অপালার ডায়েরি
___নাহিদ ফারজানা সোমা
ধারাবাহিক গল্প(৩য় পর্ব)
অপালার সাথে আমার মিল আছে। আমিও ভুগছি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে,সেই তেরো বছর বয়স থেকে। অপালার মতো আমিও ভাবিনি এটা একটা মানসিক রোগ, ভাবতাম এটাই আমার স্বভাব। পৃথিবীতে একেকজনের স্বভাব একেক রকম হয়। কিন্তু স্বভাবটা ভারি জ্বালাতে লাগলো। প্রথম দিকে সহনীয় ছিলো, পরে যন্ত্রণা শুরু হলো। সেটা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেলো যে বেঁচে থাকাটাই দায়। তারপরও বুঝিনি এটা অসুখ।
প্রথম দিকে আমি আমার এক পাড়াতুতো খালাকে অনুকরণ করতাম। উনি অনুকরণীয় মানুষ, এখন তা বলবো না। কিন্তু আমার ঐ কিশোরী বয়সে উনার কথাবার্তা, জীবন যাপন পদ্ধতি খুবই আকর্ষণীয় মনে হতো। আমি উনাকে কপি করা শুরু করলাম। কিন্তু অন্য একজন মানুষের কাজকর্ম, কথাবার্তা চব্বিশ ঘন্টা অনুসরণ করা এতো সহজ? তাছাড়া উনি একটু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। ইডেন কলেজে পড়তেন ও খুব সাধারণ মানের ছাত্রী ছিলেন। আর আমি নামকরা স্কুলের ভালো ছাত্রী। কাজেই কিছু দিন পরে তাঁকে অনুসরণ করা আমি বাদ দিলাম। এরপরে আমার মাথায় সেই ভূত চাপলো যা অপালার চেপেছিলো, শুদ্ধ কথা বলার ইচ্ছা, একটু এদিক ওদিক হলেই দিনটা নষ্ট। তখন নতুন দিনের আশায় পুরানো সবকিছু বাদ। নতুন করে পুরানো পড়া আবার পড়া, নতুন করে চেষ্ট অফ ড্রয়ারে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, কোরান শরীফের যেটুকু অংশ আগে পড়া হয়েছিলো, নতুন করে আবার সব পড়া, রিপিটেশন, শুধু রিপিটেশন। এ এক ভয়ংকর অবস্থা। অতি ভালো ছাত্রী আমার দম ফুরাতে শুরু করলো। যাক আমার কথা। অপালার কথাই বলি।
অপালার ডায়েরি
……………………..
আর পারছি না,আর পারছি না।আল্লাহ,দয়া করো। নিশ্চয়ই আমার কোনো পাপের শাস্তি দিচ্ছ তুমি। একই কথা ভাবা,একই কাজ বারবার করা আর পারছি না। সারা পৃথিবীর কেউ টের পাচ্ছে না কি অসহনীয় যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছি আমি। কি ভয়ংকর একটা চক্র। আমি এমন কেন?আমি কি পাগল? আমার স্বভাবটা এমন হলো কেন?
আজ আমাকে নিয়ে খুব একচোট হাসাহাসি হলো। আমি সন্ধ্যায় গোসল করি,তাও নিয়মিত না। গোসল করতে যে কষ্ট! মাথায় সাতবার শ্যাম্পু দেওয়া হয়ে যায়,সাতবার সাবান ডলা হয়ে যায়, চামড়া উঠে যায়,তারপরও মনে হয়,সত্যি শ্যাম্পু দিয়েছি তো? ভেজা চুলের গন্ধ শুঁকি। শ্যাম্পুর কড়া গন্ধ। কিন্তু এই গন্ধ তো পাঁচ দিন আগে দেওয়া শ্যাম্পুর ও হতে পারে। মনে তীব্র অস্হিরতা। নাহ্,আরেকবার শ্যাম্পু -সাবান দিতে হবে, হোক কষ্ট, তাও মনতো শান্তি পাবে। এদিকে মগ মগ,বালতি বালতি পানি ঢেলে চুল পরিস্কার করেছি, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ বারবার করে ধুয়েছি, এখন কিনা আবার শ্যাম্পু -সাবান দেওয়ার চিন্তা মাথায় আসলো। আচ্ছা, দিই। অষ্টম বারের মতো মাথায় শ্যাম্পু আর গায়ে সাবান ঘষলাম এক গোসলেই,আল্লাহ, দয়া করো, আবার যেন মাথায় রিপিটেশনের চিন্তা না আসে, এই যে আজ মার্চের নয় তারিখ, আমি অপালা খুব ভালো করে গোসল করছি, এই যে শ্যাম্পু দিলাম, আজ মার্চের নয় তারিখ, এই যে সাবান দেওয়া শুরু করলাম, মুখে, ঘাড়ে……….., আর যেন মনে সন্দেহ না আসে আল্লাহ। কিন্তু চুল আর শরীর ধুতে ধুতে আবারও সন্দেহের উঁকি ঝুঁকি, সত্যি আজ শ্যাম্পু -সাবান দিয়েছিতো? নাকি গায়ে শুধু শুধু পানি ঢেলেছি? ঈস্, রিপিটেশনের চিন্তাটা আবার মাথায় আসছে। আমি আর পারবো না। আবার নতুন করে গোসল আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।
এভাবেই চলছে আমার গোসল নামের যুদ্ধ। বছরের পর বছর ধরে। বাসায় মা রাগ করেন, “গোসল করিস নাকি সিনেমা দেখিস? এতো দেরি কেন হয় বাথরুমে?” বলেছিলামও মা’কে একদিন। মা বলেছেন,”এগুলো কিছু না। মনের উপর জোর খাটাও। হাতে অঢেল সময় তো! থাকতিস আমাদের মতো একশোটা কাজে,এসব হাস্যকর চিন্তা মাথায় আসার সুযোগ পেতো না।”
আমি ভাবতাম পৃথিবীতে আমারই এই বিচিত্র, বিচ্ছিরি স্বভাব। সেদিন পেপার পড়ে জানলাম, এটা একটা মানসিকভাবে রোগ। নাম অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। সঠিক চিকিৎসা হলে রোগটা সেরে যায়। ওফ্,তাই যদি হয়,ভীষণ ভালো। কিন্তু কোন্ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো? কিভাবে রোগের বর্ণনা দিবো?সমস্যাগুলোতো ভারি অস্বস্তিকর। এগুলো পরকে বলবো কেমন করে,হোন না উনি ডাক্তার।
আজ গোসল করে বের হয়ে দেখি আমাদের রুমে নয় দশজন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ইতুর হাতে আমার ডায়েরি। আমাকে দেখে হাসির বেগ আরও বেড়ে গেলো। তাজিন পেট চেপে হাসতে হাসতে বললো,”অপালা এসে গেছে। ইতু,আরেকবার পড়্ না। ”
ইতুও শুরু করলো সাথে সাথে, গলার স্বর একেক সময় একেক রকম করে, নানা ভঙ্গিমায়,
” পয়লা জানুয়ারি,…. সাল,
সারাদিন সত্য কথা বলেছি।
কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি। তবে আমার ছাত্রীকে একটু বকা দিয়েছিলাম। তর্ক করছিলো। তবু বকা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমাকে আরও সহনশীল হতে হবে।
কারোর দূর্নাম করিনি।
একজন অতি বৃদ্ধ ভিক্ষুককে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছি।
নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত পড়েছি। আরও মন দিতে হবে। এখানে একটা ক্রস চিহ্ন।
একটু হলেও পড়াশোনা করেছি।
অসুস্থ ছোট মামীর খোঁজ খবর নিয়েছি।
নীরু এক হাজার টাকা ধার চেয়েছিলো,দিইনি। এই পয়েন্টে একটা বড় ক্রস চিহ্ন।
বিদ্যুতের অপচয় করিনি।
গোসলের সময় পানির অপচয় করেছি। কিন্তু এখানে তো আমার কিছুই করার নেই। বন্ধু গণ, এই পয়েন্টেও একটা ক্রস চিহ্ন।
আজ বাইরের ভাজাপোড়া খেয়ে ফেলেছি। এখানেও ক্রস চিহ্ন। হা,হা,হা। ”
চিৎকার করে বললাম,”কেন তোমরা আমার পার্সোনাল ডায়েরিতে হাত দিয়েছো?”
তাজিন বললো,”এটা ডায়েরি? এটাতো খাতা একটা। আর চিৎকার করিস না,অপালা। তাহলে নিজেই রাতের বেলায় তোর এই ডায়েরিতে লিখবি,”আজ সহপাঠীদের সাথে চিৎকার করিয়াছি। কাজটা ঠিক হয়নি। তারপরে লাল কালি দিয়ে বিরাট ক্রস চিহ্ন।”
সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। মঞ্জু বললো,”আর হাসাস নারে। পেট ব্যথা করছে হাসতে হাসতে। দম আটকে মরে যাবো।”
আরেকজন বললো,”হাসতে হাসতে মুতু হয়ে গেছে রে।”
হায়! তোমরা হাসছো। দুঃসহ কষ্টের কালিতে লেখা অক্ষরগুলো তোমাদের এতো হাসাচ্ছে?! জানো, কি কষ্ট, অস্হিরতা, অসহায়তা লুকিয়ে আছে ঐ লেখাগুলোর ভেতরে?
নায়লা বললো,”ইতুরে, পাঁচ জানুয়ারির পৃষ্ঠাটা পড়্।”
ইতু আবার আরম্ভ করলো, “পাঁচ জানুয়ারি,…. সাল।
আজ মা জিজ্ঞেস করলেন,টাকা পয়সা লাগবে কিনা। বললাম, না। মা আবার বললেন,” ঠিক করে বল্। কিছু টাকা পাঠিয়ে দিবো।” আমি আবারও না বললাম আর মুখ ফস্কে বলে ফেললাম,আমার কাছে যথেষ্ট আছে। কথাটা মিথ্যা। আমার কাছে চারশো পঞ্চাশ টাকা পড়ে আছে মাত্র। মাস শেষ হতে দশদিন বাকি। এবারে চারজনের জন্মদিন উপলক্ষে চাঁদা দিতে হলো। আমি একা দিলে অল্পের মধ্যে ভালো কিছু দিতাম,যেমন ভালো বই, গাছের চারা বা একজোড়া ইমিটেশনের দুল। কিন্তু তাজিনরা এই ব্যাপারে রাজি না। তাদের কথা হলো, চাঁদা দিয়ে দামী কিছু উপহার দিতে হবে। মা’কে তো মিথ্যা বললাম। এটাকে কি মিথ্যা বলে? আমি তো বাসার উপরে বাড়তি চাপ দিতে চাইনি, তাই বলেছি আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। নাহ্,মিথ্যা মিথ্যা ই। আজ আমি মিথ্যা বলেছি। তারপরে ব-ড় একটা ক্রস। লাল কালি দিয়ে।
এরপরে লেখা, পরচর্চা ঃ করিনি।
দুর্ব্যবহার ঃ করিনি।
নামাজঃ ফজর কাজা পড়েছি।নামাজে মনোযোগ কম ছিল। লাল কালির ক্রস।
অতিরিক্ত ভাত খেয়ে ফেলেছি। দুই বেলা ই। কাজটা ঠিক হয়নি।এখানেও ক্রস।
ছাত্রীকে পড়ানোর ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও সততা ঃ শতভাগ
খুব সামান্য পড়েছি।
পানির অপচয়ঃ করিনি।
বিদ্যুতের অপচয় ঃ ক্লাস শেষ হওয়ার পরে আজ ফ্যান -লাইটের সুইচগুলো অফ করতে ভুলে গিয়েছি। অনেক পরে মনে পড়েছে। খুব অন্যায় হয়েছে। এই পয়েন্টে বড় ক্রস চিহ্ন। ”
হাসির ফোয়ারা। মৌরি বললো,”এরপরে নিশ্চয়ই লেখা,আজকের দিনটা ব্যর্থ। আজ এবং এর আগের সব অর্জন শেষ। আগামীকাল থেকে নতুন দিন,নতুন জীবন শুরু হবে,ইনশাআল্লাহ। অ্যাম আই রাইট? ”
“অ্যাবসোলিউটলি রাইট। হা,হা,হা।”
তাজিন বললো,” তোর ডায়েরি মিউজিয়ামে দেওয়ার মতো।এভাবে লিখিস কেন রে?”
আমি উত্তর দিলাম না, বলা ভালো, উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতিতে ছিলামনা। লজ্জায়,অপমানে আমার শরীর কাঁপছিলো। চোখ থেকে অনবরত পানি গড়াচ্ছিলো। আমি আমার চৌকিতে শুয়ে পড়লাম অন্য দিকে ফিরে।
নায়লা নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,”আজ রাতে অপালা লিখবে, দুর্ব্যবহার ঃ সহপাঠীদের উদ্দেশ্যে একবার চিৎকার করেছি। ক্রস।
পানির অপচয় ঃ গোসল করতে যেয়ে প্রায় শত বালতি পানির অপচয় করেছি। ক্রস। নামাজঃ এশা পড়িনি।অন্যান্য নামাজেও মনোযোগ কম। ক্রস। তাই না অপালা? ”
সন্ধ্যায় এককাপ চা খাই।আজ খেলাম না। রাতে ডাইনিং এও গেলাম না। ওরা কয়েকবার খেতে যেতে বললো।কিন্তু আমার একদম রুচি ছিলো না।
তাজিন বললো,” আজ অপালা ডায়েরিতে লিখবে, খাবারঃ সংযত। কান্নাকাটি ঃ করেছি। আজ লেখাপড়া করিনি। কারোর উপকার করিনি।তাই না অপালা?কি আজব ডায়েরি! জিন্দেগিতে কেউ এমন ডায়েরি দেখেনি বা পড়েনি। আমরা বিরল সৌভাগ্যবতী।”
আমি ডায়েরিটা ট্রাংকে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিলাম। ইতু বললো,”এটাই ভালো হলে। নইলে এই অমূল্য, দুষ্প্রাপ্য ডায়েরি যে কোনো সময় চুরি হয়ে যেতে পারে। আরও একটা তালা লাগিয়ে দিস।”
পরদিন সারা ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে ব্যাপক হাসাহাসি। ছেলেরাও অনেকে জেনে ফেলেছে ইতুদের কল্যাণে। তারাও টকঝাল মন্তব্য করছে।
বিকেলে টিউশনিতে গেলাম। ছাত্রী বললো, “বানান ধরবেন না ম্যাম। বানানের জন্য নম্বর কাটা যাবেনা।”
“কি হাবিজাবি বলো! বানান না শিখলে হয়? ”
“সত্যি ম্যাম। স্কুলে স্যার-ম্যাডামরা বলে দিয়েছেন বানানের জন্য নম্বর কাটা হবে না। পাবলিক পরীক্ষাতেও না।”
ছাত্রীর মা’ও একই কথা বললেন।
“স্কুল থেকে যা বলার বলুক, তুমি ভালো করে বানান শিখবে। ”
ছাত্রীর মা বললেন,”বানান নিয়ে বেশি কড়াকড়ির দরকার নেই। সময় নষ্ট। নম্বর কাটা হবেনা,আমার সামনেই বলেছে।”
কি অবস্থা ! এই ছাত্রীর বাবা -মা শুধু নম্বর আর পজিশন চিনেন। ক্লাস ফাইভের এই মেয়েটাকে আমি পড়াই, এছাড়া আরও একজন টিচার আর দুইটা কোচিং সেন্টারে পড়ে। স্কুলে যায় কদাচিৎ। দেশের সবচেয়ে নামকরা গার্লস স্কুল, সেখানে নাকি পড়ানো হয়না। টিচাররা স্কুল টাইমে বাসায় বসে ব্যাচে ব্যাচে পড়ান। তাঁদের কাছে না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কম দেন। হুমকি ধামকিও করেন। সত্যি সেলুকাস,বড় বিচিত্র এই দেশ।
গতকালের ঘটনার পর থেকে রুমমেট বা অন্য সহপাঠীদের সাথে কথা বলছি না। ইচ্ছা হচ্ছে না। ওরা ওদের হাসাহাসি চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ইয়ারমেটরা হলের অন্যদেরও আমার ডায়েরির কথা জানিয়ে দিয়েছে। ডাইনিং এ আজ রুমা আপা বললেন,” অপালা,আর ভাত নিও না।পরে ডায়েরিতে লিখবে, খাওয়া অসংযত। এই ভুলের জন্য তোমার আজকের দিন ও বিগত দিনগুলো ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমাকে সব কাজ আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। এতোদিনের নামাজ কালাম,পড়াশোনা সব ব্যর্থ করে দেওয়া ঠিক না। ”
মনে হচ্ছে , ছোট্ট বেলাটা কি সুখের ছিলো। অমন সুখের দিনগুলো আর ফিরে আসবে আমার জীবনে? মায়ের জন্য গভীর দুশ্চিন্তায় দিন কাটে,ডায়াবেটিস আনকন্ট্রোলড, প্রেশার আনকন্ট্রোলড। পানি এসে দুই পা
ঢোলের মতো হয়ে গেছে। মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়? ভাবতে পারিনা,ভাবতেই পারিনা।
চলবে।
Views: 19