নিয়তি
– ইাসরাত জাহান নিতা
তখন আমার বয়স সাত বছর।রাতে মায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ মনে হলো দূর থেকে কেউ যেন আমাকে ডাকছে, নয়ন ওঠ এই নয়ন। আস্তে করে চোখ খুলে দেখি বাবা আমাকে ডাকছে আর গা ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে বাবা উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, নয়ন তোর মা কোথায় রে? তোর মাকে খুঁজে পাচ্ছি না, তোকে কিছু বলে গেছে?
আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, অসহায় ভাবে শূন্য বিছানায় তাকিয়ে বললাম,মা তো আমার পাশে ঘুমিয়ে ছিল তাহলে কোথায় গেল?
ও তুই তাহলে জানিস না? বেয়াদব মেয়েছেলে, কাল রাতে আমার সাথে ঝগড়া করে সকাল থেকে তিনি গায়েব। যত্তসব, এখন আবার তাকে খুঁজতে বের হও।নয়ন পান্জাবী দে তো যাই তোর নানি বাড়ি যেয়ে দেখে আসি সেখানে গিয়েছে কিনা?। এই বলে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমার বাবা খুব গরীব, পরের ক্ষেতে কামলা খাটে। আমার মা দেখতে খুব সুন্দরী, ভালো খাওয়া, ভালো শাড়ি এসব মায়ের পছন্দ। অভাব-অভিযোগ নিয়ে মা শুধু বাবার সাথে ঝগড়া করে। মা প্রায়ই বলে, এই অভাবের সংসার আমি আর করব না।
বিকেলে বাবা বাড়ি ফিরে বললেন,নারে নয়ন তোর মা বাপের বাড়ি যায়নি, গেছে তার মামু বাড়ি। গেছে যখন থাক কয়েকদিন তারপর নিজে নিজেই ফিরে আসবে। আমি আনতে যেতে পারব না। বাপ-বেটা একটু না হয় কষ্ট করে কয়েক দিন কাটিয়ে দেবো কি বলিস নয়ন?
সাত দিন পর বাবা মুখ কালো করে বললেন,নয়ন তোর মামা এসেছিল।তোর মা আর ফিরবে না।
অবাক হয়ে বললাম,কেন বাবা? মা কেন আর ফিরবে না? বাবা কোনো জবাব না দিয়ে উঠে চলে গেলেন।আমার শুধু মনে হচ্ছে মা কেন ফিরবে না?
এর কিছুদিন পর বাবা খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলেন। রাতে বাবার পাশে শুয়ে আছি মনে হলো বাবা কাঁদছে। আস্তে করে বাবার গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি হয়েছে? বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, নয়নরে তোর মায়ের সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তোর মা আর কোনোদিনও ফিরবে না রে নয়ন। সেই রাতে আমি আর বাবা অনেক্ষণ কাঁদলাম।
কয়েকদিন পর বিকেলে খেলতে বাইরে বের হয়েছি, পাড়ার জমিলা চাচি আমাকে ডাক দিলেন। আশেপাশে আরও কয়েকজন চাচিরা রয়েছে। জমিলা চাচি বললেন, ও নয়ন তোর মা তো আবার নিকে করেছে। আমার বাপের বাড়ির কাছে তোর মায়ের মামু বাড়ি। মামাত ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই ভাব ভালোবাসা ছিল, তার সাথেই নিকে করেছে।আহারে এত সুন্দর সোনার চাঁন ছেলে থুয়ে আবার নিকে করে! সে মা, না ডাইনী?
গ্রামের লোকজন মাকে নিয়ে অনেক খারাপ কথা বলে, কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়। ঘরে বসে ডুকরে কেঁদে উঠে বলি, মা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন? আস্তে আস্তে মায়ের উপর রাগ হতে লাগল।
মা ছাড়া সংসার অচল। বাবা আরেকটা বিয়ে করার চেষ্টা করছেন কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। একে তো বাবা গরীব তার উপর সাত বছরের একটা ছেলে আছে।আমার আর বাবার জীবন খুব কষ্টে কাটছে। রান্না খাওয়ার ঠিক নেই। ছয়মাস পর বাবা নতুন বিয়ে করে আনলেন।নতুন মাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম! খুব কালো আর লম্বা
প্রথম দিনই নতুন মা আমাকে ডেকে বলল, তোর নাম নয়ন তাই তো?শোন নয়ন আমি কিন্তু খুব রাগী। বাপ কামলা খাটে বলে ভাবিস না তুইও কামলা খাটবি। মন দিয়ে লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করবি।
কয়েকদিন যেতেই বুঝলাম নতুন মা মোটেও রাগী না। আমাকে খুব ভালোবাসে তবে লেখাপড়া আর স্কুলে যাওয়া নিয়ে কোনো খাতির নেই। আমি যতক্ষণ পড়ব মা আমার পাশে বসে থাকবে। আমি পড়াশোনায় ভালো, মায়ের উৎসাহে আরও ভালো করতে লাগলাম।
অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর বাবা একদিন ডেকে বললেন, নয়ন অনেক পড়াশোনা করেছিস আর করতে হবে না। কাল থেকে মাঠে যেয়ে কামলা খাটবি।
বাবার কথা শুনে মা রে রে করে উঠল, অসম্ভব নয়ন মাঠে যাবে না। ও পড়াশোনা করবে।
বাবা রেগে বললেন,আমি ওর পড়ার খরচ আর দিতে পারব না।
ঠিক আছে, নয়ন আমার ছেলে ওর পড়ার খরচ আমি জোগাড় করব তবুও পড়ালেখা বন্ধ করাবো না এই বলে মা গজগজ করতে করতে পাড়ায় চলে গেল।
পরেরদিনই মা তিন বাড়িতে কাজ নিলো। সেখান থেকে যা মাইনে পেতো তা দিয়ে আমার পড়ার খরচ চালাতো। কিন্তু আমি দেখতাম, মায়ের খুব কষ্ট হয়।
আমি দেখতে ফর্সা সুন্দর।গ্রামের লোকজন বলে, নয়ন ওর মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। আমার বুক ফেটে কান্না আসে কেন আমি কালো হলাম না? তাহলে সেই মার কথা আমাকে শুনতে হতো না, যে মা টাকাপয়সার জন্য, ভালো থাকার জন্য আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে।
খুব ভালো রেজাল্ট করে এসএসসি পাশ করলাম।কলেজে ভর্তি হয়ে দুই তিনজনকে প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা পেতাম। মায়ের টাকা আর আমার টাকা মিলিয়ে পড়ার খরচ চালাতাম। অনেক কষ্টে এম এ পাশ করে, হাই স্কুলে চাকরি পেলাম। মা যে কি খুশি হলো! বারবার আমার মাথায় হাত বুলায় আর চোখের পানি মোছে।
গলা জড়িয়ে ধরে মাকে বললাম, মা গো অনেক কষ্ট করেছো, আর না মানুষের বাড়ির কাজ ছেড়ে দাও। তোমাকে ভালো রাখার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি।
চাকরি পাওয়ার পরের মাসেই হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন। মা আমাকে অবলম্বন করে ভালো থাকার চেষ্টা করে।
আজ স্কুলে মিটিং ছিল, স্কুল দেরিতে ছুটি হয়েছে। ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার সাথে সাথে মা কাছে এসে বলল,নয়ন একটু আগে সুন্দর মতো এক মহিলা এসেছে। তোর খোঁজ করছে। আমি চিনি না, ঘরে বসতে বলেছি। তুই যেয়ে দেখ, মহিলা কি বলবে।
ঘরে যেয়ে দেখি চেয়ারে মাথা নিচু করে অপরিচিত মহিলা বসে আছে, জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমাকে কেন খুঁজছেন?
মহিলা মাথা উঁচু করল, সাথে সাথে আমি চমকে উঠলাম! আমার হাত পা অসাড় হয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। আঠারো বছর আগে দেখা সেই মুখ, যার গায়ের গন্ধ না নিলে আমার ঘুম আসতো না। সেই মানুষ এতদিন পর! তেমনি সুন্দর আছে সামনের থেকে কিছু চুল পেকে গেছে।মনে হচ্ছে ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরি, কান্না গলার কাছে আটকে আছে।
অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করে জিজ্ঞেস করলাম,আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? কোনো দরকার?
মহিলা আস্তে করে বলল,আমি একান্ত নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। আমার স্বামীর ক্যান্সার হয়েছে, খুবই অসুস্থ। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টের ভিতর আছি। তোমার কাছে একটু সাহায্যের জন্য আসলাম।
মনে হলো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিই, তারপর ভাবলাম না থাক, হাজার হলেও গর্ভধারিনী। পকেটে একহাজার টাকা ছিল সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এইটা রাখুন আর আপনার বাড়ির ঠিকানা লিখে দিন। আমার সামর্থ অনুযায়ী আপনার ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে দেবো।
মহিলা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল, তুমি অনেক ভালো বাবা। দোয়া করি তুমি আরও অনেক উন্নতি করো।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মহিলাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম,মাগো তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিলে? আঠারো বছরের জমানো কান্না বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো আমার দুচোখ বেয়ে ঝরতে লাগল। মাগো আমার কথা তোমার একবার ও মনে হয়নি!তোমাকে ছাড়া আমার দিন কিভাবে কাটবে? হঠাৎ দরজায় মাকে দেখলাম, মাকে দেখে আমার সম্বিত ফিরে এল। এ আমি কি করছি! যে মা নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে, গায়ের রক্ত পানি করে, মুখে রক্ত তুলে দিয়ে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করেছে তাকে রেখে আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছি! বিদ্যুতে শক লাগার মতো ছিটকে সরে যেয়ে বললাম, আপনি এখন আসুন আর কোনোদিনও আপনি আমাদের বাড়ি আসবেন না। আপনার ঠিকনায় টাকা আমি পাঠিয়ে দেবো।
আমার জন্মদাত্রী ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে উনার চলে যাওয়া দেখছি আর ভাবছি, যে টাকা পয়সার জন্য একদিন উনি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আজ সেই টাকার জন্য আবার আমার কাছে ছুটে আসতে হলো। হায়রে নিয়তি !
Views: 16