উৎসব
_______নাহিদ ফারজানা সোমা
বিকট শব্দে ঘুম ভাঙলো হারুন সাহেবের। বুক এমন ধড়ফড় করছে যে দম নিতেও কষ্ট। আবারও ভয়াবহ শব্দ। সেই সাথে চোখ ধাঁধানো আলো। সালেহা স্বামীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আশ্বস্ত করতে চাইলেন,”ভয়ের কিছু নেই। নিউ ইয়ার বলে বাচ্চা কাচ্চারা আনন্দ ফূর্তি করছে। বাজি পোড়াচ্ছে। তুমি ঘুমাও। আমি পাশে আছি।” এমন হবে,এমনই হয় অত্যাধুনিক বাংলাদেশে, তাই সালেহা ঘরের মোটা পর্দাগুলো ভালো করে টেনে রেখেছিলেন আগেই। রাত দশটায় হারুন সাহেব যখন ঘুমাতে এসেছিলেন,তখন সালেহা আগাম সাবধান করে রেখেছিলেন, ” রাতে অনেক শব্দ হতে পারে। ভয় পেওনা কিন্তু। ” কিন্তু হারুন সাহেব ভীষণ ভয় পেয়েছেন। অতি আওয়াজ আর অতি আলো তিনি বাল্যকাল থেকেই ভয় পান। ঝড়ের রাতগুলোতে আতংকে তাঁর ভালো করে ঘুম হতো না। আর এখন বিরাশি বছর বয়স, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে দু’বার, বছর তিনেক আগে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। এক কালের অতি হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল, পরোপকারী, আমুদে মানুষটি আলঝেইমার্সেও আক্রান্ত। রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে এতো আলো আর শব্দের দাপট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
সালেহা স্বামীকে একটু পানি খাওয়ালেন। দুই কানে তুলো গুঁজে দিলেন। দুই লেয়ারের ভারি পর্দার উপরে মোটা বেডকাভার বিছিয়ে দিলেন। তারপরও শব্দ, তারপরও আলো।
হারুন সাহেব ঘুমাচ্ছেন না,ছটফট করছেন। সালেহার প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে। চোখে পানি দিয়ে এসে তিনি অস্হির স্বামীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ছেলে-মেয়েরা সব বিদেশে থাকে। লেখাপড়া করতে গিয়ে সেখানেই সেটল হয়ে গেলো।এই দেশ থাকার যোগ্য না। ট্রাফিক জ্যাম কমবেশি সব দেশে আছে, কিন্তু বাংলাদেশ এদিক দিয়ে প্রথম। প্রতিদিন অস্বাভাবিক জ্যামে বসে থেকে কি পরিমাণ গ্যাস,তেল আর মানুষের সময়,শারীরিক ও মানসিক শক্তির অপচয় ঘটে, তার হিসাব আল্লাহ ছাড়া কেউ রাখে না। মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা নোংরা রাজনীতি। হারুন সাহেবের চতুর্থ ছেলে বুয়েটের হলে থেকে পড়তো। মন দিয়ে লেখাপড়া করতো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, বাঁশি বাজাতো, কারোর সাতে পাঁচে ছিলো না বলে কম হয়রানির শিকার হয়নি। ছাত্রনেতাদের কাছে। শিক্ষক নামধারী কতোগুলো অপোগন্ডের কাছে। তারপরে এক অশুভ দিনে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে প্রাণ হারালো নিরীহ, মেধাবী, নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে সনি। আশরাফ অর্থাৎ হারুন সাহেবের চতুর্থ ছেলের ক্লাসমেট। খুব আঘাত পেলো আশরাফ। সনির হত্যাকারীদের, হত্যাকারীদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাদের কিছুই হলো না। শুধু সনির নিম্নবিত্ত বাপ-মা,ভাই,বুড়ি দাদির সব স্বপ্ন -আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলো, আস্ত পৃথিবীটাই তাদের কাছে বিষময় হয়ে গেলো।
সালেহার এক চাচা ছিলেন জেলা জজ। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব কারোর বাসায় যেতেন না, কাউকে নিজের বাসাতে আসতেও বলতেন না। বিচার বিভাগে থেকে তিনি যদি কোনো ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন, কেউ যদি তাঁর কাছে অন্যায় আবদার ধরে, সেই ভয়ে। পরিবারের, আত্মীয়ের, বন্ধুদের অভাব, দুর্যোগ, দুঃখ কষ্টের সময় পাশে সবসময় থাকতেন তিনি, ছায়াসঙ্গী হয়ে। পেশাগত বিষয়ে তাঁকে প্রভাবিত করার দুঃসাহস ছিলো না কারো। আপন শ্যালককে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন অন্যায় সুপারিশ করার জন্য। এজন্য তাঁর নিজের সংসার ভাংতে বসেছিল, কিন্তু তিনি নীতি থেকে একবিন্দু টলেন নি। চাচার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সালেহা। আগে কি স্বচ্ছ ছিলো বিচার বিভাগ। আর এখন? বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে।
নোংরা, গা ঘিনঘিন করা রাজনীতি এখন স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি, অফিস, আদালত কোথায় নেই? ভালো মানুষেরা টিকতে পারবে না এখানে। নিজেদের ভবিষ্যৎ তো যাবেই, ছেলেমেয়েদেরও জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। তাই ছেলেমেয়েগুলো একে একে সবাই বাইরে চলে গেলো। প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো বাপ-মা’কে নিয়ে যেতে, কিন্তু সফল হয়নি। হারুন সাহেব আর সালেহা খাতুন দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বিদেশে বেড়াতে গেলেও মাসখানেক পরে হাঁপিয়ে যান। দেশে ফেরার জন্য অস্হির হয়ে পড়েন।
রাত সাড়ে বারোটা। আধাঘন্টা পার হয়ে গেছে, উচ্ছ্বাস কমার লক্ষণ নেই। ইংরেজি নতুন বর্ষকে বরণ করছে সারা পৃথিবী। বাংলাদেশ করবে না কেন?সাড়ম্বরে করবে।
আজ পূর্বার অ্যাকসিডেন্টের দুই বছর পূর্ণ হলো। সালেহার বুক চিরে নিঃশ্বাস বের হলো। পূর্বা তাঁর বড় বোনের কোলপোঁছা মেয়ে ছিলো। বড় আপার পঞ্চাশ বছর বয়সে পূর্বার পৃথিবীতে পদার্পণ। সালেহাদের পাঁচ বোন -দুই ভাইয়ের আঠাশ জন ছেলেমেয়েদের মধ্যে পূর্বা সবচেয়ে ছোটো।
অ্যাকসিডেন্টের সময় পূর্বার বয়স ছিল তেইশ। একত্রিশে ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সে তার অসুস্থ ফুপুকে সেবা যত্ন করেছিলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে সে আর তার ভাই সৈকত উত্তরা পৌঁছাতে পেরেছিলো চার ঘন্টা পরে। বিশ্রী জ্যাম, এই রাস্তা বন্ধ, ঐ রাস্তা বন্ধ। গাড়ি ওয়ার্কশপে ছিলো বলে দু’ভাইবোন সিএনজি তে ফিরছিলো। অনেক চেষ্টা করেও ট্যাক্সি পায় নি। রাত বারোটায় পূর্বার বাসার কাছেই সিএনজিকে প্রবল আঘাত করলো এক বেপরোয়া গাড়ি। সিএনজি চালক তাৎক্ষণিক নিহত, দুই ভাই বোন গুরুতর আহত। দুইমাস পরে একটা পা কাটা অবস্থায় সৈকত হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলো, পূর্বা ফিরলো না। অ্যাকসিডেন্টে তার শরীরের আঠাশটা হাড় ভেঙে গিয়েছিলো, মাথায় চোট পেয়েছিলো ভীষণ, আই সি ইউ তে একুশ দিন যমের সাথে লড়াই করে জানপাখিটা আল্লাহর কাছে চলে গেলো।
পূর্বার কথা মনে করে সালেহা কেঁদে ফেললেন। ঐ ঘটনার পরে বড় দুলাভাই স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। দেড় বছর হলো দুলাভাই নেই। আপার মানসিক ভারসাম্য নেই । এরমধ্যে লাং ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সৈকতের একটা পা নেই, তার চেয়ে কষ্টের কথা, সে এখন বদ্ধ উন্মাদ। অ্যাকসিডেন্টের ভয়াবহতা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তীব্র আঘাত, অতি আদরের ছোটবোনের আর্তনাদ, রক্তাক্ত শরীর, সিএনজি চালকের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া লাশ, কয়েকদিন পরেই পূর্বার মৃত্যু সংবাদ, নিজের পা কেটে ফেলার রায় শোনা সৈকতকে বোধশূন্য করে দিয়েছে। সে সারাদিন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে পশুর মতো গোঙায়। কখনো হাসে,কখনো কাঁদে।
পূর্বার সিএনজিকে ধাক্কা দিয়েছিলো যে দামী গাড়ি, তার চালকও কিছুটা আহত হয়েছিলো। নাম তার শান, বয়স ষোলো,অতি নামকরা ইংলিশ মিডিয়ামের ক্লাস এইটের ছাত্র। ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, কিন্তু ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শিখেছে। সেই বিদ্যা সম্বল করে বাপের প্রাডো আর ছয় বন্ধুকে নিয়ে সে বর্ষবরণ উৎসব করতে বের হয়েছিল। হ্যাপি নিউ ইয়ার! হ্যাপি নিউ ইয়ার! পুরানোকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে সাদরে,সাড়ম্বরে বরণ করতে হবে, প্লেনের গতিতে রাস্তায় গাড়ি চালাতে হবে, মাঝরাতে কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টি করতে হবে। সেই বছরে শান,তার বাপ-মা আর বন্ধুরা সেই নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো।
শানের ধনকুবের ও অতি প্রতাপশালী বাবা জানালেন, নিউ ইয়ার উপলক্ষে তাঁরা র্যাডিসনে পার্টিতে ছিলেন। অবুঝ বাচ্চাটা যে প্রাডো নিয়ে রাস্তায় বের হবে তা তিনি কল্পনাও করেন নি। কিন্তু তদন্তে জানা গেলো, শান প্রায়ই বিকেলে বা রাতে গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হতো,গাড়ি চালাতে সে খুব ভালোবাসে। এর আগেও একটা রিকশাকে সে ধাক্কা দিয়েছিলো। বেশি না,সামান্য ধাক্কা। তারপরে উল্টে রিকশাওয়ালাকে মার। টুকটাক আরও ঘটনা ঘটেছিলো। বাপ-মা সবই জানেন। কিন্তু কখনো ছেলেকে বাধা দেননি।
কিছুই হয়নি শানদের। আইনের ফাঁক গলে সুন্দর বের হয়ে এসেছে সদলবলে। আজকেও নিশ্চয় আনন্দে মাতাল তারা।
কলবেল বাজছে। এতো রাতে কে? অনেক দিনের বিশ্বস্ত রেবুর মা দরজা খুললেন। পাশের বাড়ির বৌটা। অমৃতা। দশদিন হলো বাচ্চা হয়েছে। বৌটা ভারি অসুস্থ। তার জন্মগত হার্টের সমস্যা আছে। বড় অপারেশন হবে সামনে। শরীরে রক্ত খুব কম। সিজারের সময় ব্লাড দেওয়া লেগেছিল। এখন তার মুখ আরও রক্তশূন্য। তার বিধবা,বৃদ্ধা শাশুড়ি কেমন যেন করছেন। বাজির ক্রমাগত শব্দ আর আলোয় অসুস্থ বোধ করছিলেন, এখন চড়া মিউজিক আর মাইক ফাটানো হিন্দি গানের শব্দে খুব অসুস্থ বোধ করছেন।
গান বাজনার যন্ত্রণা চলছে সন্ধ্যা থেকে। উদ্দাম গান,উদ্দাম নাচ। অমৃতাদের ফ্ল্যাটে বেশি আওয়াজ আসছে। বাচ্চাটাও পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে।
” আন্টি,মা কেমন যেন করছেন। আমার ভয় লাগছে খুব। জয়ের ফোন বন্ধ। সে বন্ধুদের সাথে লং ড্রাইভে গেছে। ”
“বুড়ো মা, অসুস্থ বৌ, দশদিনের বাচ্চা ফেলে লং ড্রাইভে গেছে? আশ্চর্য ! ”
অমৃতার শাশুড়ির অবস্থা সত্যিই বেশ খারাপ। হাঁপানি আছে বৃদ্ধার। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ।
“হাসপাতালে নেওয়া দরকার,অমৃতা। ”
“কি করে নিবো আন্টি? জয় গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে। মোবাইল বন্ধ। দেবর-ননদকে ফোন করলাম,নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। খালাতো দেবরকে ফোন করলাম, বললো তার বাসায় অনেক মেহমান। আসা সম্ভব না।”
রেবুর মা’কে হারুন সাহেবের কাছে বসিয়ে সালেহা অমৃতার শাশুড়িকে নেবুলাইজ করলেন। তাঁর নিজেরও অ্যাজমা আছে। বাসায় নেবুলাইজার মেশিন, ইনহেলার সবই আছে। অমৃতার শাশুড়ির কিছুই নেই। এমনই করিৎকর্মা জয় আর তার ভাই বোনেরা।
নেবুলাইজ করার পরে আরাম পেলেন মহিলা। কিন্তু গান আর আনন্দোচ্ছ্বাসের আওয়াজ ভয়ংকর। ড্রামের আওয়াজ যে হাজার হাজার অসুস্থ মানুষের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই।
এই শব্দে অমৃতাদের ঘুম হবেনা। সালেহা ওদের বাড়ির সবাইকে নিয়ে এলেন নিজের ফ্ল্যাটে। অনেক বড় ফ্ল্যাট। বড় ছেলে কিনে দিয়েছে। বেশিরভাগ ঘর ফাঁকা পড়ে থাকে। অমৃতার শাশুড়িকে এমন ঘর দেওয়া হলো যেখানে “সংগীত ” নামের প্রাণঘাতী বস্তুটির আওয়াজ সবচেয়ে কম আসে। মানুষটার ঘুম দরকার। ঘুমের ওষুধ খেয়ে অমৃতার শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন। এখন মুখে প্রশান্ত ভাব। মেঝেতে বড় তোষক পেতে দেওয়া হলো অমৃতার গৃহসহকারীদের ঘুমানোর জন্য। অমৃতা আর তার বাচ্চার জন্য আরেকটা ঘর।
সব ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন সালেহা। শব্দ আর টেনশনে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
রেবুর মা বললেন,”আজ সারা রাইত নাচন-কুদন চলবো খালাম্মা। দারোয়ান ভাইয়ে কইছে পাশের অ্যাপারমেনে পনরো লাখ ট্যাকা চান্দা উঠছে খাওন দাওন,নাচন কুদনের জন্য। টিভিতে টিউলিপ নামের একটা মাইয়া নাইচ্যা নাইচ্যা গান করে না খালাম্মা? তারে নাকি ভাড়া করে আনছে। অ্যাপানমেনের সব সাহেবগো এক রকম ডেরেস, সব বিবিসাবদের এক রকম শাড়ি। কতো ট্যাকা মাইনসের খালাম্মা। আর আমার রেবুর বাপে মরলো শীতে, নিউমোনিয়ায়। তহন যদি আপনারে আমি চিনতাম খালাম্মা,তাইলেতো রেবুর বাপে মরতো না।”
“পুরানো কথা মনে কোরো না।রেবুর বাবার জন্য দোয়া করো। আর ঘুমিয়ে পড়ো। রাত সাড়ে তিনটা। অমৃতা, জয় খুব কেয়ারলেস, বলতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু তোমাদের সাইডের কেউ নেই যে তোমার কাছে বেশ কিছু দিন থাকতে পারে? তোমার তো ভালো খাওয়া,বিশ্রামের দরকার।”
“আমার বাবা-মা নেই, জানেন তো আন্টি। দুই বোনের একজন কানাডায় থাকে, আরেকজনের এসএলই। মাঝেমধ্যে অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়,তখন হসপিটালাইজড হতে হয়। এখন হাসপাতালে ভর্তি। কিছুক্ষণ আগেও ফোন করেছে, শব্দে ঘুমাতে পারছে না। কাছেই কোথাও কনসার্ট হচ্ছে, তুমুল হৈচৈ। সেই সাথে এতো রাতেও সমানে গাড়ির হর্ন, মোটর সাইকেলের আওয়াজ, ছেলেপেলেদের উদ্ভট চিৎকার। আমার বোনের নাকি মনে হচ্ছে, সারা ঢাকা শহরের সমস্ত গাড়ি -মোটরসাইকেল রাস্তায় নেমে এসেছে। আন্টি,মানুষ এতো অবিবেচক কেন? আনন্দ করবে করুক, কিন্তু অন্যকে কষ্ট দিয়ে কেন আন্টি? জয় কোথায় গেছে জানেন? পাবে, ওর গার্লফ্রেন্ড আর অন্যান্য বন্ধু বান্ধব নিয়ে। চমকে উঠলেন আন্টি? মেয়েটাও ঘনঘন বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়, জয়ও ঘন ঘন গার্লফ্রেন্ড পাল্টায়। মেয়েটা আজ ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরেছে। হলিউডের নায়িকারাও হার মানবে। ড্রেসটার স্লীভ নেই , লেংথ হাঁটু থেকে অনেক উপরে। এই পোশাক নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। ড্রেস আপ,গেট আপ পারসোনাল চয়েস। ও যদি উলঙ্গ হয়েও ঘুরে বেড়ায়,কেউ কিছু বলতে পারবে না।প্রগতিশীলরা আন্দোলন শুরু করবে। একটা মেয়ে ন্যুড থাকুক, এক টুকরা কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাখুক,তাতে অন্যের রাগ হবে কেন?ও কি পরবে না পরবে, সম্পূর্ণ ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে এর বিরুদ্ধে বলবে,সে-ই খারাপ, অশিক্ষিত, অকর্মা। দেশটা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে আন্টি। নতুন বছর শুরু হলো,আনন্দ তো আমরা করবোই। যে কোনো নতুনকে সুস্বাগতম। তাই বলে এমন মাত্রাছাড়া? এমন বিকৃত? টাকা দিয়ে কি আনন্দ কেনা যায়? আজ এক রাতে এই গরীব দেশে কতো লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে আন্টি ধারণা করতে পারেন? তাও যদি নিখাদ আনন্দ হতো। আমরা এখন কৃত্রিম আনন্দের জালে পড়ে গেছি। সেলিব্রেটি সিঙ্গার, সেলিব্রেটি ড্যান্সার, মাইক ফাটানো চিৎকার, ধুম ধাড়াক্কা গানের সাথে হাত-পা ছুঁড়ে নাচ, লং ড্রাইভ,শর্ট ড্রাইভ,পার্টি, উপচে পড়া খাবার, মদ, লাখ লাখ টাকার বাজি পোড়ানো। এই আমাদের নিউ ইয়ারের আনন্দ। এই আনন্দের চোটে কে মরলো,কে বাঁচলো, কে অসুস্থ হয়ে পড়লো, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কতো উৎসব আমাদের দেশে। আজ নারী দিবস, আসো, মহিলারা এই রঙের শাড়ি পরি, আজ স্বাধীনতা দিবস, সুতরাং সবুজ লাল ড্রেস ছেলে বুড়ো সবার জন্য, আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, সুতরাং সাদা কালো ড্রেস, পয়লা বৈশাখ, তাহলে ড্রেস সেই অনুযায়ী, পয়লা ফাল্গুনে বাসন্তী রং ড্রেস, কারোর গায়ে হলুদে যাবো,বলে দেওয়া হবে জামদানি পরে আসো, একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার হবে,সেখানেও বলা হবে, চলো সবাই নীল কালারের ড্রেস পরি। উৎসব মানে এখন টাকার খেলা।”
” সেটাই অমৃতা। আমরা চেতনাশূন্য জাতি হয়ে যাচ্ছি। ঈদ, বিয়ে কোনো উৎসবে আর আনন্দ নেই। ঠিকই বলেছো। উৎসব মানে টাকার খেলা। আগে আমরা কতো আনন্দ করে বউ সাজাতাম, কতো যত্ন আর মমতা দিয়ে, এখন সবকিছু করে দেয় পার্লার। পার্লারের মধ্যেও উঁচু জাত,নীচু জাত আছে। এখন পানচিনিতে পার্লার, বিয়েতে পার্লার,বৌভাতে পার্লার। এখন যে টাকা এনগেজমেন্টে খরচ হয়, সেই টাকা দিয়ে কমপক্ষে দুইটা তিনটা বিয়ে ভালো ভাবে দেওয়া যায়। বর-কনের ধারের কাছে যেতে পারো? পারো না। বর-কনে থাকে প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যানের আন্ডারে। একেকটা প্রোগ্রামে শুধু ফটোগ্রাফিতে দুই লাখ খরচ হয়েছে,এমনও শুনেছি। কিন্তু আনন্দ তো হয় না। আমরা যাই, দামী পোশাক, গয়না, অ্যাকসেসরিজের নীরব প্রতিযোগিতা করি, খাই, গিফট দিই,চলে আসি। ”
” একটা নতুন বছর কিংবা নতুন জীবনকে স্বাগত জানাতে হয় উৎসাহ,উদ্দীপনা, নতুন উদ্যম, নতুন স্বপ্ন, আশা আর পবিত্র আনন্দের সাথে,তাই না আন্টি?”
“নিশ্চয়ই মা। হতাশ হবে না। নতুন বছরের শুরুতে অনুপ্রাণিত হও। সব কলুষতা,মালিন্য, অবসাদ ঝেড়ে ফেলো। নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করো। অনাচার, বিকৃতি মুছে যাবে। নতুন বছর নতুন বার্তা নিয়ে আসবে। নতুন ভাবে ভাবতে শেখাবে। তখন জীবনের প্রতিটি দিনেই হবে আনন্দময় উৎসব। ”
Views: 55