অপালার ডায়েরি
___নাহিদ ফারজানা সোমা
ধারাবাহিক গল্প(৪র্থ পর্ব)
কে এই অপালা? কেমন করে ওর খাতাগুলো আমার পুরানো ভাড়া বাসার স্টোর রুমে হাজির হলো? আগের ভাড়াটিয়া জানেন না,তার আগের ভাড়াটিয়া জানেন না, প্রাক্তন বাড়িওয়ালা জানেন না, ভারি অদ্ভুত।
অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার যার আছে সে জানে জীবন কেমন কঠিন হয়ে যায়। যেমন কঠিন জীবন আমার। ডাক্তার দেখিয়েছি, লাভ হয়নি, দোষ আমার। ওষুধ ঠিকমতো খাইনা, কয়েকদিন পরে বন্ধ করে দিই, সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যাই না,কাউন্সেলিং এর দরকার, সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নিইনা। দোষটা আমারই।
কিন্তু বেচারি অপালার অবস্থা ভয়াবহ। এমন নেতিবাচক পরিবেশে ও টিকে ছিলো কি করে?
মানসিক রোগ শারীরিক রোগের চেয়েও ভয়াবহ। শারীরিক অসুস্থতা সবার চোখে পড়ে, রোগীর কষ্ট দেখে সবাই সহানুভূতিশীল হয়, চিকিৎসা করায়। আর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে? রোগী বেচারা বুঝেই উঠতে পারে না যে এটা রোগ। বুঝলেও তাকে বোঝার মানুষ খুব কম। আমার আব্বা-আম্মাই বলেন,” নিজের ওপর কন্ট্রোল আনো। গোসল করার পরেও যদি মনে হয় তুমি গোসল করোনি, ব্যস,করোনি। এটা নিয়ে মাথাব্যথার দরকার নাই। তুমি মনের কথায় চলবে নাকি মন তোমার কথায় চলবে? বি স্ট্রং, বি কনফিডেন্ট। ” কি করে বুঝাই,রোগটা একটা দুষ্ট চক্র। রোগীর মাথায় যা ঢুকে,তা থেকে সে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারেনা। সে স্বাভাবিক জীবনের আকাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে যায়,কিন্তু জীবন অস্বাভাবিক হতে অস্বাভাবিকতর হতে থাকে। বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে দুর্বিষহ হয়ে যায়। অথচ বাইরে থেকে রোগিকে দেখে সহজে বোঝার উপায় থাকেনা যে সে কি স্ট্রেসের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে।
অপালার ডায়েরি
……………………..
তাজিন রাতে রুমে ফিরে বললো,” সবাই দুই হাজার করে চাঁদা দে। কুমকুম আপা আর জিসান ভাইয়ের অ্যাফেয়ার অ্যানিভার্সারি কাল। পনেরোটা খাসি জবাই হবে। আইটেম বিরিয়ানি, কাপে করে ক্ষীর, কোল্ড ড্রিংক। জিসান ভাই তার হলের আর কুমকুম আপা আমাদের সবাইকে খাওয়াবে। অন্যান্য বন্ধু বান্ধব, পার্টির লোকজন তো থাকবেই। ভিপি,জিএস,এজিএস সবাই থাকবে। আমরা এই হলের ইয়ারমেটরা দুই করে দিলে এক লক্ষ উঠবে।আপু ক্যাশ চেয়েছে। ”
তাজিন কুমকুম আপার চামচা। কুমকুম আপা আমাদের হলের কালচারাল সেক্রেটারি, জিসান ভাই কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক। আজ উনাদের প্রেমের প্রথম বার্ষিকী। তাই আমাদের উপহার দিতে হবে। হাউ ফানি! এই পনেরোটা খাসি, খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সব সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের ঘাড় ভেঙে।
“তাজিন,আমি টাকা দিবো না। তুমি খুব ভালো করেই আমার আর্থিক অবস্থা জানো।তাহলে কেন বারবার আমাকে চাঁদা দিতে বলো?”
“তুই কি ফকিরের মেয়ে? তোর বাপ-মা দু’জনেই মাস্টারি করে না? হোক প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার,সরকারের কাছ থেকে বেতন নেয় তো। তোরা সব সরকারি ইনস্টিটিউশনে পড়িস।কয় পয়সা যায়রে তোদের লেখাপড়ার পেছনে?সারাক্ষণ নিজেকে ফকির প্রমাণ করার চেষ্টা করিস কেন? এমন হাড় কিপটা কেন তুই? ”
“তুমি তোমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে মাসে কমসে কম তিরিশ হাজার নাও। দরকার পড়লে আরও নাও। তোমার ফ্যামিলির সেই সামর্থ্য আছে। আমার নেই, আমার ফ্যামিলির নেই। আমাকে দু টাকাও ভেবে চিন্তে খরচ করতে হয়। তুমি যদি আমার অবস্হানে থাকতে,তুমিও হাড়কিপটে ই হতে। আমি অন্যের জন্য টুকটাক যা কিছু করি,তুমি সেটাও করতে না।”
“এটা কুমকুম আপার প্রোগ্রাম। উনার পাওয়ার সম্পর্কে জানো তো? উনি আমাকে টাকা তুলতে বলেছেন। উনাকে উপহার দেওয়া আমাদের কর্তব্য। ”
“আমার কর্তব্য না। আর এটাকে উপহার বলে না,চাঁদাবাজি বলে। আমি টাকা দিবো না তাজিন।”
“ঠিক আছে। জানাবো কুমকুম আপাকে।”
“জানাও।”
ঝামেলা হবে। কুমকুম আপা এক ভয়ংকর ব্যক্তি। জিসান ভাইয়ের সাথে প্রেম হওয়ার পরে আরও উগ্র, আরও অত্যাচারী। ছাত্রীদের দিয়ে চা বানানো, কফি বানানো কুমকুম আপার জন্য ডালভাত।ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রীদের দিয়ে সে নিজের পাও টিপায়। হলে মারামারির সময় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স থাকে কুমকুম আপার। কতোজনের মাথার গোছা গোছা চুল যে সে উপড়ে নিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। যেসব গালিগালাজ সে উগড়াতে থাকে, তাতে ফেরেশতারাও হোষ্টেল ছেড়ে পালিয়ে যান বলে আমার বিশ্বাস। মাস ছয়েক আগে মারামারির সময় একজনের বুকে লাথি দিয়ে তার পাঁজর ভেঙে ফেলেছিল। একবার চেয়ার ছুঁড়ে একজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল। এসব কারণে দলে কুমকুম আপার বেশ সুনাম, হলে প্রবল দাপট। অকুতোভয় সেনা। পার্টির গৌরব। শোনা যায়, ক্ষমতাসীন দলের খুবই উঁচু লেভেলের সাথে কুমকুম আপার হট কানেকশন আছে। হট কানেকশন মানে একসাথে ওঠা-বসা এমনকি শোয়া। পার্টি ক্ষমতায় থাকলে কুমকুম আপা পাশ করার পরে এমপি হবে কোনো সন্দেহ নেই।
“তাজিন।”
“কি?”
“ঠিক আছে,আমি দুই হাজার দিচ্ছি। কিন্তু তোমরা জানো না,মাসটা চালাতে কি পরিমাণ কষ্ট হবে আমার।”
“আর সবাই হোষ্টেলে চলে কেমন করে? তুমি একাই গরিব গুবরা? আসলে অপালা, গরিব তুই মানসিকতায়, টাকায় নয়। ”
তাজিন,তুমি চট্টগ্রামের অতি ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। তোমার বাবার জাহাজও আছে। তুমি কি করে জানবে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যেবিত্তের লড়াইয়ের কথা?জানতে, যদি তোমার একটা সংবেদনশীল, মানবিক অন্তর থাকতো, উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকতো। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের তা নেই।
টিউশনিটা যেতে বসেছিলো। আমার ছাত্রী অনেক বেছে পড়ে। স্যার -ম্যাডামরা যে সাজেশন দেন,তার বাইরে সে একফোঁটাও পড়তে রাজি না। তার মাও না। এভাবে পড়িয়ে আমার আত্মতুষ্টি হয়না। একটু ভালো করে বুঝাতে গেলে ছাত্রী আর তার মা দু’জনেই অসন্তুষ্ট হয়। আমি নাকি সময় নষ্ট করছি। এখন ওদের নির্দেশনামতো পড়াই। কিন্তু ওসিডির রোগী আমি তৃপ্তি পাই না এমন অসম্পূর্ণ, ফাঁকিবাজি পড়া পড়াতে।
দুই হাজার চাঁদা দেওয়ার পরে আমার কাছে এখন আড়াইশো টাকা আছে। মাস শেষ হতে এখনো আটদিন। এতো স্ট্রেসে অসুখটা খুব বেশি রকম বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। কার কাছে যাবো? কি ভাবে অসুখের বিবরণ দেওয়া শুরু করবো? ভাবছি, ডাক্তারের কাছে যেয়ে বলবো, আমার অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। সেই সাথে আমার ভীষণ অ্যাংজাইটি। আর আমি ডিপ্রেশনে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। আমাকে বাঁচান,প্লিজ। ”
চলবে।
Views: 29