পরিবারের সদস্য
– ইসরাত জাহান নিতা
আজ কুড়ি দিন আমার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি থাকতে আমার একটুও ভালো লাগছে না, অসহ্য লাগছে।
আমার স্বামী আদনানকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আদনান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আদনানের সাথে আমার তিন বছরের সম্পর্কের পর পারিবারিক ভাবে ধুমধামের সাথে বিয়ে হয়েছে। তখন কি জানতাম ওদের পরিবার এমন! তাহলে হয়ত কোনোদিন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসতাম না। বিয়ের দিন থেকেই আলাদা ফ্লাটে উঠতাম।
গতকাল রাতে আদনানকে আমি পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছি এই বাড়িতে আমি থাকতে পারব না।
আদনান অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,মিলা তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
অনেক অসুবিধা হচ্ছে এই বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না, তুমি আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করবে।যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমি বাবার বাড়ি থাকব।
আদনান আর কোনো কথা না বলে আস্তে করে বলল,ঠিক আছে।
আমার শ্বশুরবাড়ি একান্নবর্তী পরিবার। আদনানরা দুই ভাই, এক বোন। আদনান ছোটো,ননদের বিয়ে হয়ে গেছে কানাডায় থাকে।সংসারে ভাসুর,জা তাদের ছোটো ছোটো দুই ছেলে মেয়ে আর শ্বাশুড়ি। শ্বশুর বেঁচে নেই দুইবছর আগে মারা গেছে।
আমার শ্বাশুড়ি বেশ ভালো, বউ হয়ে আসার পর থেকে আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করছেন, জা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করছে। কেউ আমাকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না। এবাড়িতে সবাই মোটামুটি ভালো তারপরও আমার এখানে থাকতে অসহ্য লাগছে তার বড়ো কারণ এই বাড়িতে কোনো প্রাইভেসি নেই।
বাড়ি ভর্তি লোকজন, যখন তখন সবাই রুমে ঢুকে পড়ে। কারোর রুমে ঢোকার আগে যে দরজায় নক করতে হয় এইটুকু কমনসেন্স এই বাড়ির কারোর ভেতর নেই।
আমি এক বাবার এক মেয়ে । আমার বাবা ব্যবসা করেন। বাড়িতে নিরিবিলি পরিবেশে বড়ো হয়েছি হঠাৎ এই শোরগোল আমার ভালো লাগছে না।
এই বাড়ির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা কাজের বুয়াদের নিয়ে। এই বাড়িতে দুইটা কাজের বুয়া আছে, বুয়াদের দেখে মনে হয় এরা কাজের বুয়া না বাড়ির সদস্য।
বউ হয়ে আসার পরদিন ছোটো যে বুয়া তাকে বললাম,বুয়া আমার বিয়ের স্যান্ডেলটা ভালো করে মুছে রাখো।সাথে সাথে শ্বাশুড়ি আম্মা বললেন,মাগো এদেরকে বুয়া বলে ডাকবে না। আমরা এদের বুয়া বলে ডাকি না। বয়স্ক যে তার নাম রাবেয়া, তুমি খালা বলবে। রাবেয়া আমাদের বাড়ি আছে প্রায় বারো বছর আর যার অল্প বয়স তার নাম নুরী, তুমি নাম ধরে ডাকবে সেও পাঁচ বছর ধরে আছে আর ড্রাইভারের নাম রহমত তাকে রহমত ভাই বলবে।
আম্মার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, আম্মা কাজের মেয়েদের তো বুয়া বলতে হয় এদের আবার খালা বলতে হয় নাকি?
আম্মা সস্নেহে বললেন, এদের যদি সবসময় বুয়া বলে ডাকো তাহলে এদের মন ছোটো হয়ে যাবে এরা নিজেদের এই পরিবারে সদস্য ভাবতে পারবে না।
আম্মার কথায় মনে মনে রাগ হলো। আমার বাপের বাড়িও সবসময় দুইটা বুয়া কাজ করে। দুই ছয়মাস পর পরই কাজের বুয়া চেঞ্জ হয় কারোর নাম আমরা কোনোদিন জানতেও চাইনি। তাদেরকে আমরা বুয়া বলেই ডাকি, বয়স্ক অল্প বয়সী সবাই বুয়া। কাজের মেয়েদের একটাই সম্বোধন বুয়া। আমাদের ডুপ্লেক্স বাড়ি, বুয়াদের কারোর সাহস হয় না উপরে উঠার। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে একজন বুয়া উপরে উঠে ঘর পরিস্কার করে। অথচ এখানে সে সবের বালাই নেই কাজের বুয়ারা যখন তখন সবার ঘরে ঢুকে পড়ছে। আমার জা ওদের সাথে গল্প করে।রাবেয়া বুয়া আম্মাকে বুবুজান বলে ডাকে। সেদিন দেখি আম্মা খাটের উপর বসে পান খাচ্ছে আর রাবেয়া বুয়া আম্মার ঘরে মোড়ার উপর বসে পান খাচ্ছে আর আম্মার সাথে গল্প করছে আমি দেখে হতবাক! আমাদের বাড়ি এসব চিন্তাও করা যায় না আমার মা প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও বুয়াদের সাথে বলে না। বুয়ারা আমাদের সবাইকে ভয় পায় আর এখানে সম্পুর্ণ ভিন্ন। এগুলো আমার একেবারেই অসহ্য লাগছে।
আমার বৌভাতের দিন পার্লারে সাজতে যাব, আমার জাও আমার সাথে যাবে। দুই জন পার্লার থেকে সেজে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে যাব।
বিকেলে পার্লারে যাওয়ার জন্য ভাবিকে ডাকতে ভাবির ঘরে ঢুকে আমি অবাক, ভাবি নুরীকে সাজিয়ে দিচ্ছে!
আমার ভিষণ রাগ হলো, রাগত্ব স্বরে বললাম,ভাবি আমরা পর্লারে যাবো আর তুমি এখন কাজের মেয়েকে সাজাতে বসেছো! দেখে মনে হচ্ছে বৌভাত আমার না নুরীর।
ভাবি সমান্য হেসে বলল,রাগ করো না মিলা এইতো হয়ে গেছে।আসলে নুরী তো সাজতে পারে না আমাকে অনুরোধ করল। কি করব বলো! ওদেরও তো সাধ আহ্লাদ আছে।
ভাবি আর আম্মা একই রকম এরা কাজের মানুষকে মাথায় তুলে রাখছে কিন্তু আমি ওদের মতো না। সেদিন নুরী আমার ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা আমার সিটি গোল্ডেন গহনায় যেমন হাত দিয়েছে আমি কড়া গলায় বললাম, খবরদার নুরী যখন তখন আমার ঘরে ঢুকবে না আর আমার কোনো জিনিসে ভুলেও হাত দেবে না। প্রতিদিন সকাল এগোরটায় আমার ঘর পরিস্কার করে দিয়ে যাবে এছাড়া আমার ঘরে যেন কখনো তোমাকে না দেখি। আমার কথা শুনে নুরীর ছোখ ছলছল করে উঠল কোনোরকমে বলল ঠিক আছে ভাবি।
নুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার একটু মায়া হলো কিন্তু পরক্ষণেই সেই মায়া ঝেড়ে ফেললাম। আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি, কাজের মেয়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে নেই তাহলে কাজে ফাঁকি দেবে।
বিয়ের সাতদিন পর ছুটির দিন দুপুরে ডাইনিং টেবিলে যেয়ে দেখি আম্মা তিনটা বাটিতে তরকারি বাড়ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা আজকে তো সবাই বাড়ি আছে আপনি কার জন্য তরকারি বাড়ছেন?
আম্মা স্মিথ হেসে বললেন, রাবেয়া, নুরী আর রহমতের জন্য। চিংড়ি মাছের তরকারি খেতে ভালো লাগবে তখন দেখা যাবে খেতে খেতে আমরা পুরোটাই খেয়ে ফেললাম, ওদের বরাতে আর হবে না।
তাই বলে আম্মা বাড়ির সদস্যদের খাওয়ার আগে বাড়ির কাজের লোকদের জন্য তরকারি উঠিয়ে রাখবেন! বেয়দবি নেবেন না আম্মা, এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক না। আগে তো বাড়ির সদস্য, আমরা খেয়েদেয়ে যা বাড়তি থাকবে সেগুলো বাড়ির কাজের লোক খাবে এটাই নিয়ম।
বৌমা একটা কথা ভাবো তো, রহমত নিজ হাতে বাজার করেছে, রাবেয়া, নূরী মিলে রান্না করেছে অথচ খাওয়ার সময় ওরা সেই তরকারি খেতে পেল না তাহলে ওরা কতটা কষ্ট পাবে! একারণে প্রতিদিন আমাদের খাওয়ার আগে মাছ, মাংসের তরকারি ওদের জন্য উঠিয়ে রাখি।
আম্মার কথা শুনে আমি হতবাক, এ কোন বাড়িতে এসে পড়লাম! বাড়ির লোকদের খাওয়ার আগেই কাজের মানুষের তরকারি বেড়ে রাখে! সিদ্ধান্ত নিলাম এই বাড়িতে আর থাকব না, যে বাড়িতে বাড়ির সদস্যদের থেকে কাজের মানুষের মূল্য বেশি সেই বাড়িতে আর না।
আমার বাবার বাড়ি সবসময় দেখে এসেছি কাজের মানুষের জন্য আলাদা বাজার হয়। দারোয়ান, ড্রাইভার, বুয়া এদের রান্না একসাথে হয় আর আমাদের জন্য আলাদা রান্না হয়। আমাদের জন্য চিকন চাল আর ওদের জন্য মোটা চাল। আমাদের জন্য দামী দামী মাছের তরকারী, মাংস রান্না করে বুয়া টেবিলে দেয় আর ওদের জন্য পোনা মাছ, তেলাপিয়া মাছ রান্না হয়, সপ্তাহে একদিন ওদের জন্য পোল্ট্রি মুরগীর মাংস রান্না হয়। আমাদের বাড়ি যত মেহমান আসুক আর যত পদেরই রান্না হোক সেই খাবার কাজের লোকদের জন্য না। মেহমান বিদায় নেওয়ার পর যদি কোনো খাবার বাড়তি থাকে তখন মা সেই খাবার যৎসামান্য বুয়াদের দেয়।
অনেক সহ্য করে এই বাড়িতে আছি কিন্তু আজ সকালে আমার সব সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছে,ছুটির দিন সকালে আদনান একটু রোমান্টিক মুডে ছিল, আদনান সবে আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরেছে হঠাৎ হুড়মুড় করে ভাসুরের মেয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে বলল,চাচু দিদা নাস্তা খেতে ডাকছে তাড়াতাড়ি চলো।আদনান লজ্জা পেয়ে ছিটকে সরে গেল আর আমার রাগে গা জ্বলতে লাগল। মনে মনে ভাবলাম এই বাড়িতে আর না আমাকে আলাদা হতেই হবে।
সকালে নাস্তা করে এসে মা’কে ফোন করে বললাম, মা আগামীকাল সকালে আমাকে নিতে আসবে। এই বাড়িতে আমি আর থাকব না। মা খুশি খুশি গলায় উত্তর দিলো,ঠিক আছে বেবি।
এখনই বাড়ির লোকদের কিছু জানাতে ইচ্ছা করছে না, আগামীকাল মা আসলে তারপর জানাবো, এখনই জানালে আম্মা, ভাবি আমাকে যেতে দিতে চাইবে না। দরজা বন্ধ করে আমার শাড়ি কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে রেখেছি। আগামীকাল এই বাড়ি থেকে চলে যাব ভাবতে খুশি লাগছে পাশাপাশি একটু খারাপও লাগছে।
সন্ধ্যার পর থেকে হঠাৎ আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড পেটে ব্যথা সেইসাথে ডায়রিয়া। বমি করতে করতে আম্মা কাহিল হয়ে পড়েছেন।ডাক্তার বাড়িতে এসে ওষুধ দিয়ে গেছেন।
রাতে আম্মার ঘরে আমরা সবাই বসে আছি। ভাবি বলল, রাত এগারোটা বেজে গেছে সবাই খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাতে যাও।ভাবি বুয়াদের উদ্দেশ্য করে বলল,রাবু খালা নুরী তোমরা সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছো সবার খাওয়া হয়ে গেলে তোমরাও খেয়ে শুয়ে পড়বে আম্মার কাছে রাতে আমি থাকব।
রাতে ঘুমিয়ে আছি গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল, পানি খেতে যেয়ে দেখি নুরী ঘরে খাওয়ার পানি দেয়নি। নূরীর উপর রাগ হলো, মা ঠিকই বলে কাজের মেয়েদের সাথে ভালো ব্যাবহার করলে এরা শুধু কাজে ফাঁকি দেয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম পানি খেতে, হঠাৎ করুণ সুরে কান্নার আওয়াজে চমকে উঠলাম! এত রাতে এভাবে কে কাঁদছে? তবে কি আম্মার শরীর বেশি খারাপ করেছে? দ্রুত আম্মার ঘরে ঢুকলাম আম্মা ঘুমাচ্ছেন মৃদু নাক ডাকার শব্দ আসছে, ভাবিও আম্মার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
আম্মা তো ভালো আছেন তাহলে কাঁদছে কে? কান্নার আওয়াজ লক্ষ করে এগোতে লাগলাম, কোণার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। একটু অবাক হলাম! এই ঘরে তো নূরী আর রাবেয়া বুয়া থাকে। ঘরের দরজা আধখোলা হয়ে আছে আস্তে করে ঘরে উঁকি দিয়ে আমি চমকে উঠলাম! জায়নামাজ পেতে রাবেয়া বুয়া আর নূরী মোনাজাত করছে আর আকুল হয়ে কাঁদছে সেই সাথে আল্লাহর দরবারে কিছু চাইছে। একটু ভালো করে কান পেতে ওদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলাম।রাবেয়া বুয়া কান্না জড়ানো গলায় বলছে, “ইয়া আল্লাহ আপনি আমার বুবুজানকে ভালো করে দিন, আমার সব আয়ু আমি বুবুজানকে দিয়ে দিলাম আমার জীবনের বিনিময়ে আপনি আমার বুবুজানকে সুস্থ করে দিন”। রাবু খালা ও নূরীর এরকম কান্না দেখে আমারও চোখে পানি এসে গেল। আমি আস্তে করে ওখান থেকে সরে আসলাম।
ঘরের সাথে লাগোয়া অন্ধকার বারান্দায় একাকী চুপচাপ চেয়ার বসে ভাবছি, একটা মানুষ অন্য মানুষকে কতটা ভালো না বাসলে নিজের জীবনের পরিবর্তে অন্য মানুষের জীবন ভিক্ষা চায়! কতটা ভালোবাসা না থাকলে সারাদিন এত পরিশ্রমের পর ঘুম হারাম করে এভাবে রাত জেগে নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে! রাবু খালা,নূরী আম্মার রক্তের কেউ না তারপরও আম্মার প্রতি তাদের কি নিগুঢ় ভালোবাসা!কই আমার বাপের বাড়ির কাজের বুয়ারা তো আমার মা’কে ভালোবাসে না, তাদের চোখে সবসময় আমি ভয় দেখেছি। এক বুয়ার হাত থেকে কাঁচের প্লেট পড়ে ভেঙে গিয়েছিল মা ঠাস করে বুয়ার গালে চড় দেয় তখন বুয়ার চোখে আমি মায়ের প্রতি ঘৃণা দেখেছিলাম। মা একবার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি ছিল তখন মায়ের বকাবকির হাত থেকে কয়েকদিনের জন্য রেহাই পাবে এটা ভেবেই হয়তো কাজের বুয়াদের চোখে আমি খুশি দেখেছি।
হঠাৎ আমার মনে হলো আমি আমার মায়ের মতো না হয়ে শ্বাশুড়ি আর জায়ের মতো হবো। কাজের লোকদের বুয়া না ভেবে পরিবারের সদস্য ভাববো। অনাত্মীয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বুকভরা ভালোবাসা পেতে আমার খুব ইচ্ছা করছে। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আলাদা ফ্ল্যাটে যাবো না এই বাড়িতেই সবার সাথে মিলেমিশে থাকব,সবাইকে ভালোবাসবো। আগামীকাল মা এই বাড়িতে এসে একাই ফিরে যাবে। একান্নবর্তী পরিবারে একটু প্রাইভেসির অভাব থাকে ঠিকই কিন্তু সেখানে থাকে সহযোগিতা, সহমর্মিতা আর থাকে একে অপরের প্রতি কঠিন ভালোবাসা।
Views: 15