে তো মেরেই চলেছ? কেন এই বাচ্চাটার জন্যইতো? এই বাচ্চাটাই আমার জীবনটা মনে হয় শেষ করে দিল……”
কথা শেষ না করেই নীলা দৌড়ে এসে ঘরে দরজাটা দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে আর দরজার ওপাশে চলতে থাকে নীলাকে নিয়ে শালিশ বিচার। নীলা যেন আর কোন কিছুর তোয়াক্কা করেনা। তার ছটফট করতে থাকা আত্মাটা যেন আর নিতে পারেনা। ভালবাসার অভাব মেনে নেওয়া যায় তা বলে প্রতিনিয়ত অন্যায় অবিচার মেনে নিয়ে নিজের সাথে বেঈমানী সহ্য করা যাচ্ছেনা যেন আর।
অয়নের সাথে সেই মুহূর্ত থেকেই যেন নীলার আজন্ম শত্রুতা।
অয়ন রাতে বাড়িতে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরায়। অরীন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। যাকে নিয়ে এত তুলকালাম সে যেন সব কিছুর উর্ধ্বে। এই পৃথিবীর কোন কলুষতা যেন তাকে স্পর্শ করে না। সে যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অস্পৃশ্য অপ্সরী।
অয়ন আধো আলোয় নীলাকে বেলকুনীতে আবিষ্কার করে। নীলা বেলকনির এক কোনে হাঁটু গেড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অয়নের উপস্থিতি সম্পর্কে সে অজ্ঞ। অয়নের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। বিয়ের রাতে নীলা ঠিক এভাবেই বিছনায় বসে কাঁদছিল। অয়ন নীলাকে ভুলিয়ে রাখতে কতশত প্রতিজ্ঞা করেছিল সে রাতে। হতে চেয়েছিল নীলার সবচাইতে আপনজন, নীলার একমাত্র ভরসা স্থল, নীলার পূর্ণ না হওয়া সকল স্বপ্নের কারিগর। আহ অয়ন! জীবন কত বিচিত্র। সেই নীলা এখন তোমার চক্ষুশূল। যেই নীলার মুখটা দেখার জন্য পুরোটা অফিস আওয়ার অয়ন অস্থির হয়ে থাকত সেই নীলা এখন সমস্ত অশান্তির কারন, যেই নীলা তার বাবা হওয়ার স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে সেই নীলার খুঁটি নাটি দোষ ধরায় অয়ন এখন সর্বদা ব্যস্ত। যেই নীলার স্পর্শ ছাড়া রাতে ঘুম হতনা ছুঁয়ে দেখার অনিচ্ছাটা আজকাল কি প্রচন্ড।
অয়ন সিগারেট টা নিভিয়ে ফেলে পাছে ধোঁয়ায় নীলার কাশি শুরু হয় এজমার সমস্যা আছে যে। অয়ন ধীর পায়ে নীলার পাশে গিয়ে বসে। আলতো করে নীলার পিঠে হাত রাখে নীলা হঠাৎ শক্ত হয়ে যায় যেন। শীতল বরফের মত শান্ত চোখে ঘুরে তাকায়। অয়ন আস্তে করে জানতে চায়,”রাতে খেয়েছ?”
নীলা শুষ্ক ঠোটে হাসে। কি যেন মনে করতে চেষ্টা করে, আদৌ কি সে রাতে খেয়েছে? নাকি শেষ কে কবে তার খোঁজ নিয়েছে তার, সে উত্তর যেন নীলার নিজেরও বোধয় অজানা।
নীলার বিভ্রান্ত চাহনী দেখে অয়ন ভীত হয়। প্রতিনিয়ত নীলাকে ভয় দেখিয়ে আসা অয়ন নীলাকে যেন ভয় পেতে থাকে। অয়ন আবিস্কার করে যে অয়ন নীলাকে ভালবাসত সেই অয়ন নীলাকে ভয় পেত। এই বুঝি নীলা কষ্ট পেল সেই ভয়, এই বুঝি নীলার অমর্যাদা হত সেই ভয়, এই বুঝি নীলা তাকে ভুল বুঝল সেই ভয়…… সেই ভয় গুলোই যেন সুন্দর ছিল এই ভয় দেখানো দিন গুলার চাইতে।
নীলা অপ্র্যাশিত ভাবে অভ্যস্ত হাতে অয়নের মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিষ্প্রাণ স্বরে বলে, “কতকাল শেভ করনা বলত? চুল গুলোও বড় হল যে। শুধু বাবা হলে হবে নিজের যত্ন নিতে হবেনা? আমি চলে গেলে অরীনকে দেখে রাখবে কে যদিনা তুমিই ঠিক থাক?”
অয়ন নীলাকে জড়িয়ে ধরে। অয়নের চোখের জলে নীলার চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। অয়ন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,” আমি বাবা হয়ে উঠব নীলা, তোমার অয়ন তোমার দেখা সেই সভ্য স্বামীর মত সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠবে শুধু তুমি আমাকে ক্ষমা করে পাশে থেক আমাকে আমার মত করে একলা করে দিওনা, কখনো না।”
Views: 17