অপরাজিতা
-নাহিদ ফারজানা সোমা
আমি দোলন। ঐ যে “হাসনা হেনা টেইলার্স” দেখতে পাচ্ছেন না,ওটা আমারই। মায়ের নামে করা। তিনি অবশ্য দেখে যেতে পারেননি। ক্যান্সার উনাকে কয়েক বছর আগে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। আর “নয়ন শিশু আলয়” নামের যে ছোট্ট এতিমখানা, ওটা
আমি বাবার নামে করেছি।
আমার বড় দুই বোন আছেন। আমি উনাদের কাছে যেতে চাই, কিন্তু উনারা চান না। তাই বিরক্ত করিনা।
উনাদের জন্য ভালবাসা,শুভকামনা আমার মনের মধ্যেই থাক।
আর কে আছে আমার? একজন ছোট ভাই। তবে সে আছে বলা যায়না,ছিল। বাস চাপা পড়ে মরে যায়।
আমার বাবা দাদা-দাদীর আর মা নানা-নানুর একমাত্র সন্তান ছিলেন। সুতরাং, আমার মামা-চাচা-খালা-ফুপু কেউ নেই।
আমার জন্য দয়া করে কেউ আহা-উহু করবেন না।
করুণা আমার সহ্য হয় না। আমি খুব একলা ঠিকই, নিয়তির খেলায়, প্রিয় মানুষগুলোর জন্য বুকে পাহাড় সমান
কান্না জমে আছে,তাও ঠিক, কিন্তু আমি তো থেমে নেই। তাহলে করুণা কেন?”আহারে, কপাল পোড়া মেয়েটা, দেখলে বুক ফেটে যায়, ” -এসব হাস্যকর কথাই বা কেন? আমাকে দেখলে আপনাদের যদি কষ্টে মরে যাওয়ার যোগাড় হয়, তাহলে খুব খারাপ সময়গুলোতে কাছে থাকেননি কেন?
সবার আগে গেলেন মা। ক্যান্সার হয়েছিল। কি কস্ট!
মায়েরও, আমাদেরও। মায়ের যন্ত্রণা দেখে আমরা চার ভাই-বোন হাউমাউ করে কাঁদতাম। মায়ের অসুখ ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত আমরা খুবই সুখী পরিবার ছিলাম কিন্তু। বাবা-মা-চার ভাইবোনের ভরা সংসার। মায়ের ক্যান্সারের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির খেলা শুরু হয়ে যায়।
যা বলছিলাম, মায়ের কস্ট দেখে আমাদের বুক ভেঙে যেত। শেষে এমনটাও ভাবতাম, মা তাড়াতাড়ি চলে যাক তবে। মানুষ মিরাকলের আশা করে, আমাদের সেই আশা করার উপায় ছিলো না।
মা চলে গেল। চারিদিক কি ভীষণ শূন্য। সময় নাকি সব কস্ট এক সময় ফিকে করে দেয়, আমার বেলায় সেটা হয়নি। কিন্তু আমি হা-হুতাশ করে সময় কাটাই নি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে লেখাপড়া, কাজকর্ম সবই চালাতাম।
বড় আপা এম.এ পাশ করার পরে ওর বিয়ে হয়ে গেল।
আপার পছন্দেই। ছেলে সুদর্শন, উচ্চশিক্ষিত, অতি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। বাবার আপত্তির কি আছে?
আপা তার নিজের সংসারে চলে গেল। আমাদের পরিবার ছোট হওয়া শুরু করল।
দোদুল, আমাদের পিচ্চি ভাই, আমরা বাবু বলেই ডাকতাম, একদিন স্কুলে যেয়ে আর জীবিত ফেরত এলনা। বন্ধু আর তার মায়ের সাথে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিল, বাস এসে পিষে দিল। কেবলমাত্র বন্ধুটির মা বেঁচে গেলেন, যদি অবশ্য এটাকে আপনারা বেঁচে থাকা বলেন।
মরে যেতে চেয়েছিলাম। বাবু, আমার বাবুই। মা আর বাবুর কাছে চলে যেতে চেয়েছিলাম। পারিনি। ভয়ে না,
এক ধরনের জেতার নেশায়। আমি হারবো না,কিছুতেই না। একদিন হয়তো অন্য জগতে আবার আমরা একসাথে থাকব, হয়তো নয়। জীবন থেকে স্বেচ্ছায়
পালিয়ে যাওয়ায় কোন গৌরব আছে কি?
বড় আপার বাবু হলো। আপার যত্ন -আত্তির জন্য আমি গেলাম। মেজ আপা বাবার সাথে বাসায় থাকল।
এক রাতে অন্ধকার ঘরে কুটুম-কাটুমকে ঘুম পাড়াচ্ছি,
কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে, বড় দুলাভাই এলেন। লাইট জ্বালাতে যেয়ে বাধা পেলাম। কিছু চরম অশ্লীল কথা,কিছু
অশ্লীল ভাবসাব। লোকটা তখনও ভাল করে চিনেনি আমাকে, কষে দিলাম এক চড়।
লোকটাকে বের করে দিয়ে আমি খুব কেঁদেছিলাম।
নীরবে। মা আর বাবুর কথা খুব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া সুখের সময়গুলোর কথা। আপার জন্য দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আপা কি জানে,লোকটা একটা নরপশু?
দুইদিন পরে আবার সুযোগ বুঝে আক্রমণ। সেদিন আমি চিৎকার করে পাড়া মাথায় করলাম। আপা খুব রেগে গেল, তার স্বামীর উপরে না, আমার উপরে। দোষ নাকি আমারই। আমিতো জানি, আপা সব বুঝে। কিন্তু এই সুখ -স্বাচ্ছন্দ ছেড়ে, বিজনেস ম্যাগনেটের বউ এর তকমা ছেড়ে যাওয়ার বান্দা সে নয়।তার রুচি, মানসিকতা আগের মতো নেই। বড় আপার বাড়ির দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য খোলা থাকলেও আমি যেতাম না,কখনো না।
বছর দুয়েক পরে বাবা চলে গেলেন। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই। ডাক্তাররা বললেন হেমোরেজিক স্ট্রোক।
মারা যাওয়ার আগের দিন বাবা চিতল মাছের কোপ্তা খেতে চেয়েছিলেন। আলসেমি করে বানাইনি। এই কস্ট আমি কি করে ভুলি?
বাবা নেই? এত বড় দুনিয়াতে আমার বাবা-মা -বাবু কারো জায়গা নেই?
চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার।
“চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়,
আঁধারের শেষে ভোর হবে ”
কিন্তু আমার জীবনে তখন শুধুই অন্ধকার রাত, ভোর আর আসে না।
পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো। বড় আপা তার দেবরের সাথে মেজ আপার বিয়ে দিল। মেজ আপা আমার কোন উপদেশ কানে নিল না।
বাবার সম্পত্তি ভাগাভাগি হল। বাবা উইল করে যাননি। তিন বোনের মধ্যে সমান ভাগ হলো। যা পেলাম, যথেষ্ট।
চাচাতো চাচা তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইলেন, আমার চিন্তায় উনি রাতে ঘুমাতে পারছেন না, একই অবস্থা মামাতো মামার, খালাতো খালুর, আরও অনেকের।
কব্জা করতে না পেরে সবাই আমার উপরে খুব অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলেন। চরিত্র নিয়েও অনেক কথা উঠতে লাগলো। কিন্তু যে মানুষ জীবনে এতো বড় বড়
আঘাত সহ্য করেছে, তাকে মচকে ফেলা এত সহজ?
কলেজ জীবন থেকে টিউশন করতাম, বাবার আপত্তি সত্ত্বেও, এম.এস.সি করেই কলেজে ঢুকে গেছি,নিজের উপার্জন আর বাবার সম্পত্তি মিলে নেহাৎ কম না।
কলেজে পড়াই, তারপর হাস্নাহেনা টেইলার্সে কুড়ি জন বাপে ফেলানো -স্বামী তাড়ানো মেয়ের সেলাই আর ব্লক-বাটিক-এম্ব্রয়ডারির প্রশিক্ষণ তদারকি করি, নয়ন শিশু আলয়ে যেয়ে অনাথ দেবশিশুদের খাওয়া-লেখাপড়ার তত্ত্ব-তালাশ নিই, রাতে বাসায় ফিরে আসি, বাবা-মা -বাবুই পাখির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।
আরও অনেক স্বপ্ন আছে আমার। কতো কাজ সামনে। সুতরাং, আবারও বলি,আমাকে কেউ করুণা করবেন না, প্লিজ। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন।
Views: 44