অপালার ডায়েরি
___নাহিদ ফারজানা সোমা
ধারাবাহিক গল্প(৬ ষ্ঠ পর্ব)
অপালা চোর! মানতে কষ্ট হচ্ছে। আরেকটু কষ্ট ও ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে ওর সৎ থাকা উচিৎ ছিলো। নাকি এই চুরি করা ও সেটাকে জায়েজ মনে করা অসুখেরই পার্ট। কি জানি! আরও বিস্তারিত জানা যাক অপালা সম্পর্কে।
অপালার ডায়েরি
……………………..
আপার এমবিবিএস ফাইনালের মধ্যে মায়ের বাবু হবে। ডাক্তারি পরীক্ষাগুলো নাকি ভয়ংকর কঠিন। মা ও পরীক্ষা – দুই বিষয়েই আপা চিন্তায় ও কষ্টে কাতর।
আমার মাঝে মধ্যে খুব রাগ হয় বাবা-মায়ের উপরে। অ্যাকসিডেন্টলি এমন হলে রাগ হতো না, পাঁচ পাঁচজন সন্তান তোমাদের, সংসারে আর্থিক টানাটানি, আপা বিবাহযোগ্য মেয়ে,এই সময়ে তোমাদের একজন নেককার সন্তানের দরকার পড়লো? আমরা নেককার না? বিশেষ করে আদিব। তোমাদের ষষ্ঠ সন্তান আদিবের চেয়েও নেককার বান্দা হবে নাকি? কি ধরণের সিদ্ধান্ত নিলে বাবা-মা তোমরা?
আমার রুমমেটরা হাসাহাসি করে বিষয়টা নিয়ে। বলে, “অপালার আব্বা-আম্মার এখনো কেমন তেজ,শৌর্যবীর্য, দেখ্। আর মেয়ে হলো হুজুরনি। ”
বাবা-মা সম্পর্কে যে এমন মন্তব্য করা যায় তা হোষ্টেলে বাস না করলে জানতাম না।
মা-বাবার জন্য নিয়ে নিয়মিত ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে ইচ্ছা করে। বড় মাছ, মাংস,নিয়মিত দুধ। কিন্তু বাবা-মা কিছুতেই আমাদের টিউশনের টাকা নিতে চান না। জোর করে ছয় হাজার দিয়েছিলাম গত মাসে, অনেক বকাবকি ও জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। টিউশনের টাকা বলেও লাভ হয়নি। বলেছেন, ” টিউশনের টাকা হলে এটা দিয়ে নিজে ভালো খাও, বইপত্র কেনো, আমাদের কিছু দিবেনা। পাশ করে চাকরি করবে যখন, তখন সুযোগ সুবিধা মতো উপহার দিও। ”
চুরিটা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। আগে তো ভালো জামাকাপড়, জুতা স্যান্ডেল, ব্যাগ,সাজগোজের জিনিস নিয়ে এতোটুকু মাথাব্যথা ছিলো না। এখন আমদানি হলো কি করে? দিনের পর দিন টিটকারি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ,এমনকি বাবা মায়ের রুচি, আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে মাঝে মাঝে ঠারেঠুরে কথা শুনে? “তাজিনের আব্বা বিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, দেখতেও আঙ্কেল খুব হ্যান্ডসাম, আন্টি খুব সুন্দর, আন্টির শাড়ি-গয়নার রুচি কি ভালো, খুবই অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট ফ্যামিলি। ওদের বাড়ি দেখলে মাথা ঘুরে যায়।” কিংবা ” ইতুর আব্বা-আম্মা দু’জনেই ডক্টরেট করা, বাপরে বাপ! ওর দাদা এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির ভিসি ছিলেন। চাচা-ফুপু-মামা-খালারা সবাই হাইফাই। ইতুর নানা সেক্রেটারি ছিলেন। ” সবার পরিবার নিয়েে বিস্তর আলোচনা হয়। নায়লার আম্মা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। সারাদেশ তাঁকে চিনে। বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। বাংলায় এম এ। শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর সৌন্দর্য, চোখ জুড়ানো জামদানি আর তাঁতের শাড়ির সংগ্রহ, শাড়ি পরা ও সাজগোজের স্টাইল নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রায়ই ফিচার বের হয়। মৌরীর দাদা মন্ত্রী ছিলেন। আর আমার পরিবার নিয়ে কি কথা হয়? বাবা,মায়ের আবার বাচ্চা হবে। আপা মেডিক্যালে পড়ে কিন্তু দেখে বুঝা যায়না। আপার অনেক গ্রুমিং দরকার। দু’বোনই খ্যাত্ জামাকাপড় পরি। চেহারায় স্মার্টনেস নেই। আদিব আনস্মার্ট। কেমন জুবুথুবু হয়ে থাকে। সেদিন বড় ছাপওয়ালা শার্ট পরে এসেছিল যা আমার রুমমেটদের খুব হাসিয়েছে। এসব শুনতে শুনতেই কি আমি বিকৃতমস্তিষ্ক হয়ে গেলাম? নিজের সম্পর্কে কটু কথা হজম করা যায়,ফ্যামিলি নিয়ে যায়না। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, চুরি করতে আমার বিবেকে বাধে না, তবে নিজেকে নির্দোষ সাজিয়ে রাখার জন্য মিথ্যা বললে সেটা আমার বিবেকে বড্ড লাগে। মিথ্যা বলার পরদিন হতে আবার নতুন জীবন শুরু করি ভালো হয়ে থাকার প্রত্যাশায়।
আস্তে ধীরে সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেডশিট, শাড়ি কেনা শুরু করেছি। আদিব বা বাসার লোককে বলি,ছাত্রীর মা দিয়েছেন কিংবা কুমকুম আপা কি মনে করে দিয়েছেন অথবা তাজিন, মৌরী,ইতুরা কেউ উপহার দিয়েছে। হোষ্টেলে বলি, খালার বাসায় গিয়েছিলাম, তিনি উপহার দিয়েছেন। একবার বলেছি, “স্কুলের বন্ধুর সাথে রাস্তায় দেখা, বড়লোকের বৌ,সে জোর করে বাড়িতে নিয়ে যেয়ে খাইয়েছে আর নিজের জন্য ও আমার জন্য একই ড্রেস কিনেছে। ”
হলে প্রায় মারামারি হচ্ছে। একই পার্টির দুইটা শাখা। কুমকুম আপা সেদিন প্রতিপক্ষের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছে। এইসব মারামারি, চুলোচুলি শুরু হলে আমি উসিলা বের করে বাথরুম বা টয়লেটে লুকিয়ে থাকি। একজন আরেকজনের চুল ধরে টানছে, কেউ যুদ্ধের ময়দানে খুন্তি নিয়ে নেমে গেছে, একজন হয়তো মেঝেতে পড়ে গেছে, বাকিরা তাকে লাথি মারছে, কি যে কুৎসিত দৃশ্য! সেই সাথে সরু সরু গলায় অশ্রাব্য অশ্লীল গালাগালি। এই হলো জনগণ ও দেশের কল্যাণে রাজনীতি । এই হলো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা, রুচি,বিবেক।
বাড়ি যেতে হলো মা’র নেককার সন্তানের জন্মসংবাদ পেয়ে। ছেলে হয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে মা সুস্থ আছেন। বর্তমানে ছয় সন্তানের জননীর এই প্রথম সিজার লেগেছে। প্রাইভেট ক্লিনিকে সিজার হওয়ায় খরচ হয়েছে বেশ। আমি মায়ের হাতে দশ হাজার দিলাম, বললাম,” এবারে না বোলো না, টিউশনের টাকা জমাতাম তোমার জন্য। ” জমজ বোন দু’টার জন্য কে ক্র্যাফট থেকে দুইটা করে ড্রেস নিয়ে গিয়েছি। অজুহাত দিলাম,আমার জন্মদিনে বন্ধুরা কে ক্র্যাফটের গিফট ভাউচার দিয়েছিলো। ঢাকায় এসে মনের সুখে অনেক কেনাকাটা করলাম, গল্পচ্ছলে বন্ধুদের বললাম, মায়ের ছেলে হওয়া উপলক্ষে মামা-খালা-চাচারা সবাই এসেছিলেন। সবাই নবজাতকের পাশাপাশি আমাকেও টাকা উপহার দিয়েছেন।
নতুন ভাইটার প্রতি আগে বিরূপ মনোভাব ছিলো,ওর জন্মের আগে, কিন্তু মুখখানা দেখে মনটা মায়ায় ভরে গেলো। আদিব ওর নাম রাখলো আমান।
বাবা-মা আমানকে নিয়ে খুবই বাড়াবাড়ি করছেন। দুনিয়া ভুলে গেছেন আমানের জন্য। এটা নিয়ে একটু খারাপ লেগেছে। জমজরা বাবা-মায়ের উপরে,সেই সাথে ছোট ভাইটার উপরেও বেশ বিরক্ত । আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবদের অনেক টিটকারি ওদের সইতে হয়। আপার ফাইনাল চলছে। ব্যাপারটা নিয়ে সে গোড়া থেকেই ভীষণ বিরক্ত ও আপসেট। ব্যাতিক্রম শুধু আদিব। ভাইটা আমার সব দিক দিয়ে ব্যাতিক্রম।
দুই দিন পরপর খবরের কাগজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকশনের সংবাদ বের হয়। ” ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের রাতভর সংঘর্ষ। আহত ছয়জন। শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ” “মহসিন হল এবং শহিদুল্লাহ হলে বন্দুকযুদ্ধ।” ” ক্যান্টিনে ফ্রীতে খান ছাত্র নেতারা।”
” বুয়েট ক্যাম্পাসে দুই দলের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।” কেন যে ছাত্র ছাত্রীরা এই নোংরা রাজনীতিতে জড়ায়! অবশ্য সিস্টেমটাই এমন। হলে থাকতে গেলে কারো না কারোর লেজুড়বৃত্তি করতে হবে। কারো না কারো গোলাম হয়ে থাকতে হবে। কেউ কেউ ভালো কিছু করার ইচ্ছায় রাজনীতিতে ঢুকে। তারপরে তার ভালো কিছু করার সামান্য সুযোগও অবশিষ্ট থাকেনা। সে আতান্তরে পড়ে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দলের আর নেতার মন যুগিয়ে চলতে হয়। জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসারও সুযোগ থাকেনা। কেউ কেউ আবার শুরু থেকেই সাক্ষাৎ শয়তান থাকে। পলিটিশিয়ানগুলো এতো নিষ্ঠুর! নিজেদের স্বার্থে নিষ্পাপ অল্পবয়সী ছাত্র ছাত্রীদের রাজনীতির নোংরা জালে জড়িয়ে ফেলে। কোনো কোনো ছাত্র বা ছাত্রী অল্পবয়সে ক্ষমতা ও অর্থের স্বাদ পেয়ে দানব হয়ে যায়। যখন নিজেকে তৈরি করার বয়স, জানার বয়স, শেখার বয়স, হাতে কলম থাকার বয়স, তখন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র। জোম্বি বানিয়ে দেওয়া হয় এদের। এদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু আর থাকেনা। নিজের মায়ের চাইতে পার্টির মা’কে তাদের বেশি আপন মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে কি হওয়ার কথা ছিল আর কি হলো! যতো দিন যাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ততো কমে যাচ্ছে। যাবে না কেন? পাকিস্তানি রাক্ষস আর তাদের বাংলাদেশি চামচাগুলো বেছে বেছে সবচেয়ে মেধাবী, দেশপ্রেমিক, সাচ্চা মানুষগুলোকে মেরে ফেলে বারোটা যা বাজানোর বাজিয়ে দিয়েছে। কোন্ পত্রিকায় যেনো সেদিন দেখলাম, যাঁরা সরকারের ভুল ধরিয়ে দিতেন, কি করা দেশের জন্য মঙ্গলজনক সে ব্যাপারে সরকারকে গাইডলাইন দিতেন,তাঁদের বুদ্ধিজীবী বলা হতো। আর এখন যে যতো চাটুকার,তেলবাজ, পল্টি খেতে ওস্তাদ, সে ততো বড় বুদ্ধিজীবী।
আমি প্রায় কার্জন হলের পুকুরটার পাড়ে যেয়ে বসি। একাই। পৃথিবীর সবার থেকে,সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি।পুকুরে আমার ছায়া পড়ে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলি,”কে তুমি? অপালা? কোন্ অপালা, বলোতো? তোমাকেতো আমি চিনতে পারছি না।”
চলবে।
অনেক রাতে ডায়েরি লিখলাম।
মিথ্যা ঃ অনেক মিথ্যা বলেছি। পাশে অনেক বড় ক্রস চিহ্ন। মনটা অসম্ভব খারাপ ও অস্হির। এই ক’দিনে বড় বড় কিছু চ্যাপ্টার পড়েছিলাম, কোরান শরীফ প্রথম হতে পড়া শুরু করেছিলাম অর্থ সহ। আজ মিথ্যা বলায় আগের সব অর্জন বরবাদ হয়ে গেলো। আগামীকাল হতে সব আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
ফজরের নামাজের পরে আড়াই ঘন্টা সময় নিয়ে গোসল করে নতুন জামাটা পরে মনটা ভালো হয়ে গেলো। হেয়ার কাটটা মানিয়েছে বেশ। বাহ্,আমি তো বেশ সুন্দর। লিপস্টিকটা লাগানোর পরে সৌন্দর্য শতগুণে বেড়ে গেলো। আমার সৌন্দর্যে আমি নিজেই অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমাকে ঘিরে বড় জটলা। সবার চোখে মুগ্ধতা। “তুই তো দেখতে দারুণ সুন্দর। এই হেয়ার কাটিংএ আর ভুরু প্লাক করে তোকে তো দারুণ দেখাচ্ছে। আর কি হয়ে থাকতিস। উদ্ভট জামা কাপড়, টেনে চুল বাঁধা, ঝোপের মতো ভুরু! পুরানো জামাকাপড় সব ছুঁড়ে ফেলে দে আজকে। কয়েক সেট নতুন ড্রেস কিনে ফেল্। ”
বিষন্ন হাসি হেসে বললাম,”আমার সামর্থ্যের কথা জানো তো তোমরা। নেহায়েত একজন কিছু জিনিস ভিক্ষা দিয়েছেন। ”
ইস্! মিথ্যা বলা হয়ে গেলো। আজকের দিনটাও নষ্ট হয়ে গেলো। মন ভালো ভাব মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো।
“এই জামার সাথে এই ব্যাগ একেবারে যাচ্ছে না। নতুন ব্যাগ লাগবে। এই ব্যাগটা নিস না অপালা।”
“কি করবো বলো? আমার গো একটাই ব্যাগ। ভালো ব্যাগ কিনতে হলে আরও দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।”
“আমার একটা ভালো ব্যাগ ব্যবহার কর নতুন ব্যাগ না পাওয়া পর্যন্ত। ”
“না রে ইতু, এভাবে কি চলা যায়?”
“আচ্ছা, আজকের জন্য নে অন্ততঃ। ”
নিলাম। ব্যাগ আমি গতকালই কিনতে চেয়েছিলাম। একসাথে এতো জিনিস কিনলে কারোর সন্দেহ হতে পারে,তাই কিনি নি।
ঐ বিকেলে আমি আবার চুরি করলাম । আমাদের মুখোমুখি রুমের মেয়েটার ড্রয়ার আর তাজিন-ইতুর ব্যাগ থেকে। মোট আট হাজার। টাকাটা লুকিয়ে রাখলাম এমন জায়গায় যা মানুষের কল্পনাতেও আসবে না।
চলবে।
Views: 16